লেখক সুস্মিতার চলে যাওয়া

সেলিনা হোসেন
Published : 6 Sept 2013, 05:10 PM
Updated : 6 Sept 2013, 05:10 PM

সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বছর দশেক আগে। খুবই অল্প সময়ের জন্য। কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে। সেই স্মৃতি আমার সামনে এখন একটি দগদগে ক্ষত।

পত্রিকার পৃষ্ঠায় সুস্মিতার ছবির দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করতে পারছি না যে সুস্মিতা আর নেই। এই পৃথিবীর কোনো ক্ষুদ্র এলাকাতেও তালেবানদের দৃষ্টি এড়িয়ে লুকিয়ে নেই। সুস্মিতাকে মেরে ফেলেছে ওরা। যে স্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিটি মানুষের জীবনে অনিবার্য সত্য, সেই মৃত্যুকে আমরা জগৎ-সত্যের ধারণা থেকে গ্রহণ করি। কিন্তু সুস্মিতার মৃত্যুকে কোন সত্যের আলোকে গ্রহণ করব? যে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল একজন আফগান পুরুষকে– চলে গিয়েছিল নিজের সংস্কৃতির বলয়ের বাইরে?

তালেবানরা তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে মুসলমান হওয়ার জন্য। ধর্মান্তরিত হওয়ার আদেশ উপেক্ষা করার কারণে ওরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। ওদের আদেশ মেনে নেওয়া সুস্মিতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুস্মিতা ঠিকই জানত, ভালোবাসার যৌথজীবনে ধর্ম সহমর্মিতার– উগ্র কর্মকাণ্ড নয়, যা মানবিকবোধকে দলিত করে, বাধ্যের নিগড়ে বাঁধবে ভালোবাসার শুদ্ধতম আচারকে।

এত কিছুর পটভূমিতে যে বইটি লিখেছিল সুস্মিতা তার নাম 'Kabuliwala's Bangali wife' যেখানে বর্ণিত হয়েছে সুস্মিতা কীভাবে তালেবানদের অগ্রাহ্য করে নিজ বলয়ে ফিরে আসার কথা ভেবেছে। এ বইয়ের নাম দেখে বুঝতে পারি যে সুস্মিতা নিজ সংস্কৃতির বাইরে গিয়েছিল একথা বলা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের গল্পের 'কাবুলিওয়ালা' সুস্মিতার সাংস্কৃতিকবোধের মধ্যে ছিল। সুস্মিতা নিজের শেকড় উপড়ে ফেলেনি– বরং সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে নিজের জীবনকে সাজিয়েছিল। ও ঠিকই জানত, অখণ্ড ভারতবর্ষে আফগানিস্তানের কাবুল থেকে আসত শুকনো ফলবিক্রেতা কাবুলিওয়ালারা।

এমনই এক দুঃখী কাবুলিওয়ালা এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম চরিত্র হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছুঁয়ে চলেছে। সঙ্গে আছে বাংলার এক কিশোরী মেয়ে মিনি। রবীন্দ্রনাথ গল্পটি শেষ করেছিলেন মিনির বিয়ের খরচের টাকা বাঁচিয়ে সে টাকা কাবুলিওয়ালা রহমতের হাতে তুলে দিয়ে। গল্পের শেষে আছে–

''বলিলাম রহমতকে, তুমি দেশে তোমার মেয়ের কাছে ফিরিয়া যাও। তোমাদের মিলনসুখে আমার মিনির কল্যাণ হউক।''

একজন কাবুলিওয়ালা মিনিকে দেখে নিজ দেশে রেখে যাওয়া মেয়ের আদল খুঁজে নিয়েছিল মিনির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ সেই বাবাকে মেয়ের কাছে ফিরে যেতে সহযোগিতা দিয়েছিলেন।

এখন আফগানিস্তানের তালেবানদের মধ্যে এই কাবুলিওয়ালারা নেই। তাদের কাঁধে শুকনো ফলের ঝোলা নেই। তাদের কাঁধে আছে অস্ত্র। তারা ভালোবাসার মিলনসূত্র ধরে রাখে না। চায় মরণ। মেরে ফেলার তাণ্ডবে মেতে ওঠে হিংস্র উন্মাদনায়।

'কাবুলিওয়ালা' উনিশ শতকে রচিত গল্প, ১৮৯২ সালের। মাঝে বিংশ শতাব্দী পার হয়েছে, এখন একাবিংশ শতাব্দী। এখন আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের অনেকেই জনজীবনের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অস্ত্রের সঙ্গে বসবাস করছে। ভুলে যাচ্ছে ভালোবাসা শব্দটি, ভুলে যাচ্ছে ধর্মের বিশ্বাস, পবিত্রতা ও সত্যের কথা, ভুলে যাচ্ছে ধর্মের সুশীল আচরণের কথা, সহিষ্ণুতার কথা– মানবিকবোধের চেতনায় ধর্মের বাণীর কথা। আজ ওরা অসহিষ্ণু, বন্দি, হিংস্র ধর্মান্ধ– যার সঙ্গে মানবকল্যাণের সম্পর্ক নেই।

কী অপরাধ ছিল সুস্মিতার

হিন্দু হয়ে মুসলমানকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, তাহলে তার অপরাধ এটুকুই। স্বামী মানবাজ কলকাতায় ব্যবসা করতেন। নিজ পরিবারের অমতে তিনি বিয়ে করেন বিশেষ ম্যারিজ অ্যাক্টে জানবাজ খানকে। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের পত্তিকা প্রদেশে বসবাসের সময় তালেবানরা তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে।

সুস্মিতা কলকাতায় ফিরে রচনা করেন আত্মজীবনীমূলক বই। এ বইকে অবলম্বন করে বলিউডে তৈরি হয়েছে সিনেমা। শেষ রাতে নিজ বাড়ি থেকে ধরে এনে তাকে হত্যা করা হয়। একটি মাদ্রাসার কাছে তার বুলেটবিদ্ধ মরদেহ পড়েছিল।

হায় সুস্মিতা

প্রেম, বিয়ে, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য ফতোয়া, বই লেখা, বই থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ, বইয়ের জনপ্রিয়তা অর্জন– সব মিলিয়ে একজন লেখক এবং লেখকের জীবন। একবিংশ শতাব্দীর কাবুলিওয়ালাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড একজন লেখকের নিয়তি হতে পারে না। তারপরও হয়।

এই নিষ্ঠুরতার অবসান কবে হবে কেউ জানে না। ধর্মান্ধদের উগ্রতা মানুষকে কতটা টেনে নিয়ে যাবে কেউ জানে না। ভালোবাসার দাম দিয়ে লেখক সুস্মিতা যে বইটি রেখে গেল সেটি আজ আমার স্মৃতির দুয়ারে প্রবল করাঘাত!

খবরটি জানার পর থেকে কেবলই মনে হচ্ছে লেখকের স্বাভাবিক মৃত্যু চাই! কারণ তাকে তো মানুষের কথা বলতে হবে– গাইতে হবে জীবনের জয়গান।

সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক।