হাজার জনের লক্ষ আকাশ

মারুফ রায়হান
Published : 24 August 2010, 01:38 PM
Updated : 24 August 2010, 01:38 PM

১৯ আগস্ট, রোজার নবম দিন, শুক্রবার দেশের প্রধান সব কয়টি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় বিশেষ গুরুত্ব পায় অপরাধ ও শাস্তি, বা বলা ভালো কারাগারকেন্দ্রিক তিনটি খবর। একটি কাগজ থেকে তিনটি শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। এক. কোকোর প্যারোল বাতিল। দুই. আদালত অবমাননার দায়ে মাহমুদুর রহমানের ছয় মাস জেল, জরিমানা। তিন. মুক্তির স্বাদ পেলেন এক হাজার বন্দি। সে যাই হোক, কোকো ও মাহমুদুর রহমান বিশিষ্ট জন। তাদের কথা নয়। আজকের এই লেখায় সাধারণ কয়েদিদের হঠাৎ পাওয়া মুক্তির প্রসঙ্গটিই প্রধান।

কারাগারে স্বজনহীন আবদ্ধ পরিবেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগেই মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার যে কী শান্তি, তা আমাদের শতভাগ অনুমেয় নয়। জেলবাস না হোক, যিনি কখনো পুলিশের হাতে আটক হয়ে কয়েক ঘণ্টা হাজতবাসও করেন নি, তার পক্ষে অন্তরীণ হওয়া কিংবা বন্দিত্ব থেকে মুক্তির অনুভূতিটি উপলব্ধি করা কীভাবে সম্ভব? এ এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। ঢাকার রাজপথে প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে আসামী বহনকারী দরোজা-জানালাহীন গাড়ি। তবে তাতে লোহার শিক-জড়ানো এক চিলতে ভেন্টিলেটর থাকে। ওই অপরিসর ফাঁক গলিয়ে বন্দিরা বাইরের পৃথিবীর আলোবাতাস নেন গোগ্রাসে। ওই গাড়িতে ওঠার দুর্ভাগ্য (নাকি সৌভাগ্য!) যার হয়নি তিনি কী করে আঁচ করবেন মুক্ত পৃথিবীর ভেতর দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে চলমান এক বন্দিযাত্রীর মানসিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া!

কারাগারে গিয়ে সোনা পুড়ে শুদ্ধ হয়ে, নতুন উপলব্ধি আর জীবনবোধ নিয়ে প্রকৃত মানব হয়ে ফিরে আসার সুযোগ কয়জনের জীবনে মেলে? কিছুকাল একা, একান্ত দর্পণের সম্মুখে থাকাটা লেখক ও দার্শনিকদের জন্যে উপকারী বলেও বিবেচিত হতে পারে। তাই কারাবাস কারু কারু জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ হলেও হতে পারে। তবে বিলক্ষণ যাবজ্জীবন কারাবাস নয়! জানেনই তো, বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ৩০ বছর, অবশ্য ১২ মাসের বদলে ৯ মাস হিসেবে বছর গণনা করা হয় ওই সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা 'শোধনালয়ে'।

কালজয়ী রুশ কথাশিল্পী ফিওদর দস্তয়েভস্কি বহু বাঙালি পাঠকের প্রিয় লেখক। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট নামে তার একটি উপন্যাস ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। উপন্যাসের নায়ক রাসকোলনিকভকে বলা হয়েছিল, 'রাস্তার তেমাথায় চলে যাও, মানুষের কাছে মাথা নত করো, চুমো খাও জমিনকে, কারণ ওর বিরুদ্ধেও পাপ করেছ তুমি, তারপর জোর গলায় সারা দুনিয়াকে শুনিয়ে বলো, আমি একজন খুনি।' এই উপন্যাসটি অনেকের কাছেই ভালো লেগেছে এর প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। এই উপন্যাসে ঢুকলে আমরা অজানা অচেনা কোন জগতে পৌঁছাই না, বরং তৎকালীন রাশিয়ার প্রেক্ষাপটেই দেখতে পাওয়া সম্ভব আশির দশকের বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থাটি।

এ উপন্যাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দারিদ্র-পিষ্ট সমস্যা জর্জরিত এক যুবককে নিয়ে। সে তার এবং তার চারপাশের মানুষের জীবনের দুর্দশা দেখে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আর যুবকের মাঝে থাকে কিছুটা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স। সে নিজেকে ভাবতে শুরু করে সমাজ উদ্ধারের পথিকৃতের ভূমিকায়। আর সেই তাড়না থেকে সে খুন করে সম্ভাবনাহীন জীবনযাপন করা এক পুঁজিপতি বৃদ্ধাকে। পুলিশের চোখকে সে ফাঁকি দিতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরে শুরু হয় তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এসময় তার বন্ধু রাজুমিখিন ঢুকে পড়ে উপন্যাসে তার সমর্থনদাতা উপকারী বন্ধু হিসাবে। উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো জেরাকারী পুলিশের সাথে রাস্কলনিকভের মানসিক যুদ্ধ। যে যুদ্ধে জিতে গিয়েও সে তার নিজের অপরাধবোধের কাছে হেরে যায়।

সত্যি অপরাধবোধ, অপরাধপ্রবণতা আর অপরাধ সংঘটিত করে ফেলা এক পাল্লায় মাপা হয় না। কেউ কারু মৃত্যুকামনা করতে পারে, কিন্তু সত্যি সত্যি তাকে মেরে না ফেললে আইন ও কারাগার তাকে স্পর্শ করে না! এক যোগে দেশের ৬১টি কারাগার থেকে ১০০০ জনের মুক্তির ঘটনায় ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসটির কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাবে। অপরাধ না করেও পরিস্থিতির ফেরে পড়ে অনেকের শাস্তি হয়, অনেকে খুন করেও দিব্যি শ্রীঘরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে! একসঙ্গে হাজার জনের লক্ষ আকাশের সম্ভাবনায় তাই আপনা থেকেই মন ভালো হয়ে যায়।

এমন ঘটনা এদেশে প্রথম। তবে কারাবিধিতে বন্দিদের অনুকূল একটি রীতি কিন্তু বহাল রয়েছে। কারা বিধির ১ম খণ্ডে ৫৬৯ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের রেয়াতসহ ২০ বছর সাজা ভোগের পর মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘকাল যাবত স্থবির হয়ে পড়েছিলো। বর্তমান সরকারের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই ওই বিধির আওতায় হাজার বন্দির মুক্তিলাভ। ৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে কারা ভোগকারী বৃদ্ধ, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ এক হাজার বন্দিকে মুক্তি দেয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। দ্রুততম সময়ের ভেতর ওই নির্দেশ পালনের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। বন্দিমুক্তির এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে কারাগারগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দি মুক্তি পাবে। মানবিকতার বাইরে এর একটি ভিন্ন দিকও রয়েছে। বর্তমানে দেশের ৬৭টি কারাগারে (একটি মহিলা কারাগারসহ) ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিনগুণেরও বেশি বন্দি অবস্থান করছেন৷ এতে বন্দিদের আবাসন সমস্যাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

আইজি প্রিজন বলেন, মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে নিরপরাধরাই বেশী। অনেকে আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারার কারণে নির্দোষ হয়েও জেল খেটেছেন। জানা গেছে, মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ ভাগেরই বিয়ের বয়স নেই। এদের কারো বয়সই ৫০-৬০ বছরের কম হবে না। অনেকেই পাননি দাম্পত্য জীবনের স্বাদ। অনেকে বিয়ে করেই ঢুকেছিলেন কারাগারে। পরে জেনেছেন স্ত্রী অন্যকে বিয়ে করে চলে গেছে। অনেকের পরিবার পথে বসেছে। জামিন করানোর সুযোগ না থাকায় ধুঁকে ধুঁকে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ২০টিরও বেশী বছর। কেউ কেউ সাংবাদিকদের জানান, বিনা বিচারে তারা দীর্ঘদিন ধরে জেল খেটেছেন। আইনি মারপ্যাঁচেও আটকে গেছেন অনেকে। আদালত সাজা দিয়েছে যাবজ্জীবন। অনেককে ফাঁসিয়ে দিয়েছে প্রভাবশালীরা। আইনজীবী নিয়োগ করার সামর্থ্যও ছিল না অনেকের।

কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে খুব বেশি তথ্য নেই। মহিলা কারাগারের জন্য বরাদ্দকৃত স্পেসটি ফাঁকাই আছে। তাই এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে একটু বেগই পেতে হয়। একটু মজাই লেগেছে যখন জানতে পারি গাজীপুরের কাশিমপুরে দুটি কারাগারের পাশে নতুন মহিলা কারাগারের ভবন দুটির নাম রাখা হয়েছে 'নাইটকুইন'। ৮ একর জমির ওপর নির্মিত এ কারাগারের ভেতরে অসুস্থ বন্দিদের জন্য একটি হাসপাতাল এবং নারী বন্দিদের সঙ্গে থাকা শিশুদের জন্য একটি আধুনিক ডে কেয়ার সেন্টারও নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, এখনকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থানটিতে এক সময় ছিল মোঘল নওয়াব সুবেদার ইব্রাহিম খাঁর নির্মিত কেল্লা। এ কেল্লার মধ্যে ছিল মহল, বিচারালয়, টাকশাল। ঐতিহাসিকদের মতে পাঠান রাজত্বকালে অর্থাৎ ১৫৪৫ সালে শের শাহের আমলে এখানে প্রথম কেল্লা তৈরি করা হয়েছিল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট সুইলটন আসার পর এখান থেকে নায়েব-এ নাজিমকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আজকে কারাগারে থাকা বন্দিরা ভাবতেও পারে না যে, এখানে ছিল শাহী মহল, প্রমোদখানা। ঢাকা জেলখানার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিলো একসময়ে বাদশাহী বাজার, আজকের জমজমাট চকবাজার। ১৬২০ সালে সেনাধ্যক্ষ মানসিংহের আমলে এর পত্তন। আঠার শতকের গোড়ার দিকে (১৭৬৫ খ্রি. পরবর্তী কোম্পানী আমলে) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১০ টি ওয়ার্ড ছিল এবং পরে ৫০০-৫৫০ বন্দী অবস্থান করত। ১৭৮৮ সালে ১টি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারের কাজ শুরূ হয়েছিল। সে সময়ে একজন বন্দির জন্য খাদ্যদ্রব্যের দৈনিক বরাদ্দ ছিল দু'পয়সা যা ১৭৯০ সালে বেড়ে হয় ১ আনা। বেঙ্গল জেল কোডে যে কয়টি কারাগারের নাম রয়েছে তার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অন্যতম। প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে এবং বন্দি সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার জানা-অজানা নানা ঘটনার সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

'রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ' এমন চমৎকার মূলমন্ত্র ধারণ করে আছে দেশের কারাব্যবস্থা। বিধিতে সুস্পষ্টভাবে লেখাও রয়েছে, "কারাগারে বন্দিরা রেডিও শোনা, টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাবেন। কারা লাইব্রেরীতে বই পড়া ও পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগ রয়েছে। কারাগারে বন্দিরা ক্যারামবোর্ড, লুডু, দাবাসহ ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা ও শরীর চর্চার সুযোগও পাবেন।" বাস্তবে বন্দিদের কতটুকু প্রাপ্তি ঘটে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। মনে রাখছি মুক্ত কয়েদিদের কেউ কেউ জেলখানাকে দোজখ বলেও অভিহিত করেছেন।

সে যাই হোক, সম্প্রতি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্র হলো সদ্য জেলমুক্ত প্রৌঢ় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধা জননীর স্নেহচুম্বন। মায়ের চেয়ে কে আছে আপন এই বিরূপ বিশ্বে? ওমর আলীর ভাগ্য ভালো, তিনি মমতাময়ী মাকে পেয়েছেন। নেত্রকোনার চকপাড়ার জহুরা খাতুন মেয়ে কলি আক্তারকে নিয়ে কারা ফটকের সামনে অপেক্ষা করছিলেন ভাই আবদুল মজিদের (৩৮) জন্য। মুক্তি পাওয়ার পর মজিদকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন জহুরা ও কলি। কিন্তু টাঙ্গাইলের মধুপুরের বারেক মোল্লার মতো কারামুক্ত বহুজনের জন্যেই জেলগেটে কেউ অপেক্ষাতুর ছিলেন না। অনেকেই স্বজনদের সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হবেন; অনেকের স্বজনই আবার মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

নিজেকে একজন শোধরানো মানুষ হিসেবে দাবি করে ৩৬ বছর সাজাপ্রাপ্ত ওমর আলী বলেন 'এতগুলো বছর কারাগারে থাকার পর, কেউ আর কোন অন্যায় করতে পারে আমার তা বিশ্বাস হয় না।' সত্যি বলতে কি, মানব সভ্যতায় কারাগারের উৎপত্তিই পাপাচার সংশোধনের দৃষ্টিকোণ থেকে। কালে কালে তা প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারস্বরূপ হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত হাজারজনের প্রত্যেকেরই জীবন অন্ধকারে কেটে গেছে কমপক্ষে এক কুড়ি বছর। বাকি দিনগুলো অর্থপূর্ণভাবে কাটুক এটাই প্রথমত আমাদের চাওয়া হতে পারে। তবে এদের অধিকাংশেরই অর্থনৈতিক সহায়তা দরকার। মুক্তির আনন্দের ঢেউ কি আমাদের একটুখানি হলেও ছুঁয়ে যাচ্ছে না? তাই এ লেখা লিখতে লিখতে ভাবছি, বিত্তবান ব্যক্তি না হোক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কি এদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন না?