রামপাল অভিযোগনামা: অভিযোগ-২ এর প্রেক্ষিতে জবাব

তানভীর ইসলামতানভীর ইসলাম
Published : 31 Oct 2013, 02:13 PM
Updated : 31 Oct 2013, 02:13 PM

এক

রামপাল প্রজেক্ট নিয়ে ড. আঞ্জুমান ইসলাম ও কাজী আহমেদ পারভেজ বিডিনিউজে চার পর্বের একটি ধারাবাহিক লিখেছেন এবং প্রথম পর্বে অভিযোগ-২ এ তারা দাবি করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান সাহেবের EIA বিষয়ক যে প্রেজেন্টেশনের রেফারেন্স আমার লেখায় দিয়েছিলাম সেটি নাকি তাঁর নয়! প্রেজেন্টেশনের লিংকটি ছিল-

প্রেজেন্টেশনটির ওয়েব অ্যাড্রেসে যে তথ্য দেওয়া আছে তাতে প্রতীয়মান হয় যে এটি AECEN নামক একটি সংস্থার জুন ২০১০ সালের কোনো ওয়ার্কশপের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রেজেন্টেশন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ২০১০ সালের জুন মাসে (৯-১০ জুন) ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় AECEN, USAID এবং ADB-এর যৌথ উদ্যোগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে একটি EIA ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল "Regional Workshop on Environmental Impact Assessment in Asia: Good Practices and Capacity Needs", এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান সাহেবের নাম ও ঠিকানা দেওয়া আছে (চিত্র-১) এবং "Sharing Experiences of EIA in Bangladesh" শীর্ষক প্রেজেন্টশনটি সেই EIA ওয়ার্কশপেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

ওয়ার্কশপের বিবরণ ও অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আবদুস সোবহান সাহেবের নাম (পৃষ্ঠা ২৮) নিচের লিংকে "Workshop Proceedings" থেকে পাওয়া যাবে–

আঞ্জুমান ইসলাম ও কাজী আহমেদ পারভেজ আরও লিখেছেন-

"প্রথমত আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে যে কেউ যে কারও নাম দিয়ে যা কিছু প্রকাশ করতে পারে। তাই সব রেসপনসিবল মানুষের প্রতি অনুরোধ থাকবে, যে কোনো জায়গায় কিছু পেলেই যাচাই-বাছাই না করে তার উপর ভিত্তি করে বক্তব্য প্রকাশ না করতে"।

তারা হয়তো ভেবেছেন AECEN.org কোনো ব্লগ বা সামাজিক মিডিয়ার কোনো ওয়েবসাইট যেখানে "যে কেউ যে কারও নাম দিয়ে যা কিছু প্রকাশ করতে পারে"।

কিন্তু তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি এই সংস্থাটি হল পরিবেশ নিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়গুলোর একটি নেটওয়ার্ক যার পুরো নাম "Asian Environmental Compliance and Enforcement Network", আসুন দেখি এদের ওয়েবসাইটে সংগঠনটির পরিচিতি সম্পর্কে কী বলা আছে–

"In 2005, environmental agency leaders from 13 Asian countries established the Asian Environmental Compliance and Enforcement Network (AECEN) to promote improved compliance with environmental legal requirements in Asia."

অর্থাৎ ২০০৫ সালে ১৩ টি এশিয়ান দেশের পরিবেশ সংস্থার প্রতিনিধিরা এই নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেন, পরিবেশ বিষয়ক আইনগত দিকগুলো যেন ভালোভাবে মেনে চলা হয় তা উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে।

এর সদস্য তালিকায় আছে ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়সমূহ। বিস্তারিত তালিকা এখানে দেওয়া আছে–

এর পার্টনার হিসেবেও উল্লেখ করা আছে– USAID, ADB, UNEP, এবং US-EPA-এর নাম। এতগুলো দেশের সরকারি পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যে সংস্থার সদস্য, তারা কতগুলো বানোয়াট ডকুমেন্ট বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেলের নাম দিয়ে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে– এই যদি আঞ্জুমান ইসলাম ও কাজী আহমেদ পারভেজের বক্তব্য হয়, তবে এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।

দুই

আঞ্জুমান ইসলাম ও কাজী আহমেদ পারভেজ আরও লিখেছেন-

"তার উপর এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেখানে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর স্পষ্ট আলামত পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সোর্স ভেরিফাই না করে এ রকম মন্তব্য করা কতটা গ্রহণযোগ্য? এটি মোটেও স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস নয়"।

অর্থাৎ তারা বলছেন আমি কেন উৎস যাচাই না করে AECEN এর ওয়েবসাইটে দেওয়া ডকুমেন্ট থেকে আমার বক্তব্য দিয়েছি? AECEN কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান তা উপরে বলেছি এবং তাদের EIA ওয়ার্কশপের লিংকও দেওয়া হয়েছে যে ওয়ার্কশপে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রেজেন্টেশনটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।

এবার আসুন আমরা এই প্রেজেন্টেশনে দেওয়া তথ্যের প্রকৃত উৎস "The Environment Conservation Rules, 1997" দেখি যেখানে ৭ নম্বর বিধি "Procedure for issuing Environmental Clearance Certificate" এ বিভিন্ন শ্রেণির প্রকল্পের ছাড়পত্র লাভের ধাপ ও শর্তগুলো সবিস্তারে বলা আছে। এই ৭ নম্বর বিধিটি এই লিংক থেকে দেখা যাবে–

এই ডকুমেন্টের পৃষ্ঠা ১৮৪-১৮৫ তে রেড ক্যাটাগরি প্রকল্পের সাইট/লোকেশন এবং পরিবেশ-বিষয়ক ছাড়পত্র লাভের ধাপ ও শর্তগুলো বিস্তারিত বলা হয়েছে। এই ক্যাটাগরির জন্য সাইট/লোকেশন ক্লিয়ারেন্স পেতে হলে যে কাগজপত্রগুলো আবেদনপত্রের সঙ্গে অবশ্যই জমা দিতে হবে তা হল–

(d) For Red Category:

(i) report on the feasibility of the industrial unit or project (applicable only for proposed industrial unit or project);

(ii) report on the Initial Environmental Examination (IEE) relating to the industrial unit or project, and also the terms of reference for the Environmental Impact Assessment of the unit or the project and its Process Flow Diagram;
or

Environmental Impact Assessment report prepared on the basis of terms of reference previously approved by the Department of Environment, along with the Layout Plan (showing location of Effluent Treatment Plant), Process Flow Diagram, design and time schedule of the Effluent Treatment Plant of the unit or project, (these are applicable only for a proposed industrial unit or project);

(iii) report on the Environmental Management Plan (EMP) for the industrial unit or project, and also the Process Flow Diagram, Layout Plan (showing location of Effluent Treatment Plant), design and information about the effectiveness of the Effluent Treatment Plan of the unit or project (these are applicable only for an existing industrial unit or project);

(iv) no objection certificate of the local authority:

(v) emergency plan relating adverse environmental impact and plan for mitigation of the effect of pollution;

(vi) outline of relocation, rehabilitation plan (where applicable);

(vii) other necessary information (where applicable);

[সূত্র: ECR, 1997 Clause 7]

অর্থাৎ সাইট ক্লিয়ারেন্স পেতে হলে আইন মোতাবেক উল্লিখিত সব শর্ত পূরণ করতে হবে। আঞ্জুমানরা তাদের লেখায় সাইট ক্লিয়ারেন্স পেতে কী কী জমা দেওয়া হয়েছে তার একটা তালিকা দিয়েছেন EIA রিপোর্ট থেকে। পাঠক, আপনারা মিলিয়ে দেখতে পারেন এখানে সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে কিনা (EIA ছাড়াও দেখা যাচ্ছে লে আউট প্ল্যান, ইমার্জেন্সি প্ল্যান ইত্যাদি জমা দেওয়া হয়নি)। দেখুন তাহলে–

এখন আসি EIA কখন জমা দিতে হবে সে প্রসঙ্গে। ৭ নং বিধিতে আবেদনপত্রের দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে প্রথমে লেখা আছে– IEE, EIA এর টার্মস অব রেফারেন্স এবং প্রসেস ফ্লো ডায়াগ্রাম দিলেই হবে যে কথা আঞ্জুমানরা বারবার বলে চলেছেন এবং রামপাল প্রজেক্টের জন্য যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখুন, এরপরই or দিয়ে EIA, লে আউট প্ল্যান, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ইত্যাদি কিছু বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং বন্ধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে– these are applicable only for a proposed industrial unit or project

অর্থাৎ প্রকল্পটি যদি নতুন প্রস্তাবিত প্রকল্প হয় (ইতোমধ্যে স্থাপিত প্রকল্পের পরিবর্তে) তবে এর EIA সাইট ক্লিয়ারেন্স পাবার আগেই সম্পাদন করতে হবে এবং আবেদনের সঙ্গে অবশ্যই জমা দিতে হবে। আর যদি এটি ইতোমধ্যে চালু প্রকল্প হয়, তবেই শুধু IEE করে এবং টার্মস অব রেফারেন্স জমা দিয়ে পরে EIA করা যাবে। আঞ্জুমানরা তাদের লেখায় বারবার যে প্রক্রিয়ার কথা বলে পাঠকদের বিভ্রান্ত করছেন এবং রামপাল প্রজেক্টের জন্য যা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র চালু প্রকল্প হিসেবে সাইট/লোকেশন ক্লিয়ারেন্স পাবার জন্য প্রযোজ্য।

AECEN এর ওয়ার্কশপে বাংলাদেশ সরকারের উপস্থাপিত প্রেজেন্টেশন এবং "The Environment Conservation Rules, 1997" অনুযায়ী নতুন প্রস্তাবিত প্রজেক্টের জন্য সাইট/লোকেশন ক্লিয়ারেন্স পেতে হলে নিশ্চিতভাবেই আবেদনের সঙ্গে EIA জমা দেবার শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে।

এখন সুন্দরবনের পাশে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পটি কি একটি ইতোমধ্যে চালু প্রজেক্ট হিসেবে বিবেচনা করে EIA পরে সম্পাদন করা উচিত, নাকি এটিকে একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে আইনে উল্লিখিত সব শর্ত পূরণ করে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল– সে বিবেচনার ভার আমি পাঠকের প্রতি অর্পণ করলাম।

তানভীর ইসলাম: নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহকারী অধ্যাপক, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।