রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রজেক্ট বিষয়ক নিবন্ধ প্রসঙ্গে

তানভীর ইসলামতানভীর ইসলাম
Published : 9 Oct 2013, 06:28 AM
Updated : 9 Oct 2013, 06:28 AM

বিডিনিউজে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রজেক্ট নিয়ে পরিবেশ প্রকৌশলী ড. আঞ্জুমান ইসলামের পরপর দুটো লেখা পড়লাম। এ লেখাগুলোয় EIA রিপোর্ট এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাইট ও এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স বিষয়ে অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে বিধায় এ লেখার অবতারণা। ৮ অক্টোবরের লেখায় আঞ্জুমান ইসলাম EIA রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন–

"আসি EIA রিপোর্টের ব্যাপারে। সকল প্রকল্পের জন্যে যে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা (EIA) প্রয়োজন হয় তা নয়। কোনো একটা প্রজেক্ট যখন করা হবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন কী প্রকল্প, কী প্রযুক্তিতে করা হবে, কারিগরি মান কী হবে ইত্যাদির উপর নির্ভর করে স্থান নির্বাচনের জন্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।''

তিনি একটি বিষয় ঠিকই বলেছেন যে সকল প্রকল্পের জন্যে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা (EIA) প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্স অনুযায়ী চার ক্যাটাগরির প্রকল্প রয়েছে। এগুলো হলো– গ্রিন, অরেঞ্জ এ, অরেঞ্জ বি এবং রেড।

এর মধ্যে 'রেড' ছাড়া বাকি আর কোনো ক্যাটাগরির প্রকল্পের জন্য EIA করার প্রয়োজন হয় না। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রজেক্ট বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত ক্যাটাগরি অনুযায়ী একটি 'রেড' বা লাল-তালিকাভুক্ত প্রজেক্ট। কিন্তু এ ধরনের প্রজেক্টের EIA এবং সাইট ও এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স পাবার নিয়ম কী?

আঞ্জুমান ইসলাম লিখেছেন-

"প্রস্তাবিত কতিপয় স্থানের মধ্যে থেকে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইনিশিয়াল এনভায়রনমেন্টাল এক্সামিনেশন (IEE)-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো একটি জায়গার ব্যাপারে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়। ফারদার এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) প্রয়োজন কিনা আর যদি প্রয়োজন হয় তার TOR কী হবে এর ভিত্তিতে তখন EIA প্রস্তুত করা হয়।''

এর আগে ৬ অক্টোবরের লেখাতেও তিনি লিখেছিলেন-

"EIA স্টাডির প্রথম ধাপ হল IEE Study (Initial Environmental Examination), এই স্টাডি শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরে দাখিল করত Location/Site Clearance পাওয়া যায়।''

আঞ্জুমান ইসলামের এই বক্তব্য সত্য নয়। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল মোহম্মদ আবদুস সোবহান তার "Sharing Experiences of EIA in Bangladesh" ডকুমেন্টে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরিভুক্ত প্রকল্পের জন্য সাইট এবং এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স পাবার নিয়মাবলী উল্লেখ করেছেন।

http://www.aecen.org/sites/default/files/workshop/june2010/presentations/EIAPracticeBangladeshFinal.pdf

পরিবেশ অধিদপ্তরের এই নিয়ম অনুযায়ী 'রেড' বা লাল তালিকাভুক্ত প্রকল্পের জন্য সাইট ক্লিয়ারেন্স পাবার ধাপগুলো হল–

RED
The App should enclose

• Feasibility Study report,
• IEE & EIA report
• EMP (for existing ind.)
• An NOC
• Pollution minimization plan
• Outline of relocation plan
• Obtain Site Clearance
• Apply for Env. Clearance
• Obtain Environmental Clearance

অর্থাৎ পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী রেড ক্যাটাগরিভুক্ত প্রজেক্টের সাইট ক্লিয়ারেন্সের জন্য IEE এবং EIA দুটোই এপ্লিকেশনের সঙ্গে জমা দিতে হবে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রজেক্টের জন্য যা করা হয়নি। এখানে শুধুমাত্র IEE স্টাডি করেই সাইট ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়েছে (যা অরেঞ্জ বি ক্যাটাগরি প্রজেক্টের জন্য করা হয়) এবং প্রজেক্ট শুরু করার পর ২০১৩ সালে EIA রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে যা যথাযথ প্রক্রিয়া নয়।

আঞ্জুমান ইসলাম তার লেখায় আরও বলেছেন–

"… রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তাতে কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে আমার মনে হয়নি…"

কিন্তু আসলেই কি তাই? পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেল আবদুস সোবহান সাহেব তার সেই একই ডকুমেন্টে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) এর ১২ তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন–

Clause 12 of Environment Conservation Act, 1995: No industrial unit or project shall be established or undertaken without obtaining, in the manner prescribed by rules, an Environmental Clearance Certificate from the Director General.

লক্ষ্য করুন আইনে বলা আছে– "obtaining, in the manner prescribed by rules an Environmental Clearance Certificate" এবং তা ব্যতিরেকে কোনো প্রজেক্ট "establish" অথবা "undertake" করা যাবে না।

আমরা দেখেছি যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেল তার ডকুমেন্টে রেড ক্যাটাগরি প্রজেক্টের জন্য যে 'prescribed by rules' এর কথা উল্লেখ করেছেন– তা রামপাল প্রজেক্টের সাইট ক্লিয়ারেন্স পাবার জন্য অনুসরণ করা হয়নি– এখানে EIA রিপোর্ট ছাড়াই সাইট ক্লিয়ারেন্স দিয়ে প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে।

আইনে আরও বলা আছে যে– 'এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট' বা 'পরিবেশ ছাড়পত্র' ছাড়া কোনো প্রজেক্টও আরম্ভ করা যাবে না। অথচ রামপাল প্রজেক্টের পরিবেশ ছাড়পত্র মাত্র কিছুদিন আগে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকেই জমি অধিগ্রহণ, চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রজেক্ট শুরু করে দেওয়া হয়েছে।

আঞ্জুমান ইসলাম কি এরপরও বলবেন যে এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি?

কল্লোল মোস্তফা ও আরও অনেকে নানা লেখায় EIA রিপোর্টের নানা দিক সম্পর্কে বলেছেন এবং আরও বলেছেন যে এখানে মানদণ্ড যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি– সুন্দরবনকে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' (residential and rural) এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে যেটা EIA রিপোর্টেই উল্লেখ করা আছে (রামপাল ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৭৮)। অন্যদিকে আঞ্জুমান ইসলাম বলেছেন, এ রকম কোনো ক্লাসিফিকেশনই নাকি নেই!

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী যেখানে EIA রিপোর্ট আগে জমা দিয়ে তা বিবেচনা করে সাইটের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা, সেখানে সিদ্ধান্ত আগে গ্রহণ করে যদি পরবর্তীতে EIA করা হয় এবং তাও যদি আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, তবে সে রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক নয় কি?

ড. তানভীর ইসলাম : নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহকারী অধ্যাপক, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।