এখন দরকার শুধু সাহসী মানুষ

আবেদ খান
Published : 13 Oct 2013, 12:25 PM
Updated : 13 Oct 2013, 12:25 PM

প্রায় প্রতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কানাডার টরন্টোতে যাই ছেলের কাছে। প্রভূত ধারকর্জ হয় বটে, কিন্তু একমাত্র সন্তানের জন্যে এই আনন্দময় বিলাসিতা আমরা করিই। এবার যেহেতু তাদের সংসারে 'স্বপ্ন' যুক্ত হয়েছে, তাই এবারকার টরন্টোগমন অধিকতর উত্তেজনাকর ও অনন্য– একথা আগেও লিখেছি।

আমার ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার দায় পাঠকের ওপর চাপাতে চাই না এটা সত্যি, কিন্তু করব কী, আবেগ যে রুখতে পারি না! পাঠক ক্ষমা করবেন।

এবার কানাডায় থাকার সময় কানাডারই কোনো এক সংবাদপত্রে পড়লাম এক মার্কিন কূটনীতিক গিয়েছেন লন্ডনের কোনো এক স্থানে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে। সেই মার্কিন দূত তারেক রহমানের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন এবার যদি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে কী হবে তার দলের কার্যক্রম!

মোটামুটি গোটা চারেক প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তর বেরিয়ে এসেছে সম্ভবত এ রকম। প্রথম, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবে কি না। উত্তর- না। দ্বিতীয়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিএনপি সুসম্পর্ক রাখবে কি না। উত্তর– হ্যাঁ। তৃতীয়, সুশাসন নিশ্চিত করবে কি না। উত্তর– হ্যাঁ। চতুর্থ, প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধমূলক কোনো কাজ করবে কি না। এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি।

জানি না মার্কিন দূত কথিত সাক্ষাৎকারে সন্তুষ্ট হয়েছেন কি না, কিংবা কতখানি হিসেব-নিকেশ করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়টি। তবে শেষ প্রশ্নটিতে উত্তরদাতার নীরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে আবার ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে বিএনপির ভবিষ্যৎ চরিত্র কেমন হতে পারে– তার একটা আভাস পাওয়া যায়। ওই একটি নিরুত্তর উত্তরই পূর্ববর্তী তিনটি প্রশ্নের সঠিক ও সত্য উত্তর।

প্রিয় পাঠক, এ কথা বলছি, কারণ প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের স্পৃহা জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতদের থাকবেই। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তথা মানবতাবিরোধীদের বিচার হবে, কঠোর দণ্ড হবে, আর জামায়াত-বিএনপি সুবোধ বালকের মতো আচরণ করবে তা কি কখনও কল্পনা করা যায়?

দ্বিতীয়ত, বাহ্যিকভাবে কিংবা একটি প্রভাবশালী দৈনিকের জরিপে বিএনপিকে ভোটের দিক থেকে যত জনপ্রিয় দেখানো হোক না কেন, বাস্তব চিত্রটি হচ্ছে বিএনপি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হয় জামায়াত দ্বারা। বিএনপির কোনো আন্দোলন, কোনো কর্মসূচি সফল হয় না সেখানে জামায়াতের ক্যাডার না থাকলে। জামায়াতের বিপুল অস্ত্র এবং অর্থভাণ্ডার বিএনপির চলার পথের পাথেয়।

জামায়াতকে সামলানোর কোনো ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে বিএনপির থাকবে না। কারণ কোনো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন যদি জঙ্গি কিংবা বৈদেশিক অর্থ ও অস্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়, তাহলে তাকে প্রেম দিয়ে বশীভূত করা যায় না।

তৃতীয়ত, বিএনপির প্রাণপ্রিয় সহযাত্রী জামায়াত এবং জঙ্গিবাদের লক্ষ্য হল উপমহাদেশকে চরম অস্থিরতার আবর্তে নিক্ষেপ করা। এ ক্ষেত্রে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। এজন্য উপমহাদেশের ধর্মান্ধ সংগঠনগুলো এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে তারা সখ্যতার সূত্রে গ্রথিত করেছে। বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে বিএনপি এই দর্শনের বিশ্বস্ত মিত্র।

অতএব বিএনপির স্বনির্বাচিত নেতা যতই বলুন না কেন যে, তার দল প্রতিবেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে তা কদাচ সম্ভব নয়। বিএনপি নেত্রীর বহুল আলোচিত ভারত সফরে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি এবং প্রত্যাবর্তনের পরপরই সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ, ভূমিকা এবং বাক্যবাণ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

চতুর্থত, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধপরায়ণতা যদি পরিপূর্ণভাবে বিরাজমান থাকে তাহলে সুশাসন কীভাবে নিশ্চিত হবে? অতএব অনিবার্যভাবে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হবেই।

কাজেই যে মার্কিন দূত বিশাল রাস্তা পাড়ি দিয়ে লন্ডনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে হাসিনা সরকারের বিকল্প খুঁজতে এক বিকৃত রাজনীতির দ্বারস্থ হয়েছেন, তাহলে তাকে এ কথা বলতেই হবে যে তিনি প্রবল ভ্রান্তিবিলাসিতায় নিমজ্জিত আছেন।

২.

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। একের পর এক ভুল কিংবা স্বার্থপরায়ণ নীতি তাকে বিশ্বদানবে পরিণত করেছে। সেই চল্লিশের দশকের শেষার্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতি তাকে ক্রমশ নিঃসঙ্গ ও শক্তিহীন করে তুলছে। যতই সে নিঃসঙ্গ হচ্ছে, ততই সে যুদ্ধবাজ হয়ে উঠছে। আবার যতই সে যুদ্ধবাজ হচ্ছে, ততই সে বিবিধ ভ্রান্তির জালের জড়িয়ে পড়ছে।

বারংবার সে ভুল মিত্রই অন্বেষণ করেছে। মরুভূমি যেমন সবুজ প্রান্তরের দিকে হাত বাড়াতে গেলেই সেই সবুজ প্রান্তরও মরুময় হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যেদিকেই হাত বাড়িয়েছে সেই দিকই ভস্মীভূত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ সর্বত্র তো একই চিত্র।

নিজের দেশে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হলেও অন্য দেশের গণতান্ত্রিক এবং মানবিক ব্যবস্থা তছনছ করে দিতে অপরিসীম দক্ষতা এই দেশটির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যে বন্ধু হিসেবে পেয়ে উল্লসিত হয়েছে, তাকেই ভোগ করতে হয়েছে মর্মান্তিক পরিণতি। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান– কোথায় নয়?

ইতিহাসের এই কথাটি তো সবাই জানেন। ভিয়েতনামের স্বৈরশাসক ছিলেন নগো দিন দিয়েম। আর তার ভ্রাতা নগো দিন নু ছিলেন মার্কিন আশ্রিত। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রাণ দিতে হল। পালিয়ে বাঁচলেন নগো দিন নুর স্ত্রী মাদাম নু। তিনি জাপানে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ''আমেরিকা যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার হয় না।''

এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে লাদেন আর আল কায়দা। পৃথিবীটাকে পরিণত করেছে সন্ত্রাসের চারণক্ষেত্রে। আবার সেই সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য তৈরি করেছে পাল্টা নতুন সন্ত্রাস। মার্কিন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে অস্ত্রব্যবসা। এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে না পারলে ধস নামবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে।

সেজন্যই চাই যুদ্ধ, চাই নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। সে জন্য মানুষ যদি মরে, মরুক। ঐতিহ্য, ইতিহাস, পুরাকীর্তি সব যদি ধ্বংস হয়, যদি লুঠ হয় ব্যাবিলন, যদি আক্রান্ত হয় পিরামিড-স্ফিংস, হোক। তবু যুদ্ধ চাই– চাই নতুন নতুন রণক্ষেত্র– চাই তৈলভাণ্ডার– চাই জওয়াহিরি-কারজাই– চাই গোলাম আজম-নিজামী-তারেক।

সে জন্যই লন্ডনের গোপন বৈঠক এত জরুরি!

৩.

একটা রব তুলে দেওয়া হয়েছে যে, ২৫ অক্টোবরের পর দেশে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে যাবে। মানুষকে কতখানি প্যানিকি করে দেওয়া যায়, তার অবিরাম চেষ্টা চলছে যেন। এখানে ওখানে চলছে চোরাগোপ্তা হামলা। আক্রান্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী। আক্রান্ত হচ্ছে প্রগতিশীল তরুণ। লাঞ্ছিত হচ্ছে ফতোয়াবাজ ধর্মান্ধদের বিপন্ন শিকার নারীসমাজ।

বিরোধী দলের নেত্রী হুমকি দিচ্ছেন দেশ অচল করে দেওয়ার। দাবি তুলেছেন মানবতাবিরোধী স্বাধীনতার শত্রুদের মুক্ত করার। নির্দ্বিধায় উচ্চারিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মন্ত্র। জিকির তোলা হচ্ছে গৃহযুদ্ধের।

তার মানে পরিষ্কার। প্রচারণার সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া। ব্যাপক মিথ্যাচার দিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া। মাসের পর মাস সংসদ বর্জন করে সংসদ নির্বাচনের জন্য হাস্যকর আন্দোলনের আবহ তৈরি করা। উগ্র ধর্মব্যবসায়ীদের উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে গণতন্ত্রের ময়দান লণ্ডভণ্ড করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করা।

কী হবে ২৫ অক্টোবর কিংবা তার পর? কিছুই হবে না। এতদিন যা হচ্ছিল, তাই-ই হবে। হরতাল, বোমাহামলা, গাড়ি পোড়ানো, মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে দেওয়া– এর বাইরে আর কী হতে পারে?

আর মানুষ যদি রাস্তায় নামেন– বোমাবাজদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গাড়ি বের করেন, দোকানপাট-হাটবাজার খোলা রাখেন, তাহলে তো কিছুই হবে না।

তাই এখন দরকার শুধু সাহসী মানুষের।

লেখক : সাংবাদিক, প্রকাশিতব্য দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদক