রায় হয়েছে রয়ে গেছে আশঙ্কা

মুশতারি শফি
Published : 2 Oct 2013, 11:57 AM
Updated : 2 Oct 2013, 11:57 AM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এতে আমি অত্যন্ত খুশি। আমি আন্তরিকভাবে খুশি, কারণ এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণহত্যাসহ নানা নির্যাতন চালিয়ে চট্টগ্রামের সব মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।

১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল আমার স্বামী ও ভাইকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। এরপর যখন তখন শহরের এনায়েত বাজারে এই বাড়িতে আর্মি হানা দিত। তারপর আমি ভারতে চলে গেলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরলাম। নিজের বাড়িতে এলাম। দেখি সমস্ত বাড়ি খা খা করছে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড। আমাকে দেখে কয়েকজন প্রতিবেশি আমার বাড়িতে আসেন। তাদের মুখে শুনলাম চট্টগ্রামে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার পরিবারের নৃশংসতার কথা।

ভারতে থাকাকালীন সময়েও শুনতে পেয়েছিলাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার ভাই গিয়াস কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। তারা যাকে তাকে ধরে নিয়ে যেত।

চট্টগ্রামে ফেরার পর জানতে পারি আমার বাড়ি আলবদর বাহিনী দখল করে নিয়েছিল। এই বাড়িতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মাঝে মাঝে আসত। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে এখানে রাখত। নির্যাতন করত আর পরে তাদের বাড়ি গুডস হিলে নিয়ে যেত। পরে জেনেছি একাত্তরে অনেককে মেরে ফেলেছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর নূতন চন্দ্র সিংহ অত্যন্ত দয়ালু ও ভালো মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অত্যন্ত নির্মমভাবে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা করেন। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। চট্টগ্রামে আরও অনেককে সে নির্যাতন করেছিল। এক পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পালিয়ে যায়।

বাংলাদেশে ঘাতকদের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করি। রাজাকারদের বিচারের জন্য রাজপথে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি আমরা। সরকারকেও আবেদন জানাই। কিন্তু কিছুই হয়নি।

অবশেষে বর্তমান সরকারের আমলে একে একে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়। প্রত্যেকের বিচার শুরু হয়। সব রাজাকারের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।

অনেক পথ পেরিয়ে আজ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় হয়েছে। সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলাম কখন রায় হবে। রায়ে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু যতদিন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হবে ততদিন শান্তি পাব না। রায় কার্যকর দেখে যেতে চাই। আশা করি সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর হবে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ভীষণ অহমিকাপূর্ণ একজন মানুষ। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও সে অনেক বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বলেছে। সে কয়েকবার সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছে। সে ক্ষমতায় গেছে কিন্তু কোনোদিন মানুষের কোনো উপকার করেনি।

স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর এ রায় পেলাম। তবে যারা বিচার চেয়েছিলেন তাদের অনেকে এ রায় দেখে যেতে পারলেন না। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ আজ মনেপ্রাণে খুশি হয়েছে। তাদের খুশিতে আমি নিজেও প্রাণ পাচ্ছি।

দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের পর এ রায় বেশ অনেকটাই অর্জন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার সঙ্গে নির্যাতনের সঙ্গে যেসব রাজাকার-আলবদর জড়িত তাদের সবার বিচার হওয়া উচিত।

আশাবাদের পাশাপাশি আশঙ্কাও আছে। তাই পরিপূর্ণ শান্তি পাচ্ছি না। রায় কার্যকর না হলে ভীষণ খারাপ হবে। শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদকালে যদি বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা ও কার্যকর না হয় তবে কী হবে জানি না। আশঙ্কা থেকে যায় বিএনপি বা অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে দেশের অবস্থা খুব খারাপ হতে পারে।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্ত তাদের মনে দেশপ্রেম আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারেই কেউ কেউ না কেউ শহীদ হয়েছেন। তাই তরুণ প্রজন্ম আজ হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছে। গণজাগরণে তারুণ্যের জয়যাত্রা দেখে আমি খুব আনন্দিত। সব রাজাকারের বিচার শেষ হলেই তরুণরা শান্ত হবে।

তারপর তরুণরা সুন্দরভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বেগম মুশতারি শফি : শহীদজায়া ও চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি।