আলীম কিন্তু বয়স বিবেচনা করেনি

ইমরান এইচ সরকার
Published : 9 Oct 2013, 04:39 PM
Updated : 9 Oct 2013, 04:39 PM

একাত্তরে জয়পুরহাটের কাঁদিপুর গণহত্যা ও উত্তরহাট গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড আবদুল আলীমের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আলীমের বিরুদ্ধে মোট সতেরটি অভিযোগ গঠন করেছিল ট্রাইব্যুনাল। তার মধ্যে ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। বাকি পনেরটি অভিযোগের মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি হল গণহত্যার অভিযোগ।

বিশ্বব্যাপী গণহত্যাকে মানবজাতির বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যখন আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে দুটি গণহত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা হচ্ছিল যে আলীমকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হবে।

কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বয়স, বার্ধক্যজনিত শারীরিক সমস্যা এবং চলাফেরার অক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হল। তার মানে একজন গণহত্যাকারী সর্বোচ্চ শাস্তি না পেয়ে দয়াবশত আমৃত্যু কারাদণ্ড পেল। এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা মনে করি এই দণ্ডের মাধ্যমে শহীদ পরিবারের প্রতি, ভিকটিমদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

৯ অক্টোবর, ২০১৩ আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলার রায় ঘোষণা করা হল। অথচ এর প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে ১৯৭১ সালে। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে বার বার অতীতকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।

ফিরে যাই ১৯৭১ সালে। তখন জয়পুরহাটের ত্রাস ছিল আবদুল আলীম। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ যথার্থই বলেছে যে একাত্তরে জয়পুরহাটের অপরাধের 'কম্পাস' ছিল আলীম। একদিনের কথা। পাঁচবিবিতে কাঞ্জিলাল মোহন্ত নামের একজন বৃদ্ধকে নির্মমভাবে হত্যা করে আলীম এবং তার সহযোগীরা। এই কাঞ্জিলালের বয়স তখন ছিল বিরানব্বই কী তিরানব্বই।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৬৬৮ অনুচ্ছেদে আলীম কর্তৃক নব্বই-উর্ধ্ব ব্যক্তিকে হত্যা, এমনকি মানসিকভাবে অসুস্থ্ একজন ব্যক্তিকে হত্যার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কাঞ্জিলাল মোহন্তকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার বয়স ও শারীরিক অক্ষমতা বিবেচনায় আনেনি আলীম বা তার সহযোগীরা।

অথচ সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের সময় হত্যাকারীর বয়স ও শারীরিক অক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া হল! এর মাধ্যমে একজন ঘৃণিত গণহত্যাকারী লঘু শাস্তি পেল। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মানবাধিকার ব্যাপারটা কি কেবল অপরাধীর জন্যই? ভিকটিমদের জন্য কি মানবাধিকারের কোনো বিধানই নেই!

যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারীর সাজা কেমন হবে তার উদ্ধৃতি ট্রাইব্যুনালের রায় থেকেই দিতে চাই। আবদুল আলীমের মামলার রায়ের ৬৭০ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছেন–

The Tribunal notes that undeniably, the punishment must reflect both the calls for justice from the persons who have directly or indirectly been victims and sufferers of the crimes, as well as respond to the call from the nation as a whole to end impunity for massive human rights violations and crimes committed during the war of liberation 1971.

অর্থাৎ এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল একমত যে, সাজার মাধ্যমে অবশ্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতিত ও অপরাধের ফলে ক্ষতিগ্রস্তের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধ ও ব্যাপক মাত্রার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের মাধ্যমে কলঙ্ক মোচনের যে ডাক জাতির কাছ থেকে এসেছে তাতেও সাড়া দিতে হবে।

আবদুল আলীমের লঘু দণ্ডের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৬৭০ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা– সেই প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই তোলা রইল। আশা করছি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ব্যাপারটির মীমাংসা করতে পারবেন।

এখানে রায়ের ৬৭১ নম্বর অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করতে চাই। সেখানে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন–

The sentence to be imposed must reflect the inherent gravity of the accused's criminal conduct. Gravity of offences proved and mode of participation and degree of his culpability the convicted accused indisputably deserves the highest punishment, the sentence of death. The dreadful and systematic planned crimes committed by a high ranking and well educated perpetrator do not allow for a sentence other than capital punishment, we do not disagree.

অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল একমত যে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই আবদুল আলীমের প্রাপ্য। এমনকি ট্রাইব্যুনাল এ-ও বললেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। ৬৭২ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করলেন– আলীম মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছেন।

এত কিছু বলার পরেও, ৬৮১ অনুচ্ছেদে আবদুল আলীমের তিরাশি বছর বয়স ও চলাচলে শারীরিক অক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হল। ৬৮৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এর জন্য 'মিটিগেটিং সারকামস্টেনসেস'-এর প্রয়োগ করা হল। উল্লেখ করা হলে-–

Accused Md. Abdul Alim has been found guilty for his calculated brutal activities forming part of attack that resulted in death of hundreds of civilians. But the letters of law cannot be unkind in awarding sentence, ignoring his perceptible physical impairment.

ট্রাইব্যুনাল লেটার্স অব ল-এর কথা বলতে গিয়ে 'লেটার্স অব জাস্টিস' অগ্রাহ্য করলেন। যদিও ৬৮২ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, 'মিটিগেটিং সারকামস্টেনসেস'-এর প্রয়োগ কেবল দণ্ড কমায়, অপরাধ কমায় না।

ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, আলীমের রায়ের দণ্ড আমাদের সংক্ষুব্ধ করেছে। অপরাধীর প্রতি মানবাধিকারের প্রয়োগ ঘটিয়ে যদি লক্ষ লক্ষ ভিকটিমের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ব্যাহত করা হয় তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না।

আমরা এটাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই যে, ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতির দায়মোচনের যে ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে তা ট্রাইব্যুনালের আইনি কার্যক্রমের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে আমরা চাই, আলীমের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ দণ্ড চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করুক। সেখানে স্বাস্থ্যগত বিষয় নিয়ে শুনানি হোক। প্রয়োজনে আলীমের শারীরিক অক্ষমতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অভিমত গ্রহণ করা হোক, কেননা গ্রেফতারের আগেও আলীম পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। এমনকি যেসব 'মিটিগেটিং সারকামস্টেনসেস'-এর কথা বলা হচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় কিনা তাও শুনানির দাবি রাখে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আমাদের ন্যায়বিচারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। আশা করছি সেখান থেকে আমরা ন্যায়বিচার পাবে।

জয় আমাদের হবেই।

জয় বাংলা।

ডা. ইমরান এইচ সরকার :
মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ।