গ্রহণের চেয়ে প্রত্যাখ্যান কঠিন

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 19 Oct 2013, 01:28 PM
Updated : 19 Oct 2013, 01:28 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে যে প্রস্তাব রাখলেন তা এক কথায় স্বস্তিদায়ক। এখন বিরোধীদল এ প্রস্তাবের সবকিছু যদি গ্রহণ না-ও করে, তবু নেতারা একে সরাসরি প্রত্যাখান না করে নীতিগতভাবে এর মর্মকে মেনে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বাকিটুকু সমাধানের পথে এগুলেই দেশবাসী পুরো আশ্বস্ত হয়।

বিপর্যয়ের আগে
ঈদের ছুটির পরে বা সুনির্দিষ্টভাবে ২৫ অক্টোবর থেকে দেশে একটা ধুন্ধুমার রাজনৈতিক রক্তারক্তি লেগে যাবে বলে যে একটা আশঙ্কার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সে অবস্থায় ঈদ শেষে অফিস-আদালত খোলার আগেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেওয়ার সময় বেছে নেয়াটা খুবই ভাল হয়েছে। তিনি ঈদের পরে ভাষণ দেবেন বলে জানানো হয়েছিল। ঈদুল আযহার এক দিন আগে, গত ১৪ অক্টোবর বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা ১৮ দলের কর্মীদের ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে আসতে আওয়ামী লীগ বাধা দিলে তা প্রতিহত করার জন্য দা-কুড়াল-বল্লম-সড়কি সঙ্গে নিয়ে আসার বেআইনি আহ্বান জানিয়ে একটি উষ্কানিমূলক ভাষণ দেন। অনুমান করি, এ ঘটনা প্রধানমন্ত্রীকে দ্রুতই জাতির উদ্দেশে ভাষণটি দিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। নইলে রোববার অফিস খোলার পরেও প্রক্রিয়াটি হতে পারতো। জনাব খোকার ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তির ফলে জনমনের শঙ্কা বেড়ে যায়। ঈদের পর ঢাকায় ফেরার ব্যাপারে অনেক পরিবার দোটানায় পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে বিপুলভাবে সহায়ক।

আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপি ২৫ অক্টোবর সমাবেশের জন্য নয়া পল্টন দলীয় অফিসের সামনে বা পল্টন ময়দান বা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জায়গা চেয়ে পুলিশের কাছে চিঠি দেয় গত ১০ অক্টোবর। আওয়ামী লীগের ঢাকা নগর কমিটি ওই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দেয়। রাজধানীতে ভিন্ন জায়গায় দুটি দলের সমর্থকদের সমাবেশ বৈ তো কিছু নয়। কিন্তু এই দুটি খবর একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন দৈনিক লাল হরফে বড় বড় শিরোনাম দেয় 'রাজপথ দখলের চূড়ান্ত লড়াই', 'দুই দলের পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতি' ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, এক ধরণের উত্তেজনার সাংবাদিকতাও জনমনে শঙ্কা ছড়াতে ভূমিকা রাখছে। ২৪ অক্টোবর তারিখটিকে অহেতুক বিশেষরূপে চিহ্নিত করে উত্তেজনা সৃষ্টির উপলক্ষ করে তোলার পেছনে যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল তাতে মিডিয়া অসচেতনভাবে সহায়তা করেছে। তারিখটি সম্পর্কে জনগণকে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার দায়িত্ব মিডিয়া পালন করেনি। এই তারিখ সংসদ বা সরকারের শেষ দিনও নয়, এদিনে বিরোধী দলের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ারও কিছু নেই, এ দিন সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের সূচনামাত্র। সংসদ স্বাভাবিক মেয়াদ পূর্ণ করলে, অর্থাৎ আগে না ভেঙে না দেওয়া হলে, এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। ঈদের ছুটির মধ্যে উত্তেজনার আরেক দিক হলো খোকা সাহেবের 'দা-কুড়াল' নিয়ে লাগাতার লেখালেখি-টকশো। কে কার চেয়ে বেশি গরম বিশ্লেষণ দিয়ে ভীতি ছড়াতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা। কোনো কোনো ভবিষ্যদ্বক্তা কলামিস্ট বড় বড় দৈনিকে 'সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে' বলে দিব্যি দিয়ে মত প্রকাশ করে ফেলেন। এই সব দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি এসেছে।

তবুও প্রস্তাবটিকে 'সময়োচিত' বলে প্রশংসা করতে পারছি না। আরো আগে এ ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধীদলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সমঝোতায় আসার উদ্যোগ গ্রহণ উচিত ছিল। ২০১১ সালের মধ্যভাগে সংবিধান সংশোধন করার সময় থেকে গত প্রায় আড়াই বছর দ্বন্দ্বটি জিইয়ে রয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর পোস্ট করা 'ব্রিঙ্কম্যানশিপ বা লেজেগোবরে' শিরোনামে আমার লেখায় বলেছিলাম, বিলম্ব করে ও হুঙ্কার ছেড়ে পরিস্থিতিকে ঠেলে বিপর্যয়ের কিনারে নিয়ে যাওয়ার ব্রিঙ্কম্যানশিপ কৌশল অনুসরণ করছেন দুই নেত্রী। স্নায়ূযুদ্ধের যুগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন উদ্ভাবিত এই কৌশল অনুসরণে দুই নেত্রীই বিপদে পড়তে পারেন বলে হুশিয়ার করেছিলাম। প্রায় ভুলে যাওয়া ব্রিঙ্কম্যানশিপ শব্দটি আবার দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেণ্ট ওবামার স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত নতুন নীতি ঠেকাতে রিপাবলিকানরা সরকারের ঋণসীমার বাজেট অনুমোদন আটকে দিয়ে 'শাটডাউন' বা সরকারি অফিসে তালা ঝুলিয়ে কয়েক লক্ষ চাকরিজীবীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর যে নজিরবিহীন সংকট সৃষ্টি করেছিল সে-প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানদের সমঝোতায় ওবামার ওই সংকটের সাময়িক অবসান হয়েছে। কোনো সম্পর্ক না থাকলেও শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সমঝোতা প্রস্তাবের কাকতালীয় চিত্রটি বেশ উপভোগ্য লাগলো। স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত 'ওবামাকেয়ারের' বিরোধিতায় চরম পদক্ষেপ নিয়ে রিপাবলিকানরা জনসমর্থন পাননি, বরং তা হঠকারী বলে সমালোচিত হয়েছে। বীমা না থাকলেও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ রেখে করা ওবামার প্রস্তাবটি মধ্যবিত্তবান্ধব, আর রিপাবলিকানদের অবস্থান বৃহৎ ধনীদের পক্ষে। ওদেশে শাটডাউনের মতো এত বড় সংকটেও রাজপথ গরম হয়নি। বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল। পার্লামেন্টেই সমাধান হয়েছে। কয়েক লক্ষ সরকারী কর্মচারী আবার অফিসে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বিএনপি ইতিবাচক সাড়া দিলে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধটিরও সংসদে-সংলাপে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হতে পারে।

প্রস্তাবের যৌক্তিকতা
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সম্পর্কে শুক্রবার রাতে ও শনিবার দিনে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী মিডিয়ার কাছে মন্তব্য করেছেন। এঁদের বেশিরভাগ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে ইতিবাচক অভিহিত করে বিএনপির সাড়া দেওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব বিস্তারিত নয় এবং তা সমাধান আনবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর দল নেতৃত্ব পর্যায়ে আলোচনার পর শনিবার প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেছেন। বিএনপির প্রতিক্রিয়া না জেনেই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যালোচনা এই লেখায় তুলে ধরা হলো। বিএনপির অবস্থান জানার পর প্রয়োজনে আবার লেখা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, "আমরা সকল দলকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই। বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন সময়ে আমরা সকল দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।" তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন বিরোধী দলের সাংসদদের মধ্য থেকে নাম দিতে যাঁদের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মন্ত্রিসভায় সদস্য করে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যায়। তিনি সব সন্দেহ দূর করে সুষ্ঠু নির্বাচন করার কথা বলেছেন যাতে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের মনমতো সরকার গঠন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষা, "আমি বিরোধী দলের নেতাকে অনুরোধ করছি, তিনি এই ডাকে সাড়া দেবেন। আমার এ অনুরোধ তিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের যে সদিচ্ছা, সেই সদিচ্ছার তিনি মূল্য দেবেন।"

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায়শ ব্যবহৃত তীর্যক আক্রমণাত্মক মন্তব্যপূর্ণ তীব্র বাক্যবাণের বিপরীতে এই ভাষা এবং ভাষণ উপস্থাপনের নম্র ভঙ্গী রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার পরিচয়বহ। ভাষণটিকে আমরা তাঁর ভাবমূর্তি-সচেতন পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চাই। তিনি এই নীতি অব্যাহত রাখলে এবং বেগম খালেদা জিয়া সমপ্রতিদানের মনোভাব নিয়ে সাড়া দিলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত, বহুপ্রতিক্ষীত কার্যকর সংসদীয় সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে।
যেসব যুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বিএনপির ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত বলে মনে করি সেগুলো উল্লেখ করছি:
(১) প্রস্তাবটি সংবিধানের আওতায় সমাধানের সুযোগ তৈরি করেছে এবং নির্বাচনকালে যে সরকার থাকবে তার নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সংবিধান কাটাছেঁড়া না করাই ভাল।
(২) প্রস্তাবটি সরকারের তরফে বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সামিল হওয়ার মনোভাব দেখাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী (ক) সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় নির্ধারণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ পাঠানোর আগে বিরোধী দলের পরামর্শ নিতে চান; (খ) বিরোধী দলকে সংসদে এসে আবার মুলতবি প্রস্তাব দিয়ে হলেও তাঁরা কী চান তা সুস্পষ্টভাবে বলার আহ্বান জানান এবং সর্বোপরি (গ) নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। এই কার্যপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েই বিরোধী দল সংলাপের মাধ্যমে অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় নিষ্পত্তি করতে পারে, যা বিযুক্ত থেকে আন্দোলনের দ্বারা সম্ভব নয়। বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান 'আন্দোলন' নিষ্ফল নৈরাজ্যের অন্ধগলি।
(৩) প্রকৃতপক্ষে বিএনপি কী চায় তা আগে স্পষ্ট করেনি, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব তা স্পষ্ট করার শেষ সুযোগ দিচ্ছে। বিএনপি শুধু বলেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। কিন্তু সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আইনের দৃষ্টিতে অসম্ভব। কারণ তা আদালতে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল হয়েছে। পার্লামেন্ট কোনো সংবিধানবিরোধী আইন পাস করতে পারে না। সংবিধান একদিনের জন্যও অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে শাসনকাজ চালানো অনুমোদন করে না। সর্বোচ্চ আদালত যে আরও দুই দফা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যায় বলে পরামর্শ রেখেছিলেন সেটা করতে হলেও পার্লামেন্টকেই করতে হবে। শেখ হাসিনা যদি তখনই বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করে আদালতের রায়-পরবর্তী করণীয় স্থির করতেন তাহলে দেশে এখনকার সংকট সৃষ্টি হতো না। দুঃখজনক যে বিএনপি তখন সংসদ অধিবেশনে ও সংবিধান সংশোধনের পরামর্শসভাগুলোতে যায়নি এবং শেখ হাসিনাও একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে সংকট সৃষ্টি করেছেন। আবার শেখ হাসিনার বর্তমান প্রস্তাব সে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগও সৃষ্টি করেছে যা বিরোধী দল গ্রহণ করলেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হবে। বিএনপি যদি হঠকারিতা না করে তবে এই প্রস্তাব গ্রহণ তাদের জন্য প্রত্যাখানের চেয়ে সহজ পথ দেখাবে।

প্রস্তাবে যা নেই
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে কী কী নেই তা নিয়ে শুক্রবারই অনেকে কথা বলেছেন। যা আছে তার প্রতি সাড়া দিলে যা নেই তা পূরণ করা সম্ভব। প্রধানত প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে কি না– এই দুটো বিষয় অস্পষ্ট রয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভা একদলীয় হোক বা বহুদলীয় হোক, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ-সদস্যদের আস্থাভাজন একজন সাংসদ। বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব গ্রহণ করেও শর্ত দেয় যে, নির্বাচনকালে শেখ হাসিনাকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী চান না তবে সেটা পদ্ধতিগত প্রশ্ন থাকবে না, ব্যক্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ হবে। এটা খারাপ নজির হবে। কারণ শেখ হাসিনা স্বৈরশাসক নন, তিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আবার শুক্রবারের ভাষণে সংবিধানের অনুগত থাকলেও শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেননি যে তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কাজেই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেও এ বিষয়ে আলোচনা বা শর্ত আরোপ বা চাপ দেওয়ার সুযোগ আছে। দেশের ও নির্বাচনী ধারাবাহিকতা রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে শেখ হাসিনা সরেও দাঁড়াতে পারেন। তখন সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদকে একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি ঠিক করতে হবে– অবশ্যই সংসদ-সদস্যদের মধ্য থেকে। এটা শেখ হাসিনার জন্য মর্যাদাকর হবে এবং সমাধানকে সহজসাধ্য করবে।

নির্বাচনকালে কে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেবেন কি না, দিলে কখন, সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা কত জনের হবে, কোন্্ দলের কতজন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রধান মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব বণ্টন, নির্বাচন কমিশনের প্রকৃতই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন করে আচরণবিধি ঠিক করা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদরা সময় নষ্ট না করে এখনই বসে পড়তে পারেন যদি সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকে এবং বিরোধী দল প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে খোলামনে গ্রহণ করে।

একটি নির্দোষ কল্পনা
সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে অবশ্যই অংশগ্রহণকারী রাজনীতিবিদরা ঠিক করবেন, তবে গতকাল ভাষণটি শোনার পরপরই আমরা কয়েক বন্ধু উৎসুক নাগরিক হিসেবে টেলিফোনে পরস্পর আলোচনায় একটি ফর্মুলা কল্পনা করেছি। সেটি নিম্নরূপ:
(১) ওই স্বল্পকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য দেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ১১ জন হতে পারেন।
(২) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীগণ অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন না।
(৩) বর্তমান সাংসদদের মধ্য থেকে আওয়ামী লীগ ২০ জন, বিএনপি ২০ জন এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ৫ জনের তালিকা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে। রাষ্ট্রপতি দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে প্রধানমন্ত্রী ও ১০ জন মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন।
(৪) প্রধানমন্ত্রী ও আরও ৫ জন মন্ত্রী হবেন আওয়ামী লীগ থেকে, ৪ জন মন্ত্রী হবেন বিএনপি থেকে এবং একজন হবেন জাতীয় পার্টি থেকে। এতে হয়তো বর্তমান সংসদে দলীয় প্রতিনিধিত্বের আনুপাতিক বিচারে বিএনপির ভাগে কিছুটা বেশি পড়লো। তবে সারা দেশে প্রাপ্ত ভোট বা পপুলার ভোটের নিরীখে এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে উদারভাবে মেনে নিতে হবে সমাধানের স্বার্থে।
(৫) মূল মূল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকবে।
(৬) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকবে বিএনপির একজন মন্ত্রীর হাতে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জাতীয় পার্টির একজন মন্ত্রীর হাতে। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এই চারটি মন্ত্রণালয় এভাবে বণ্টন করে বাকিগুলোর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ভাগ করে দেবেন।

বলা বাহুল্য, নির্বাচনকালীন ক্ষুদ্র সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা বড় নীতিগত বিষয় ছাড়া শুধু দৈনন্দিন শাসনকাজ চালাবে। এট বলা যায় যে, এভাবে সর্বদলীয় সরকার গঠন করলে তা যেমন সংবিধান মোতাবেক হয় রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে, তেমনি বিএনপি যে কারণে ও যে ভূমিকা পালন করার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার চায়– এই সরকার চরিত্র ও কার্যকারিতার দিক থেকে সেই লক্ষ্য সাধন করারই উপযুক্ত হবে।

মোজাম্মেল হোসেন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।