আত্মপ্রচারের ঝোঁক

মোহীত উল আলম
Published : 21 August 2010, 03:50 PM
Updated : 21 August 2010, 03:50 PM

বর্তমান যুগটা মিডিয়া টেকনোলজির যুগ। সেজন্য আত্মপ্রচারের ব্যবস্থাদি আগের চেয়ে অনেক সহজলভ্য হয়েছে। যেমন পত্রিকায় লেখা বের হলেই কিছু কিছু শুভার্থীকে আমি এস এম এস করে জানাই। এ জন্য যে না বললে তো ওরা জানবে না। অনেকে অবশ্য এতে বিরক্তও হোন, সেটা বুঝতে পারি। আমার এক বন্ধূ, তিনিও লেখেন। তিনি আবার এস এম এস করেন না, সবাইকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে ইমেইল করে জানিয়ে দেন লেখা প্রকাশের সংবাদ। আরেকজন বন্ধু আছেন, তিনিও লেখেন, কিন্তু তিনি কাউকে এস এম এসও দেন না, ইমেইলও দেন না। বলেন, যারা জানার তারা নিজেদের আগ্রহ থেকে জানবে। কথাটা সত্য। একটি পত্রিকা প'ড়ে প্রিন্ট আর অনলাইন মিলে কয়েক লক্ষ পাঠক, সেখানে আপনি বিশ থেকে একশ জনকে হয়ত এস এম এস বা ইমেইল করে জানালেন। তা'তে কী হয়। আসল পাঠক তো তারাই যাদেরকে আপনি চেনেন না।

যা হোক, আত্মপ্রচার বিষয় হিসেবে আলোচনা করতে সহজ মনে হলেও, আসলে মোটেও সহজ নয়। কারণ বিষয়টি একটি সার্বিক আচরণ–সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং জৈবিক। কোনখান দিয়ে শুরু করবেন, কোনখান দিয়ে শেষ করবেন! সবচেয়ে কঠিন হলো এমন একটি বিষয় সম্পর্কে আপনি হয়ত লিখতে চাইছেন, যেখানে আপনি হয়ত জড়িত ছিলেন, আপনার হয়ত সামান্য ভূমিকাও ছিল, কিন্তু বিষয়টি মোটেও আপনাকে নিয়ে নয়। তখন সে বিষয়ে আলাপ করতে গেলে আপনার ভূমিকাটির কথা না বললেই নয়, অথচ বললে মনে হবে যেন আপনি আত্মপ্রশংসা বা আত্মপ্রচার করছেন। কখন ঘটনার নিরপেক্ষ বর্ণনা আত্মপ্রচারের অংশ হয়ে যাচ্ছে, এ সীমা রেখাটা বুঝতে পারা আসলে বেশ কঠিন।

একটা উদাহরণ দিলে পাঠক বুঝতে পারবেন আত্মপ্রচারের সংবেদনশীল দিকটা কী। ১৫ই আগস্ট গেল বঙ্গবন্ধুর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। সব পত্রিকায় নানা লেখা তাঁর ওপর এসেছে। প্রধানত বিশ্লেষণাত্মক, আবার কিছু স্মৃতিচারণমুলক। একটি লেখা পড়লাম ১৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু সমাবর্তন শেষে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে সিঙ্গারা দিয়ে চা খাবার কথা ছিল তার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ। তখন উপাচার্য ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. আবদুল মতিন। আর স্মৃতিচারণটি করেছেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক রাজিয়া। লেখাটি খুব আবেগময়। আমাকে ষ্পর্শ করেছিল। তো এ প্রসঙ্গে আমার এক প্রবীণ সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ তুললে তিনি বললেন, ঐ বঙ্গবন্ধুর সিঙ্গারা দিয়ে চা খাবার কথা ছিল সে গল্পটাতো! আমি 'হ্যাঁ' উত্তর দিলে তিনি বললেন, ভদ্রমহিলা ঐ ঘটনাকে ক্যাপিটেলাইজ করছেন।

এ কথা শুনে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। কারণ একই দিন অন্য একটি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ওপর আমারও একটা লেখা বের হয়েছে, এবং আমিও প্রসঙ্গক্রমে বর্ণনা করেছি কীভাবে জীবনে বঙ্গবন্ধুকে দু'বার সামনাসামনি দেখার আমার সুযোগ হয়। এখন যারা সত্য বর্ণনাকে ভালোবাসেন, তারা বুঝবেন যে আমি মোটেও বঙ্গবন্ধু-দর্শনকে পুঁজি করতে চাই নি, বরঞ্চ বলতে চেয়েছি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব আমাকে যুবক বয়সে কীরকম আকর্ষণ করেছিল সে কথা। কিন্তু যারা যে কোন কিছুর পেছনে একটা উদ্দেশ্য খোঁজেন (এবং আমি মনে করি সেটাই স্বাভাবিক), সে বঙ্কিম মনের পাঠকেরা নিশ্চয় ভাববেন লেখাটাতে আমি নিজেকে জাহির করার সুযোগ নিয়েছি (যা খানিকটা সত্যও বটে)।

তাই আত্মপ্রচারের ঝোঁক নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে সামগ্রিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে আমি জটিল পথে না যেয়ে সহজ কিছু সেলিব্রিটি-ব্যক্তিত্বের কথা উঠিয়ে আলোচনাটা শেষ করব।

বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল গ্রন্থে কবি জীবনানন্দ দাশের ওপর যে অবিস্মরণীয় রচনাটি আছে সেটি পড়লে বোঝা যায় জীবনানন্দ দাশ খুব লাজুকতো ছিলেনই, ছিলেন প্রচারবিমুখও। আর বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীর আমার যৌবন খন্ডে আছে একবার বহু চেষ্টা করে বুদ্ধদেব বসুরা জীবনানন্দ দাশকে যখন একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, সেদিন জীবনানন্দ দাশ কবিতা পড়ার সময় ঘরবাড়ি কেঁপে উঠেছিল। তারপর দিন তাঁরা জানতে পারেন ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠার কারণ। বিহারের ভাগলপুরে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছিল। সাল ১৯৩২।

কিন্তু প্রকৃতি, পশুপাখির জগত ও মানবসমাজের বিধান দেখলে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ সাধারণ রীতির বিপক্ষে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে নাম-গন্ধহীন ফুল দেয়ালের গাত্রে ফুটেছিল সেটি যেমন নিজেকে জাহির করার জন্য ফুটেছিল, তেমনি কীট-পতঙ্গ থেকে শুরু করে পশু পাখিরাও বিভিন্ন কায়দায় নিজেদের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে বলে বিজ্ঞানের ধারণা। জীব-জগতের ওপর বিজ্ঞানের বিভিন্ন চ্যানেলে ছবি দেখে বুঝতে পারি এদের এ অস্তিত্ব প্রকাশের প্রধান উৎস জৈবিক।

যৌনমিলনের জন্য পরষ্পরকে আকর্ষণ করার জন্য এরা বিভিন্নভাবে নিজেদের প্রকাশ করে। একবার ব্যাঙের ওপর একটা ছবিতে দেখেছিলাম যে এক প্রজাতির পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙকে আকর্ষণ করার জন্য এমন লাল করে গলাটা ফুলিয়ে রাখে যে ঐ লাল বেলুন দেখে স্ত্রী ব্যাঙ আকর্ষিত না হয়ে পারে না।

মানুষের চক্রেও পুরুষ নারীকে আর নারী পুরুষকে আকর্ষণ করার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করে থাকে। প্লুটার্কের ইতিহাসে এবং শেক্সপিয়ারের এ্যান্টনি এ্যান্ড ক্লিওপেট্রা নাটকে আছে যেদিন এ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে সিডনাস নদীর পাড়ে দেখা করতে যাবেন সেদিন তিনি সকাল থেকে বিশ বার ক্ষৌরকারকে আহ্বান করেছিলেন তাঁর কেশবিন্যাস, শ্মশ্রু এবং গুম্ফযুগলকে মানানসই করে যুবকের চাহনি দিতে। কারণ এ্যান্টনির বয়স তখন ছিল ৪৮। মিশরের রানি ক্লিওপেট্রাও কম যান না, তাঁর বয়সও তখন ৩৮ হলেও তিনি অপূর্ব ছলাকলার জন্য সুবিদিত ছিলেন। এবং যে প্রেমপোতে চড়ে সিডনাস নদী বেয়ে এ্যান্টনির কাছে তিনি আসলেন তার এক অপূর্ব বর্ণনায় শেক্সপিয়ার বলছেন জাহাজটি থেকে এত সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল যে আশেপাশের বায়ু তাতে উন্মাতাল হয়ে জাহাজটিকে ছেঁকে ধরেছিল।

মুঘল-ই-আযম ছবির নির্মানের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি সাক্ষাৎকারে দিলীপ কুমারের স্ত্রী সায়রা বানু জানিয়েছেন যে সবাই যখন শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকত তখন সায়রা বানু হাই হিল পরে কমলা রঙের একটি কামিজ গায়ে দিলীপ কুমারের সামনে ঘুরঘুর করতেন তাঁর দৃষ্টি কাড়ার জন্য। সে সময় থেকে ছয় বছর লাগে (১৯৬০-৬৬) সায়রা বানুর দিলীপ কুমারকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে।

গডফাদার-খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা সম্পর্কে এ গল্পটি পড়েছিলাম রিডার্স ডাইজেস্টের একটি সংখ্যায় "ইট হ্যাপেন্ড ইন রিয়েল লাইফ" বিভাগে। এক নব দম্পতি বিয়ে করে নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখলো একটু নির্জনে একটি বেঞ্চির ওপর মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তারা তাদের ক্যামেরা দিয়ে ভদ্রলোককে খুব অনুরোধ করলেন একটি ছবি তুলে দিতে। ভদ্রলোক রাজি হলেন না। নব-দম্পতিও নাছোড়বান্দা, তারা ভদ্রলোককে খুব সাধাসাধি করতে লাগল। ভদ্রলোক শেষে না পেরে বললেন যে তিনি ক্যামেরা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানেন না। তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যাবার সময় নবদম্পতিকে ভ্রমণকারী আরেকটা লোক বলল, যে লোকটিকে তারা ছবি তুলতে অনুরোধ করছিলেন তিনি আর কেউ নন কিন্তু ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা।

মফিজন-খ্যাত লেখক মাহবুব উল আলম ষাটের দশকের মধ্যভাগে সাহিত্যকীর্তির জন্য বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পান। তো একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে সহ অন্য যাঁরা পুরষ্কার পেয়েছেন তাঁদেরকে মেডেল দেওয়া হবে। মাহবুব উল আলম ছিলেন খুবই সময়ানুগ। তিনি ঠিক চারটার সময় অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালেন। দেখলেন যে কোন লোকজন নেই, কেবলমাত্র অতিথিদের জন্য চেয়ার পাতা হচ্ছে। তিনি এগিয়ে সামনের সারির একটা চেয়ারে বসতে গেলে জনৈক কর্মকর্তা বাধা দিলেন। বললেন, এ সারিতে শুধু যাঁরা পুরষ্কার পেয়েছেন তাঁরা বসবেন। তখন সাধাসিধা পোশাকের মাহবুবকে বলতে হলো: আমি যে পুরষ্কার পাই নি সেটি আপনি নিশ্চিত হলেন কীভাবে!

২০০৭ সালে কলম্বিয়ার জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল কলম্বিয়ার কার্তাহেনা শহরে। মার্কেজের তখন ৭৯ বছর বয়স। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন স্পেনের রাজা এবং কলম্বিয়ার চারজন সাবেক রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যখন বিল ক্লিনটনের আগমন বার্তা ঘোষিত হলো তখন পুরো হলের লোকজন উঠে দাঁড়ালো তাঁকে করতালি দিয়ে সম্মানিত করতে। অথচ ক্লিনটন তখন আর প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। লেখকদের চেয়ে রাজনীতিকেরা যে বেশি প্রচার পান, এটি তার প্রমাণ।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে একবার সাধু মনে করে একজন মাদ্রাজি ছাত্র তাঁকে একটা আধুলি ভিক্ষে দিয়েছিলেন। তিনি সেটা মৌনভাবে গ্রহণও করেছিলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছে ঘটনাটার মধ্যে যে হাস্যরসের আলামত লুকানো ছিল সেটা দৃষ্টি এড়ায় নি।

মার্কেজের কথা ওপরে বললাম। মার্কেজ বিরাট ভক্ত ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। তো ১৯৫৭ সালে প্যারিসে একবার তিনি হেমিংওয়েকে দেখলেন রাস্তার অপর পাড়ে একটা জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। এর আগে আলাপ তো দূরে থাক, হেমিংওয়েকে তিনি কখনও দেখেন নি পর্যন্ত। কিন্তু যানজটের জন্য রাস্তা পার হওয়া দুরূহ ছিল। আবার কিছু না করলে হেমিংওয়ে হয়ত অদৃশ্য হয়ে যাবেন। হেমিংওয়ের পরনে ছিল কাউ বয় প্যান্ট, একটা স্কটিশ প্লেইড শার্ট, আর মাথায় একটা গলফ ক্যাপ। আর কোন উপায় না দেখে মার্কেজ মুখের ওপর দু'হাত গোল করে চিৎকার দিলেন, 'ম্যা . . ই. . . স্ত্রো'। অর্থাৎ, গুরু। ডাকটা শুনে অত জটলার মধ্যেও হেমিংওয়ে ফিরে তাকালেন। কারণ, তিনি জানতেন যে একমাত্র তাঁকেই কেউ ম্যাইস্ত্রো হিসেবে ডাকতে পারে।

সেলিব্রিটিদের এ আত্মসচেনতা অবশ্য আত্মপ্রচারের অংশ নয়।

এ মার্কেজ অবশ্য ১৯৮২ সালে তাঁর নোবেল প্রাইজ গ্রহণের সময় সবাইকে চমকে দিয়ে কালো বুট এবং লিকি লিকি স্যুট (মোটা কাপড়ের তৈরি সস্তা কাপড়) পরে গেছিলেন যাতে অনেকগুলো বামপন্থী শ্লোগান লেখা ছিল। অথচ তিনি এ পোশাক সাধারণভাবে কখনও পরেন নি। এটা অবশ্য আত্মপ্রচারের অংশ নয়।