অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল

আনোয়ার আকাশ
Published : 8 Sept 2013, 03:23 PM
Updated : 8 Sept 2013, 03:23 PM

অস্ট্রেলিয়াজুড়ে নির্বাচনের আসর বসেছিল ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ড, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, সাউথ অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি ও নর্দান টেরিটরি– এ আট অঙ্গরাজ্য বা আট ভাগে দেশটার প্রশাসনিক কাঠামো বিভক্ত। তাই একই দিনে আটটি অঙ্গরাজ্যে চলেছে ভোটগ্রহণ। ভোটের মাধ্যমে নাগরিককূল নির্বাচন করেছেন সংসদ প্রতিনিধিদের।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে, সারাদেশের কোথাও কোনো ভোটবাণিজ্য, কারচুপি বা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেনি, যদিও নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন লেবার দল ও অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনের পুরো কাজ সম্পন্ন করেছেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে নাগরিকদের আলাদা ছুটি মঞ্জুরের দরকার হয়নি। আগেই বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা অবধি ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। এছাড়াও অসংখ্য মোবাইন ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয় মানুষের সুবিধার জন্য।

নির্বাচন কমিশন আটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন মানুষকে কেন্দ্রমুখী করতে। অসুস্থতা বা অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যারা ভোট দিতে যাননি তাদের নামে জবারদিহিতার নোট যাবে। সেখান উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারলে জরিমানা গুণতে হবে ২০ ডলার থেকে ১৭০ ডলার। তবে কোনো প্রার্থীকেই সঙ্গত মনে না করে বা ধর্মীয় কারণে যারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন তাদের আগেই আবেদন করতে হয়েছে। নির্বাচনি আইনের ১৯১২ ধারার ৪১ উপধারাতে এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া দেশটি মুলত একটি দ্বীপ-মহাদেশ এবং এটিই ছিল ব্রিটিশ কয়েদিদের নির্বাসনস্থল। ১৭৮৮ সালে এ উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বস্তুত স্বাধীন অস্ট্রেলিয়ার গোড়াপত্তন হয় ১৯০১ সালে। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের ১০ ও ১৩ ধারা অনুযায়ী ১৯০২ সালে এদেশে প্রথম দেশজুড়ে নির্বাচন প্রথা চালু হয়।

এবারের নির্বাচনের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ক্ষমতাসীন লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড এবং বিরোধী দলের নেতা লিবারেল দলের টনি অ্যাবট। শনিবার দিনশেষে মাত্র এক ঘন্টারও কম সময়ে ফলাফল পৌঁছে যায় নির্বাচনি বার্তাকক্ষে। নির্বাচন কমিশন্ও যথাসময়ের আগেই দেশবাসীকে খবরটি জানিয়ে দেন। টালিকক্ষ থেকে প্রাপ্ত শেষ খবরে দেখা যায়, টনি অ্যাবটের লিবারেল দল ৮৮ আসন পেয়েছে। নতুন সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ৭৬ আসন।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের লেবার দলকে ৫৭ আসন নিয়েই পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। দুজনেরই ছিল রাজনীতিতে প্রগাঢ় আস্থা আর বহুদিনের রাজনৈতিক দীক্ষা। শুধু তাই নয় গত কটি বছর দুজনেই স্বঅবস্থানে প্রবল প্রতিরোধের মুখেই এ অঙ্গনে নিয়মিত যাতায়াত করেছেন। অপেক্ষাকৃত নন্দিত রাজনৈতিক নেতা হয়েও হারাতে হল প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের মাথার মুকুট।

কেভিন রাড কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের মানুষ। জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৭ সালে। এদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার সুনাম অনেক দিনের। বেশ অমায়িক এবং মেধাবান এ মানুষটির কল্যাণেই ২০০৭ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন লিবারেল দলকে হারিয়ে তার লেবার দল জনগণের অকুণ্ঠ আস্থা আর জনসমর্থন পেয়েছিল। যা পরবর্তীতে দলীয় কোন্দলের কষাঘাতে এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের কূটনৈতিক চালে তাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারাতে হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীত্ব হারালেও দেশের যে কোন জরিপে তিনিই ছিলেন জুলিয়া গিলার্ডের চেয়ে যোগ্য প্রধানমন্ত্রী। ২০০৭ সালের নির্বাচনে যখন নামি-দামি লেবার দলের সদস্যরা কুপোকাত হচ্ছিলেন, সে কঠিন সময়ে তিনি হাল ধরেন দলটির। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপালনের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয় লেবার পার্টিকে তিনি একটি সম্মানজনক জায়গায় অধিষ্ঠিত করেন।

২০০৭ থেকে ২০১০ সময়কালেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ে পড়াশোনা করেন কেভিন। ইংরেজির পাশাপাশি চীনা ভাষায় অবিরাম কথা বলতে পারেন কেভিন রাড।

অন্যদিকে, টনি অ্যাবটও জন্ম নিয়েছেন একই বছর। ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে ৪ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি তার নিউ সাউথ ওয়েলসের ওয়ারিঙ্গার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। হাওয়ার্ড সরকারের সময়, ১৯৯৮ সালে তিনি মন্ত্রিত্বের সুযোগ পান। হাওয়ার্ড সরকারের দীঘদিনের দেশপরিচালনার সময় টনি বিভিন্নভাবে তার ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার জনগণ সেদিনই বুঝেছিল এই টনিই একদিন প্রধানমন্ত্রিত্ব নেবেন।

সুযোগ এল ২০০৯ এ। তারই সিনিয়র দলনেতা মেলকম টানবুলকে ৪২-৪১ ভোটে পরাজিত করে বিরোধী দলের নেতার আসনটি সংরক্ষণ করেন টনি। এরপরের দিনগুলো কেটেছে মেঘাচ্ছন্ন। খুব কমই সূর্যের আলো দেখেছেন টনি। নেতা হিসেবে খুব কম সময়েই তিনি সূচকের মাপে উপরে উঠেছেন। দলের বাইরে প্রায় সকল স্তরের মানুষই তাকে দূরে ঠেলেছে।

শুধু তাই নয়, নির্বাচনের দিনও ভদ্রলোককে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে, শুনতে হয়েছে অভিবাসী মানুষের নানা অভিযোগের কথা। কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে ফিরেছেন ভোটকেন্দ্র থেকে।

তবে মিডিয়ার অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছেন টনি। সারাক্ষণই জরিপে তাকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা মত তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে সন্দেহ নেই, তবে অনেকেই আশংকা করছে টনি তার কতটা গায়ে মাখবেন।

প্রবাসের বাঙালিরা অনেকেই টনিকে শুভেচ্ছা জানালেও সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন ফেসবুক, টুইটারে জনগণের মুখ থেকে এমন কথাও উচ্চারিত হয়েছে যে আমাদের নানা রঙের দিনগুলো হারিয়ে গেল। সামনে যে কী দেখব কে জানে! আমাদের দেশবরেণ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাতনি বলছেন, 'ডাক ডেজ অ্যাহেড'। নির্বাচনের মাঠকর্মীদের মুখ থেকে ভেসে এসেছে 'গো অ্যাওয়ে অ্যাবট'।

এখন সময়ই বলবে টনি অ্যাবটের সরকার এদেশের জনগণ আর বিরোধী দলের চুলচেরা বিশ্লেষণের কাছে কতটা নতজানু হবেন। নিজেকে কতটুকু সামলে রাখবেন টিনি। প্রায় বাইশ বছর ধরে বিশ্বের সেরা দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক মন্দায় দিন কাটিয়েছে তখনও অস্ট্রেলিয়া টিকে থেকেছে শক্তিশালী একটা পরিসরে।

এত কিছুর পরও দুজন নেতাই অভিবাসী আশ্রয়নীতিতে ছাড় দিতে নারাজ। যারা আশ্রয়মুখী মানুষ, উন্নত জীবনযাপন আর রোজগারের সন্ধানে ছুটে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ায়– তাদের জন্য বিষয়টি মোটেও সুখকর নয়।

নির্বাচনের আগে জনসমর্থনে বেশ পিছিয়ে থাকলেও হাল ছাড়েননি কেভিন। নির্বাচনের আগের জনমত জরিপগুলোয় লেবারের হার ছিল স্পষ্ট। তারপরও প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড মানুষের ওপর আস্থা খুঁজেছেন। বারবার ছুটে গেছেন নির্বাচনি এলাকাগুলোতে। মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন তার অমিয় বার্তা।

নির্বাচনের দিন দুপুরে লেবার দল সুযোগ করে দিয়েছিল কেভিন রাডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কথা বলার। আমার উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ে আশা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবার জন্য তৈরি করেছিল একটি প্রশ্ন, 'শিক্ষার মান উন্নয়নে কেভিন রাডের পরিকল্পনা কী?'

বিরোধী দলীয় নেতা টনি অ্যাবটের নেতৃত্বাধীন বিরোধী কোয়ালিশনের চেয়ে নাগরিক সমর্থনে অনেক পিছিয়ে থেকেও তিনি মানুষের জয়গান করেছেন। কোথাও কোনো অপ্রীতকর ঘটনার প্রশ্ন কেভিন রাডের জন্য অবান্তর। একজন সফল রাজনৈতিক নেতা হেরে গিয়েও জিতে যান, তার ক্ষেত্রে এটাই প্রযোজ্য। অস্ট্রেলিয়ার জনগণ তাকে কখনও ভুলবে না।

খেলায় যেমন হার-জিত আছে, রাজনীতিতেও তেমনি– জয়-পরাজয় থাকবেই। তারপরও দুঃশাসন, দুর্নীতি বাদ দিয়ে যে রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষের পথচলা সহজ করে দেন তিনিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

সাধুবাদ জানাই বিদায়ী কেভিন রাডকে। সময়ের দাবি মেনে নিয়ে শুভেচ্ছা জানাই আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটকে।

আনোয়ার আকাশ : অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী মানবসম্পদ উন্নয়ন কমর্কতা, শিক্ষক, অস্ট্রেলিয়ান হিউম্যান রিসোর্স ইনস্টিটিটিউটের সদস্য ও বাংলা একাডেমী, অস্ট্রেলিয়ার পরিচালক।