ডেঞ্জারাস অন দ্য রানওয়ে

Published : 31 August 2010, 05:09 PM
Updated : 31 August 2010, 05:09 PM

বাংলাদেশ বিমান বহুবছর ধরেই একটি লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রায় ট্রেডমার্কে দাঁড়িয়ে গেছে। যখন এশিয়ার অন্যান্য বিমান সংস্থাগুলো বছরের পর বছর লাভ করে গেছে তখন  বাংলাদেশ বিমান বছরের পর বছর  লোকসান দিয়ে গেছে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা আর মাথাভারী জনবল নিয়ে বিমান আকাশে উড়তে পারেনি, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রানওয়েতে। কর্পোরেশন হবার কারণে সংস্থাটি সরকারী লুটপাটের ও নীতিনির্ধারকদের খামখেয়ালীপণার শিকার হয়েছে বারংবার। উড্ডয়ণ বৈশিষ্ট্যের আকর্ষণের কারণেই অন্যান্য যে কোন সরকারী সংস্থার চেয়ে বিমান লোভী আমলা, মন্ত্রী ও প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নজরে পড়ে যায় সহজেই, অনেকটা সুন্দরী নারী হয়ে জন্মাবার বিপদের মত। বিমান নিয়ে আজ যে বিমানমন্ত্রী, পরিচালনা পর্ষদ, সচিব ও সংসদীয় কমিটির লোকদের ভিতর বহুমুখী জটিল দ্বন্ধ প্রকাশ্যরূপ ধারণ করেছে তার মূলে ঐ লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কাড়াকাড়ি। হজ্ব মৌসুম এলে এ বিরোধ উত্তুঙ্গে পৌঁছায়।

স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ে বিমানে দুর্ণীতি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। সেসময়ে এক একটি এটিপি (ATP) বিমান (ধারণক্ষমতা ৭০ জন) যে মূল্যে কেনা হয়েছিল (চল্লিশ মিলিয়ন ডলার) তা দিয়ে ওয়াইড বডি এ্যায়ারক্রাফ্ট, যেমন বোয়িং ৭০৭, যার যাত্রী ধারণক্ষমতা ১৮০, কেনা যেত। অথচ অত যে মহামূল্যবান এটিপি তা কিন্তু বিমানকে নির্ধারিত সেবা না দিয়ে বছরের পর বছর ভোগান্তি সৃষ্টি করেছিল, কেননা, ঐ বিমানগুলো বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য উপযোগী ছিল না। হরির লুটে ব্যস্ত কর্মকর্তারা বিমানগুলো কেনার সময়ে সেগুলোকে configure করার কথা ভাবেন নি। পরে অনেক  লোকসান দিয়ে ঐ ঘাড়ের উপর চেপে থাকা বোঝাগুলোকে নামানো হয়।

এয়ারক্রাফ্ট যেহেতু একটি উন্নত প্রযুক্তির বাহন, এর বিভিন্ন কারিগরী ত্র"টি সৃষ্টি করা ও সেসব সারানোর জন্য ব্যায়ের বিশাল অঙ্কের বাজেট তৈরী ও ব্যয় নির্ধারণ সহজ হয়ে যায়, তখন সরকারী উচ্চ পর্যায়ের সৎ নীতিনির্ধারকদের (যদি কেউ থাকেন) বোকা বানানোও কঠিন  নয়। প্রতিটি হজ্ব মৌসুম এলেই যে বিমানের নিজস্ব বিমানগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যায় আর প্রয়োজন হয় লীজের নামে এক একটি শ্বেতহস্তী (কোন কোনটি ওড়ার ক্ষমতাহীন) ভাড়া করা – সেসব তো এখন ওপেন সিক্রেট। আর এসব চুক্তিপত্রে এত এত টাকা থাকে যে সাধুর পক্ষেও বখরা না নেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

উদাহরণস্বরূপ বিমানের ইঞ্জিন ওভারহলিং-এর কথা বলা যায়। ইঞ্জিনের ওভারহলিং-এ প্রধান যে কাজটি করা হয় তা হল ইঞ্জিন ব্যালেন্সিং। বিমানের হ্যাঙারে ব্যালেন্সিং করার যন্ত্রপাতি নেই – এই অজুহাতে প্রতিবছর এই ঝক্কিসম্পন্ন কাজ বিদেশ থেকে করিয়ে আনা হয়। এতে প্রতিবছর গড়পড়তা ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অথচ একবার ব্যালেন্সিং-এর যন্ত্রপাতি বসিয়ে নিলে প্রতিবছর এই বিপুল পরিমান টাকা সাশ্রয় হত। কর্মকর্তাগণ যন্ত্রপাতি বসাতে মোটেই উৎসাহী নন এবং কারণটা অনুমেয় – উৎসাহব্যঞ্জক কমিশনপ্রাপ্তি।  ১৯৯৪ সালে কুয়েতের আমির বাংলাদেশ বিমানকে একটি বোয়িং ৭৪৭ জাম্বুজেট উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন। কমিশন প্রাপ্তির কোন সুযোগ নেই বলে কর্মকর্তাগণ তা বিভিন্ন ছুঁতোয় নেননি, অর্থাৎ একটি অতিমূল্যবান উপহার থেকে তারা দেশকে বঞ্চিত করে। একইভাবে একবার অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্স কোয়ান্টাস ও আরো একবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স তাদের ব্যবহৃত এয়ারক্রাফ্ট অত্যন্ত কমমূল্যে বিমানকে দিতে চেয়েছিল, তখনো সে সুযোগ আমাদের সুযোগ্য কর্মকর্তারা গ্রহণ করেন নি, দেশ বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে যাদের কাছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠি স্বার্থ বড়। কেননা বিনামূল্যে বা কমমূল্যে বহর বাড়ালে তো আর নতুন বিমান কেনা বা লীজ নেয়ার বানিজ্য চালানো সম্ভব নয়।

বিমানের বিমানবহরে সাকুল্যে বিমান আছে ১৩টি, এর মাঝে আবার সচল রয়েছে আটটি, বাকী তিনটি অচল। যে কোন বিচারেই এটি একটি ক্ষুদ্র বিমান সংস্থা। ইউরোপ বা আমেরিকায় এমন একটি এয়ারলাইন্স চালাতে বড়জোর ১২০০ লোক নিয়োজিত থাকে। অথচ কিছুদিন আগেও বিমানে লোকবল ছিল পাঁচ হাজারের উপরে ; অর্থাৎ প্রতি ৪ জনে ৩ জনই ছিল অপ্রোয়জনীয়। তাহলে এই অতিরিক্ত লোকেরা কী করে? তারা ইউনিয়নবাজী করে, আর কাজ না করেও সংস্থাটি থেকে কী করে আরো আরো সুবিধা নেয়া যায় তার ফিকিরে ব্যস্ত থাকে। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই বিপুল অপ্রয়োজনীয় জনবল থেকে আনুমানিক দু হাজার জনকে 'গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক'-এর মাধ্যমে বিদায় করা হয়। সে আমলে শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন কিছুটা কোনঠাঁসা ও চুপচাপ হয়ে থাকলেও বর্তমানে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুনরায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাদেরই বাহুবলে চাকুরীচ্যুত (স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) অনেকে পুনর্বার চাকুরীতে বহাল হচ্ছে, অন্যেরা বহাল হবার জন্য তদবির করছে।

এই মাত্রারিতিক্ত লোকবলও বিমানের লাভজনক না হবার একটি কারণ, যদিও তা প্রধান কারণ নয়। উপরন্তু তা সংস্থাটির কর্মদক্ষতা, উৎপাদন ও উৎকর্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বেকারত্ব দূরীকরণ সরকারের একটি মহৎ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই পদক্ষেপ মাথাভারী ও অপদার্থ জনবলের এক একটি মাথাব্যাথা সৃষ্টিকারী উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা প্রতিটি সরকারই নিজ নিজ লোকদের প্রতি দুর্বল ও সহানুভূতিশীল; সেখানে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য। বিমানেও এভাবে ঢুকে পড়েছে অসংখ্য অযোগ্য লোক। দেশ স্বাধীন হবার পরে পিআইএতে যে সকল বাঙালী কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল তারা পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া উঁচু পদগুলো পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জন ব্যাতিরেকে দ্রুতই অধিকার করে বসেন। বিমানের হ্যাঙারে একসময়ে প্রধান প্রকৌশলীর পদে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি পিআইএতে ক্লিনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এমন উদাহরণ একটি নয়, অনেক।

বিমানে কাজ করার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি আমি ও আমার এক বন্ধু ভারতের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আই আই টি, খড়গপুর থেকে এ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসি। তখন এরশাদের শাসনামল। সরকারী প্রতিটি সংস্থায় এমবার্গো অর্থাৎ নিয়োগ বন্ধ। ১৯৮৭ সালে যখন এমবার্গো তুলে নেয়া হল তখন বিমান তার ট্রেনিং সেন্টারের জন্য প্রশিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। আমার মনে আছে প্রাথমিক লিখিত পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিমান স্টাফ ওয়েলফেয়ার স্কুলে। আনুমানিক ৪৫০ জন প্রকৌশলী তাতে অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্য থেকে ৬০জনকে আরো একটি  লিখিত পরীক্ষায় ডেকেছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। সেখানে উত্তীর্ণ ২০ জনকে অতঃপর  মেডিকেল টেস্ট, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা, ইন্টারভিউ ও একটি লেকচার প্রেজেন্টেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সে থেকে প্রাথমিকভাবে ৫ জন ও পরে আরো ৫ জন মোট ১০জনকে নিয়োগ দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। এ থেকে বোঝা যায় বিমানের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ ও কঠিন। কর্মী নির্বাচনের অত যে কঠিন প্রক্রিয়া- যেখানে ৪৫০ জন প্রাথমিক প্রার্থী থেকে সেরা ১০  জনকে বেছে  নেয়া হল, অতঃপর তাদের ট্রেনিংয়ের নাম করে অনির্দিষ্টকাল ধরে অস্থায়ী পদে ফেলে রাখা হল।  ক্যারিয়ারে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে আমি যখন ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি বিমানের চাকুরী ছেড়ে দিই তখনও আমি একটি কনসলিডেট ভাতা পেতাম (৩৫০০ টাকা, যা ছিল বহুবছর আগে নির্ধারিত পাকিস্থান আমলের ভাতা, দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুদ্রাষ্ফীতি বেড়েছে বহুগুণ, অথচ তা পরিবর্তিত হয়নি) এবং আমার চাকুরী তখনো স্থায়ী হয়নি। অথচ ইতোমধ্যে আমি পাইলট ও গ্রাউন্ডস ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমার অন্যান্য সহকর্মীরা, বিশেষ করে যারা ইলেকট্রিকাল বা মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন, আরো আগেই পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। আজ তাদের সকলেই স্বচ্ছল ও অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত।

মেধাবী প্রকৌশলীদের এভাবে নিরুৎসাহিত করে  দেশ থেকে 'তাড়ানোর' পেছনে ছিল দূরদর্শীতাহীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও অযোগ্যতা। সে সময়ে এরশাদের শাসনামলের কল্যাণে বহু সামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন কর্পোরেশনে উঁচু পদে বহাল হয়েছিল। বিমানে বেশ কিছু ডিরেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। এদের না ছিল কারিগরী জ্ঞান, না ছিল সিভিল এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালাবার দক্ষতা, ছিল না দূরদৃষ্টি বা দেশপ্রেম। থাকলে তারা মেধাবী প্রকৌশলীদের তাড়িয়ে দিয়ে বিমানবাহিনীর ননকমিশন পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত এয়ারম্যানদের প্রকৌশলীর ভূমিকায় নিয়ে আসতেন না।  এ হল বিমানের কর্মী ব্যবস্থাপনার একটি চিত্র যা থেকে বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি নয়, এরা ব্যস্ত নিজ উন্নয়নে।

মনে পড়ে বহুবছর আগে সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'র পাতায় খোন্দকার আলী আশরাফ 'দুর্জন উবাচ' শিরোনামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতেন। এটি স্বাধীনতা অর্জনের কয়েকবছর আগের কথা। তখন বিমানের শ্লোগান ছিল 'সেফ অল দ্য ওয়ে।' শ্লোগান হিসেবে মন্দ নয়, কিন্তু বিপত্তি বাঁধল সে সময়ে বিমান পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনায় পতিত হল, তবে আকাশে নয়, রানওয়েতে। তখন স্বভাবতঃই শ্লোগানটিকে সত্যনিষ্ঠ করে তোলার জন্য কিছুটা বদলের প্রয়োজন হল – 'সেফ অল দ্য ওয়ে, বাট ডেঞ্জারাস অন দ্য রানওয়ে।' বিমানের বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও বিপণনের কাজে নিয়োজিত একটি কল্পিত সংস্থার দু'দল কর্মীর মাঝে প্রথমে মতবিরোধ, পরে তর্কাতর্কি, পরিশেষে প্রায়-সংঘর্ষের মত পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে যায় একটি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে। একদল বলছে শব্দটি হবে 'ডেঞ্জারাস', অন্যপক্ষ বলছে এটি হবে 'ডেডলি'। আপাতঃ হাস্যরসের ভিতর দিয়ে যে করুণ চিত্রটি বেরিয়ে আসে তা হল বিমান কখনোই ভালভাবে উড়তে পারেনি বা এটিকে উড়তে দেয়া হয়নি। দুঃখ হয় যে, আমরা একটি কর্পোরেশনকেও ভালভাবে চালাতে পারলাম না। আমাদের লোভ সমুদ্রের মত সীমাহীন, আমাদের অযোগ্যতা পাহাড়ের মত উঁচু, আমাদের মূর্খতা মহাকাশের মত বিস্তৃত। তবে সময় এসেছে আগাছা সরিয়ে বিমানকে জঞ্জালমুক্ত করার এবং দুর্ণীতি ও অদক্ষতার সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে বিমানকে সফলভাবে আকাশে ওড়ানোর। সারা পৃথিবী তা পারলে আমরা পারবো না কেন?

