সুন্দরবনে অসুন্দর রামপাল

আহমেদ মুনীরুদ্দিন তপু
Published : 8 April 2011, 07:19 AM
Updated : 25 Sept 2013, 05:13 PM

কবি সের্গেই ইয়েসেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়া-কাঁপানো বিপ্লবের উষায় কেবল তারুণ্যে পা-রাখা ওই কবির কথা আমলে নেয়নি রাষ্ট্র। প্রকৃতির বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে ভবিষ্যত মানুষ আর পৃথিবীকে বাঁচাতে চাওয়া মানুষটি প্রথমে দেশান্তরী হন, পরে আত্মহত্যা করেন। কবি আত্মহননের পথ বেছে নেন। কিন্তু দেশে-দেশে রাষ্ট্র এখনও খুনি!

আমরা ভুলে যাই, কিন্তু একজন কবি তার স্বভাবসুলভ পরোক্ষ ভঙ্গিতে রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয় তার কর্তব্য সম্পর্কে । কবি হচ্ছেন সমাজের সেই এন্টেনা যেখানে মানবজাতির বিপদ ও সম্ভাবনাগুলো আগাম প্রতিফলিত হতে থাকে। ইয়েসেনিন সেই নজিরের একজন । বাংলা ভাষায়ও এমন নজির আছেন। যেমন জীবনানন্দ দাশ। বাংলার প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশের পাশাপাশি 'রূপসী বাংলা'র অনাগত বিপদগুলো সম্পর্কেও তিনি আগে থেকেই বলেছিলেন অনেক কথা । যখন আমাদের একমাত্র এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন বিপন্ন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সকল আয়োজন সম্পন্ন– যখন রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হচ্ছে– তখন বাংলাদেশে তো বটেই, সারা দুনিয়াতেই এমন কবিদের চিন্তা প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক।

ফলে এখন আমাদের মনে পড়তে পারে এই বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। ইয়েসেনিন আত্মহত্যা করেছিলেন, জীবনানন্দর জীবন গিয়েছিল অপঘাতে। না কি জ্বালানির দোহাই দিয়ে আণবিক দূষণের বিষবাষ্পে মানুষকে বিকলাঙ্গ করে এমন প্রাণ-প্রকৃতি, নদী-বন উজাড় করা উন্নয়নের 'আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে' 'এইসব দিনরাত্রি' কাটাতে চাননি বলেই জীবনানন্দের মনে হয়েছিল– `এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো!'

কবির চিন্তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গুরুত্ব পায় কি না জানি না, তবে কবি রাষ্ট্র নিয়ে ভাবেন। ইয়েসেনিন সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন, রুশ বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য নতুন রাষ্ট্রের আঙিনায় এসেই তার মনে হয়েছিল এজন্য তিনি যুদ্ধ করেননি। তরুণ কবির হাতে হয়তো সময় ছিল না সম্ভাবনার জন্য অপেক্ষা করার! ১৯২৫ সালে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

আরও পরে রুশ বিপ্লবের নেতা রাষ্ট্রচিন্তাবিদ লেনিন লিখছেন, "সম্ভাবনার যথাযথ উপলব্ধিই স্বাধীনতা।"

ইয়েসেনিনও নেই, লেনিনও নেই। কিন্তু ভলগায়-গঙ্গায় গড়ানো এত জলে এমন স্বাধীনতা কোথায় যেখানে আমরা সম্ভাবনার যথাযথ উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পেরেছি!

এ মাটির পুত্র-কন্যারাও যুগে যুগে অনেক সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু সেই 'খোয়াবনামা' কি হারিয়ে গেছে? নইলে চার দশক আগে 'সোনার বাংলা' স্বাধীন করে, রাষ্ট্র বানিয়েও আমরা এখন পর্যন্ত কেন নিজেদের কোনো রাষ্ট্রচিন্তা হাজির করতে পারছি না!

অথচ সভ্যতায়-সংস্কৃতিতে আমাদের বহু শতাব্দীর সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার আছে। নিজ সংস্কৃতির জন্য, নিজ ভাষার জন্য লড়াই করে জীবন দিয়ে আমরা স্বাধিকারের আন্দোলনে নেমেছি, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন করেছি। এ বীরত্বের স্বীকৃতি দিতে গোটা দুনিয়া এখন একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' পালন করছে। কিন্তু এ গৌরব ম্লান আমাদের ইতিহাসবিমুখতায়, অপরিণামদর্শী বর্তমানে, অনিশ্চিত ভবিষ্যত যাত্রায়।

'সোনার বাংলা'র কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন– ''জন্তুর জন্মস্থান থাকে, মানুষের থাকে দেশ; তবে সেই দেশ সৃজন করতে হয়।''

মনোভূমিতে এই দেশ সৃজন করতে পারলে কি জগদীশের দেশের লোক হয়ে আমরা সুন্দরবন বিপন্ন করতে পারতাম! সারাদেশে নির্বিচারে বন উজাড় করতে পারতাম! যে জগদীশ চন্দ্র বসু সারা দুনিয়াকে জানিয়েছিলেন, বুঝিয়েছিলেন যে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে! শিল্পী সুলতানের 'প্রথম বৃক্ষরোপণ' বা শক্তিমান কৃষাণ-কৃষাণীর ছবি উপলব্ধি করলে কী করে আমরা এতটা আত্মঘাতী হই।

আমরা কি ভুলে গেছি খনার কথা, শোলক বেঁধে বেঁধে যিনি প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পর্কের কথা বলতেন। স্পষ্টবাদিতা আর সত্যভাষণের অপরাধে যে নারীর জিভ কেটে নিয়েছিল শাসকরা! লালনের মানবতাবাদ আর খনার প্রজ্ঞায় সাহসে উত্তরাধিকার দাবি করলে তো আমাদের আজ নজরুলের মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠবার কথা।

শুনছি সামনের মাসের দুই তারিখে পাবনার রূপপুরে রাশিয়ার কারিগরি সহায়তায় প্রস্তাবিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানি না ওই ফলক স্থাপনের সময় প্রয়াত মুস্তফা আনোয়ারের কথা প্রধানমন্ত্রীর মনে পড়বে কি না। বিশ্বে পারমাণবিক বিপর্যয় দেখে যে কবি জাতিকে সতর্ক করে বলেছিলেন, "আণবিক চুল্লিতে ভাজা হবে তোমার শরীর…''

মুস্তফা আনোয়ার শুধুই কবি ছিলেন না, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা এই কবি চাননি তার রাষ্ট্র ভুল পথে হাঁটুক।

হায় কবিগণ! হায় ইতিহাসের কাকতাল! মরেও তোমাদের রেহাই নেই। ইয়েসেনিন, তুমি জানলে না তোমার ভাই জীবনানন্দের রূপসী বাংলার রূপের পুরে আণবিক চুল্লি জ্বালাতে আসছে তোমারই দেশ রাশিয়া!

"এখনই মরে যাওয়াটা নতুন কিছু নয়/বেঁচে থাকাটাই বা নতুনতর কী!" লিখে রেখে তোমরা অনায়াসে মরে যেতে পার ইয়েসেনিন। আবার মহাকালকে মহাজীবনে মেলাবে বলে আবারও জন্মাতেও পার। তাই "একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া উঠে দাঁড়ালো/একটা পাখভাঙা পাখি উড়াল দিলো…কবি, হে কবি! তুমি দেখেছো কি/এমনই তো ছিলো এমনই তো ছিলো সকালের শুরুটা" বলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মানুষকে নতুন সকালের গল্প বলেন তোমার আরেক ভাই কফিল আহমেদ।

দেড় দশক ধরে যে কবি-সঙ্গীতশিল্পী গাইছেন, "সুন্দরবন জুড়ে কাঁটাতার দিলে/চিড়িয়াখানার শিশু বানর কাঁদে মা হরিণি কাঁদে/হরিণি কাঁদে মা বন্দিনী কাঁদে"।

কিংবা "দেখলাম মধুপুরে চোখের নিকটে/ কয়টা হরিণ বান্ধা আছে কাঁটাতার ঘেরা বনে/ হনুমান ঝুলে আছে পাতাটাতা খুঁেজ বনে/ পাতাটাতা নাই বনে হনুমান মরে জ্বরে…হরিণেরে ছেড়ে দাও চোখদুটো খুলে দাও…"

প্রাণ ও প্রকৃতি বিপন্ন করা রাষ্ট্র মানুষকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে সে প্রশ্ন হাজির করেই কি কফিল আহমেদ লিখছেন, "বন তন্ন তন্ন করে বাঘের গা থেকে চামড়া খুলে এনেছে যে মাওয়ালী/তারও প্রেরণার জানোয়ার আজকের পুঁজি…"

কবির এ প্রশ্ন শুধু 'বনভূমি'র নয়, 'মনোভূমি'র। আজ তা 'সুন্দরবন' আর 'রূপপুর' নাম নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। শুধুই নির্বাচনী রাজনীতির সংকট সমাধান নয়. এ সংকটও আমাদেরই মোকাবেলা করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া আগামী দিনে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব।

অন্যদিকে, 'সুন্দরবন-রূপপুর' আমাদের এক নতুন পথ দেখাচ্ছে। মনোভূমির লড়াই, ভাষার লড়াইয়ে জিতে আমরা বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে 'একুশে'র ইতিহাস গড়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি আর সেখানকার প্রাণবৈচিত্র্য জাগিয়ে রাখার লড়াইয়ে জিতলে, সারা দেশে সেই চেতনা বিকশিত করতে পারলে তা হয়তো একদিন দুনিয়ার প্রাণ-প্রকৃতির লড়াইয়ে আরেকটা 'একুশ' হয়ে থাকবে।

নদী যে দেশের মা, যে 'রূপসী বাংলা'র মানুষ গ্রামের নাম রাখে 'রূপপুর', চাঁদের কপালে চাঁদটিপের মতো বনের নাম রাখে 'সুন্দর' বন, যেখানে পশু'র জন্যও নদী আছে– সেদেশের মানুষ নিশ্চয়ই বন-নদী সবই অমানুষের জবরদখলে উজাড় করে দেবে না।