সর্প ‘দর্শন’

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 28 Sept 2013, 05:32 AM
Updated : 28 Sept 2013, 05:32 AM

শোনা গেল মীর মশাররফ হোসেন হলে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। যে সে সাপ নয়, বিষধর গোখরা। মনে পড়ল মাস দুই আগের কথা। ফুটফুটে জোৎস্না জাহাঙ্গীরনগরের চারদিক প্লাবিত করেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে জোৎস্না দেখতে বেরিয়েছি যখন, তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে।

ট্রান্সপোর্টের (ছাত্রছাত্রীদের আড্ডার একটি প্রিয় জায়গা) ওখানটায় কয়েকজন ছাত্র দেখে এগিয়ে যাই। তারা ভেবেছে, এত রাতে তাদের হলের বাইরে থাকা আমি নিশ্চয়ই পছন্দ করিনি। এখন বকা খেতে হবে। কাছে গিয়ে সংকোচে জড়োসড় ওদের বললাম, কী সুন্দর জোৎস্না পড়েছে। মুহূর্তেই চাঁদের আলোয় তাদের উজ্জ্বল মুখ দেখলাম।

ওরা শেষ বর্ষের ছাত্র। ক্যাম্পাস যে সুন্দর হয়ে গেছে সংস্কার করা লেক, জলাশয় ও গাছগাছালিতে– সে কথা উচ্ছ্বসিতভাবে বলছিল ওরা। অবাক হলাম সাপের কথা শুনে। বলল, বছর পাঁচেক আগে যখন তারা প্রথম এসেছে এই ক্যাম্পাসে, তখনও রাত-বিরাতে পথ চলতে কিছু সাপ দেখা যেত। বছর যত গেল, সাপের দেখা তেমন মিলল না।

কারণও বলল তারা। শীতে শুকনো বনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া; বন, নিচু ক্ষেত, লেক বাণিজ্যিক কারণে লিজ দেওয়া; নির্দয়ভাবে 'আগাছা' নিধন করা; কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার– এসব কারণে সাপসহ অন্যান্য বন্য প্রজাতি আর তেমন দেখা যায় না। তবে এখন তারা মাঝে-মধ্যে সাপ দেখে, প্রহরে প্রহরে শেয়ালের ডাক শোনে।

বলল, ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি ফিরিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি, তাতে যেমন পাখিরা ফিরে এসেছে, তেমনি দেখা মিলছে সাপসহ অন্যসব প্রজাতির। ওদের এইসব পর্যবেক্ষণ শুনে অপার আনন্দ পেয়েছি। গত শীতের শুকনো মৌসুমে প্রথামাফিক বনের আগাছা কেটে পরিষ্কার করবার কাজটি আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

এর জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় আশি হাজার টাকাও আমরা সাশ্রয় করেছিলাম। শীতমৌসুমে আগুন দিয়ে বন পরিষ্কার করার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া এবং আগাছা না কাটার পদক্ষেপ গ্রহণের সুফল আমরা এই বর্ষামৌসুমে পেয়েছি। ঘন সবুজ গাছ-গাছালি, লতা-গুল্মে ভরে গেছে ক্যাম্পাস।

যাই হোক, মীর মশাররফ হোসেন হলের সাপের উপদ্রবের কথায় ফিরে আসি। হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কৃতি শিক্ষক ও গবেষক মোহাম্মদ আবদুল আজিজের ফোন পেয়ে তা জানতে পারি। পরদিন খুব ভোরে তার হলে যাই। তিনি জানালেন কোবরার একটি বিশেষ প্রজাতি (Binocellate Cobra/Spectacled Cobra) বাচ্চা ফুটিয়েছে হলে। ছড়িয়ে পড়েছে লনে, বারান্দায়, সর্বত্র। ছাত্ররা আতঙ্কিত। এ অবস্থায় তারা চৌদ্দটি কোবরার বাচ্চা মেরেছেন।

শুনে খুব কষ্ট পেলাম। কাউকে তো কামড়ায়নি এরা। সাপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণির উপর আজিজের গবেষণা উঁচুমানের। তিনি জানালেন, যদিও এসব বাচ্চা সাপের চোখও ফোটেনি, বিষদাঁত হয়নি, তারপর এরা যেহেতু বিষধর, প্রাণঘাতী এবং ছাত্রদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাপ নিধনের কাজটি তাকে করতে হয়েছে। একজন প্রাণিবিজ্ঞানী হিসেবে নয়, হলের প্রভোস্ট হিসেবে।

আজিজ জানালেন, সাপুড়ে এনে আন্ডাবাচ্চাসহ গোখরা সাপটিকে ধরার উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তার কাছ থেকে জানলাম, সাপ প্রজননের জন্য উষ্ণ জায়গা বেছে নেয়। পরিত্যক্ত বসতবাড়ি কিংবা পুরাতন বাসাবাড়ির ফাঁকফোকর, পরিত্যক্ত ম্যানহোল বা ইঁদুরের গর্তে এরা ডিম পাড়ে। সম্ভবত তাই বিষধর এই কোবরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন হলগুলোর অন্যতম এই হলকে প্রজননের জন্য বেছে নিয়েছিল।

প্রথিতযশা স্থপতি মজহারুল ইসলামের নকশায় লাল ইটের দৃষ্টিনন্দন অমসৃণ দেয়ালের হলটির তিনদিকে বন, জলাশয় ও লতা-গুল্মের ঘন আবরণ। সাপের প্রজননের জন্য হলটিকে বেছে নেওয়ার তাও একটি কারণ। প্রভোস্ট জানালেন, দানাদার কার্বলিক এসিড বোতলে পুরে নানা জায়গায় রাখা হয়েছে। সাপ আর দেখা যাচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আর যেসব সাপ দেখা যায়, তাদের সম্পর্কে বলি। আজিজ জানিয়েছেন সেসব তথ্য। সরীসৃপের মধ্যে সাপ একটি বৃহৎ দল। এই গোত্রে আরও আছে গুইসাপ (Bengal Monitor, Varanus bengalensis)।

মনে পড়ল গত শীতের এক দুপুরের কথা। উপাচার্য অফিস থেকে গাড়িতে বাসভবনের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ নজরে পড়ল, সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় লালরঙের বাসটি দাঁড়িয়ে আছে। বাসভর্তি ছাত্রছাত্রীরা গভীর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখছে সামনে। এতবড় গুইসাপ আগে আমি দেখিনি। চার পায়ে মাথা উঁচু করে রাস্তার মাঝখানে সে বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাসটিকে নিশ্চল করে। আমাদের গাড়িও দাঁড়ানো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেরাম্যান আনিস সাহেব ছিলেন গাড়িতে। তাকে নেমে ছবি তুলতে বললাম। জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে একটি গুইসাপ বড় একটি বাস থামিয়ে রেখেছে– এমন একটি ছবি কী অসাধারণই না হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ক্যাম্পাসবাসীর সচেতনতার উঁচুমানের পরিচয় মিলবে এই একটি ছবিতে। বেশি ভালো ছবি তুলতে গিয়ে আনিস সাহেব বেশি সময় নিয়ে ফেললেন। রাজসিক গুইসাপ ধীরলয়ে পাশের লেকের কচুরিপানার দিকে চলে গেল। ছবিতে শুধু গুইসাপ আর বাসের নাম্বার প্লেটটি পাওয়া গেল।

কথ্যভাষায় 'গুইল' হিসেবে পরিচিত এই প্রাণির ভিন্ন একটি নাম শুনলাম আমাদের প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক আফসার আহমদের কাছ থেকে। নাটক ও নাট্যতত্ত্বের এই শিক্ষক বললেন, মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডিমঙ্গল কাব্যে এই প্রাণিকে 'গোধিকা' বলা হয়েছে। কিছু দেবত্বও আরোপ করা হয়েছে গোধিকার উপর। প্রাণিকূলকে সুরক্ষা দেন দেবী।

চণ্ডি কাব্যে দেখা যায়, ব্যাধ কালকেতু 'স্বর্ণগোধিকা' ধরেছে পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য। কিন্তু দেবী স্বয়ং গোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন ব্যাধের হাত থেকে এই নিরীহ প্রাণিকে রক্ষা করতে। ছোটবেলায় শোনা আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের ছড়া, "গুইল মারে না ভালা মাইনষে, গুইল মারে গুলাম জাতে" — নিশ্চয়ই মঙ্গলকাব্যে বিধৃত বিপন্ন প্রাণিকুলকে রক্ষার মতো আরও একটি লোকজ প্রয়াস।

প্রভোস্ট আজিজ জানালেন, প্রায় দেখা যায় এমন গুইসাপ (Bengal Monitor, Varanus bengalensis) এই দেশের ৩ প্রজাতির গুইসাপের অন্যতম। বনাঞ্চলে তাদের তেমন দেখা না মিললেও মানুষের বসতির আশেপাশে ক্ষেত-খামারে, ছোট ছোট ঝোপজঙ্গলে এরা থাকতে পছন্দ করে। আমাদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ফেলা খাবারের উচ্ছিষ্ট ও বর্জ্যস্থানে এদের বিচরণ দেখা যায়। ওইসব খাদ্যবর্জ্য এদের প্রধান আহার। সাপ ও পাখির ডিম চুরিতেও এরা পারদর্শী।

উপাচার্য ভবনের লনেও এরা আসে। মুরগির ছোট বাচ্চাও ধরে নেয়। আমাদের ক্যাম্পাসে উঁইপোকার ডিম ও লার্ভা গুইসাপের প্রিয় খাবার। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থাপনার আশেপাশে, জলাশয়ের পাড়ে, আগাছার ভিড়ে, সুয়্যারেজ ড্রেন বা গর্তে এরা ঘর করে থাকে।

গত বছরের (২০১২) ডিসেম্বর মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরুর পর ক্যাম্পাসে ছড়ানো-ছিটানো বর্জ্য ও হল এবং আবাসিক ভবন থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন খাদ্যবর্জ্য সংগ্রহ করে ক্যাম্পাসের বিশমাইল এলাকায় বায়োগ্যাস প্লান্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জাইকা ও গ্রামীণ শক্তির সহযোগিতায় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খবির উদ্দীন-এর তত্ত্বাবধানে প্লান্টটি তৈরি হয়েছে।

শুনেছি, খাদ্যবর্জ্য এভাবে নিয়ে যাওয়াতে গুইসাপের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ভাবলাম একদিকে ক্যাম্পাসকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন– এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন যেমন জরুরি, তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষার দিক বিবেচনা করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বিত পরিকল্পনা আমাদের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুইসাপের জন্যও খাদ্যবর্জ্য রাখতে হবে।

গুইসাপ থেকে সাপের কথায় আবার আসি। আজিজ জানালেন, আমাদের ক্যাম্পাসে যেসব প্রজাতির সাপ দেখা যায়, তাদের মধ্যে ঢোঁড়া সাপ (Checkered keelback), পাইন্যা সাপ (Common smooth water snake), ঘরগিন্নি সাপ (Common wolf snake) ও দারাজ (চলতি কথায় আমরা দাড়াশ বলি) সাপ (Rat snake) অন্যতম।

প্রথম দুটি প্রজাতির সাপকে বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে এমনকি বাসাবাড়ির সিঁড়িতেও উঠতে দেখা যায়। এরা মূলত পানিবাসী। পরের দুটো প্রজাতির বাস ডাঙায়। দারাজ সাপ মাঠে-ঘাটে ইঁদুর শিকার করে বেড়ায়। তাই বড় উপকারী সাপ এরা। আর ঘরগিন্নি বাসাবাড়ির কার্নিশে, জানালা ও বিল্ডিংয়ের ফাঁক-ফোকরে টিকটিকি ও তাদের ডিম খেতে চলে আসে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিল্ডিংয়ের বাইরের দেয়াল অমসৃণ খোলা ইটের হওয়ায় সহজেই সাপ দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, বর্ণিত চার ধরনের সাপ সবাই নির্বিষ। সাপের দংশনে 'নীলবিষে' অবশ হয়েছে কারও অঙ্গ, অথবা হয়েছে মৃত্যু, এমনটা আমাদের ক্যাম্পাসে শোনা যায় না। নির্বিষ সাপের মধ্যে হঠাৎ মীর মশাররফ হোসেন হলে বিষধর গোখরার আবির্ভাবে তাই সবার মধ্যে এত আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।

সাপ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা বিষয়ে যখন লিখছি তখন বাংলাদেশের বিপন্ন সাপ নিয়ে একটি অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ নজরে পড়ল। সিলেটের লাউয়াছড়ায় প্রতিমাসে গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ টি সাপ মারা পড়ে বনের মধ্য দিয়ে চলা পাকা সড়কে গাড়ির চাকার নিচে।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির সভাপতি অনিমেষ ঘোষ বলেন, "শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়ি বাগানের মানুষ আগে সাপ দেখলেই মেরে ফেলতো। কিন্তু তারা এখন সচেতন হওয়ায় সাপ দেখলে গবেষক সিজার ভাই অথবা তার টিমকে জানায়"।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণির সুরক্ষার জন্য একটি অভয়ারণ্য আছে। ভোরে প্রাতঃভ্রমণের সময় অনেকবার সেখানে গিয়েছি। পরিচয় হয়েছে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এমফিল গবেষক সুলতান আহমেদের সঙ্গে। অবাক হয়ে শুনি, এই বিজন বনে যে গবেষণা ঘরটি আছে, সেখানেই সে থাকে। রাতের বেলায়ও।

আরও অবাক করা কথা সে বলল। সাপকে তার ভয় লাগে না। সাপরাও তাকে ভয় পায় না। উষ্ণ বিছানায় তার পাশেই হয়তো পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে সাপেরা। প্রকৃতির সাপকে নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

আতঙ্ক আছে আমাদের সমাজে লুকিয়ে থাকা দু'পেয়ে বিষধর সব সাপদের থেকে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন : উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।