গত বছর এ সময়ে ডেসটিনি কেলেঙ্কারির কারণে সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ডেসটিনির মালিক ও কর্মচারিদের অনেককেই কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার বিশেষ আদালত। ডেসটিনির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল তার মধ্যে বেআইনিভাবে ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম চালানো, বেআইনিভাবে অর্থ পাচার এবং অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের বা গ্রাহকদের টাকা নিজেদের নামে হস্তান্তর করা অন্যতম।
ডেসটিনির বিরুদ্ধে আর যে অভিযোগ প্রচ্ছন্নভাবে উঠেছিল তা হচ্ছে– প্রতিষ্ঠানের এমএলএম ব্যবসা। দুবছর আগে আমি যখন ঢাকায় ছিলাম কিছুদিন তখন একদিন আমার এক আত্মীয় আমার কাছে এসে ডেসটিনিতে টাকা লগ্নি করার প্রস্তাব দেন। আমি তার কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে জানিয়েছিলেন তিনি নিজেও দশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন এবং ইতোমধ্যে তার সিংহভাগ হাতে ফিরে এসেছে। এরপর কিছু দিনের মধ্যেই আসল ছাড়িয়ে লাভে পা দেবেন।
আমার কৌতূহল নিবারণের জন্যে তিনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে ডেসটিনিতে বিনিয়োগের বিষয়টা বেশ সহজ। এখানে তার নিজের বা কোনো বিনিয়োগকারীকেই কোনো পণ্য বিক্রির ঝামেলায় যেতে হয় না। একজন বিনিয়োগকারী কেবলমাত্র দশজন বিনিয়োগকারী জোগাড় করে দিলেই তার দায়িত্ব শেষ। এরপর যত লগ্নিকারক আসবে তাদের লগ্নিকৃত অর্থ থেকে তিনি ভাগ পেতে থাকবেন। ডেসটিনির শেয়ার কেনা অনেকটা ব্রিটিশ আমলের তালুকদারি কেনার মতোই আর কী!
প্রস্তাবিত এমএলএম কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, "সাম্প্রতিককালে দেশে এমএলএম ব্যবসা বাড়লেও আইনি কাঠামো নেই। এ কারণে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করতেই আইনটি করা হচ্ছে।"
এ আইনের ফলে এমএলএম ব্যবসা এখন সরকারের নজরদারিতে থাকবে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে আসবে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম ব্যবসা করলে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর থেকে সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে আইনের খসড়ায়।
অনেক ক্ষেত্রে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং-এর একটা সহজাত কার্যক্রম হচ্ছে 'পিরামিড সেলিং' কিংবা চাহিদা-যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীন ব্যবসা কার্যক্রম। 'পিরামিড সেলিং' সম্পর্কে একটু পরে বলছি। এ মুহূর্তে এটুকু জানা দরকার যে, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে 'পিরামিড সেলিং' নিষিদ্ধ।
অথচ আমাদের দেশে এমএলএম কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে আইন করা হচ্ছে, নিষিদ্ধ করার জন্যে নয়। এতদিন যে ব্যবসাপদ্ধতির কোনো রকম আনুষ্ঠানিক উল্লেখ ছিল না আমাদের আইন ব্যবস্থায়– এখন তাকে নিষিদ্ধ না করে নিয়ন্ত্রণের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আসলে তাকে এক রকম বৈধতাও দেওয়া হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রিত এসব কার্যক্রমের ফাঁকে 'পিরামিড সেলিং'-এর মতো ফটকাবাজি ব্যবসা গজিয়ে না উঠে সেজন্যে খসড়া আইনটি আরও ব্যাপকভাবে প্রচারিত, আলোচিত এবং সমালোচিত হওয়া প্রয়োজন। "সংসদ কার্যকর না থাকায় অধ্যাদেশ আকারে আইনটি জারি করা (র)" জন্যে তাড়াহুড়া না করাই ভালো হবে।
পিরামিড সেলিং কী ও কেন নিষিদ্ধ
একটি পিরামিডের কাঠামোতে যেমন উপরের অংশ সরু এবং নিচের অংশ বিস্তারিত থাকে, তেমনি 'পিরামিড সেলিং'-এর উপরাংশে একজন বা দুজন বিক্রেতা এবং তার নিচে স্তর অনুসারে পরিবেশক বা এজেন্টের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে এবং এ জাতীয় ব্যবসা বাজার থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে 'পিরামিড সেলিং'-এর বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। কোথাও কোথাও এ বাজার প্রক্রিয়ায় কোনো পণ্যই থাকে না। আবার কোথাও কোথাও বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অগণিত এজে্ন্সির গুদামঘর বোঝাই করা হয়। পিরামিডের নিচের অংশে যারা থাকে তাদের পক্ষে লাভ তো দূরের কথা, কেনা দামেও এ পণ্য আর বিক্রি করা সম্ভব হয় না। এমএলএম ব্যবসায়ের এখানেই শেষ।
ধরা যাক বাংলাদেশের ডেসটিনির মতো একটি প্রতিষ্ঠান প্রথমে দশজন পরিবেশক নিয়োগ দেয় এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে জামানত হিসেবে দশ হাজার টাকা জমা রাখে। এ দশজনের প্রত্যেককেই একই শর্তে দশজন করে পরিবেশক জোগাড় করে দিতে হবে। নতুন পরিবেশকদের জামানতের টাকা থেকে তাদের উপরের স্তরের পরিবেশকরা হার মোতাবেক 'লাভ' পেতে থাকবে।
যতদিন পর্যন্ত নতুন পরিবেশক জুটতে থাকবে ততদিন কোনো সমস্যা নেই। বেশকিছু বেকার লোক একটা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার উপায় করতে পারছে, ভালোই তো…. ভালো না?
কিন্তু এ ভালো কাজ আর ভালো থাকবে না যখন নতুন পরিবেশক জুটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। অঙ্কের অমোঘ নীতিতে প্রত্যেক স্তরে দশজন করে বাড়তে থাকলে দশম স্তরে পরিবেশকের সংখ্যা দাঁড়াবে দশ বিলিয়ন। অথচ পৃথিবীর বর্তমান লোকসংখ্যা মাত্র সাত বিলিয়ন। কাজেই পিরামিড ব্যবসায়ের গোড়াতেই গলদ।
যে কোনো সফল ব্যবসায়ীকে অবশ্যই জানতে হবে কী পরিমাণ পণ্য তাকে বাজারজাত করতে হবে। পরিমাণটি সঠিকভাবে নির্ধারিত হলে সর্বাধিক লাভ করা সম্ভব। আমি যদি বাজারে প্রথম কোনো পণ্য বিক্রি শুরু করি, আমাকে প্রথমেই জানতে হবে বাজারে আর কজন বিক্রেতা আছে। তাদের কাছ থেকে কজনকে আমার ব্যবসায়িক শুভবুদ্ধি ও নৈপুণ্যের কারণে খদ্দের হিসেবে পেতে পারি। অর্থাৎ তাদের কাছে কী পরিমাণ জিনিস বিক্রি করতে পারি।
সমস্যা হচ্ছে, সঠিক পরিমাণটি আগেভাগে জানবার কোনো উপায় নেই। কাজেই আমাকে বেশ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। অর্থনীতিতে সঠিক পরিমাণকে বলা হয় 'ভারসাম্য' পরিমাণ। আমার যোগান যদি ভারসাম্য পরিমাণের তুলনায় কম হয় তাহলে লাভ কম হবে। কিন্ত বাজারে টিকে থাকার সামর্থ্য আমার থাকবে।
আর আমি যদি ভারসাম্য পরিমাণের বহুগুণ বেশি বাজারজাত করি তাহলে মাঠে মারা যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বাজারে টিকে থাকার জন্যে বাজারে যারা আসল ক্রেতা বা ভোক্তা (পরিবেশক কিংবা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা নয়) তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকতে হবে। তারাই আমার পণ্যের ভারসাম্যপূর্ণ পরিমাণ ঠিক করে দেবে।
যেসব এমএলএম ব্যবসা জ্যামিতিক হারে এজেন্ট নিয়োগ করে তারা কখনওই তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার দিকে তাকায় না। পরিণামে তারা নিজেরা ধ্বংস হয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধ্বংস করে।
বিষয়টা আরেকটু সহজভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য দুটো বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯২০ সালে চার্লস পঞ্জী নামে এক ইতালিয়ান-মার্কিনি আন্তর্জাতিক পোস্টাল কুপনের ব্যবসা শুরু করেন। তখন আন্তর্জাতিক চিঠিপত্র আদানপ্রদানের সময় চিঠির জবাব দেওয়ার সুবিধার্থে চিঠির সঙ্গে রিপ্লাই কুপন দিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। যে দেশে কুপন কেনা হত সে দেশের ডাকটিকেটের সমান ছিল কুপনের দাম। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো দেশে কুপনগুলো সে দেশের ডাকটিকেটের সঙ্গে বিনিময় করা যেত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য অনেক দেশের মতো ইতালিতেও মার্কিন ডলারের তুলনায় লিরার মুদ্রামান অতিদ্রুত কমতে থাকে। ফলে ইতালি থেকে কুপন কিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডাকটিকিটের সঙ্গে বিনিময় করলে যথেষ্ট লাভ থাকত। পঞ্জীর কথানুসারে [অনেক বাড়িয়ে মিথ্যা করে বলেছিলেন], এসবের বিনিময়ে লাভের পরিমাণ ছিল শতকরা ৪০০ ভাগ।
পঞ্জী অপেক্ষাকৃত কম দামে কুপন কিনে বেশি দামে বিক্রি করতেন। এ ব্যবসায় তার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু কিছুদিন ব্যবসা চালানোর পর দেখা গেল খরচ বাদ দিয়ে তার যে লাভ থাকে তাতে খুব দ্রুত অনেক টাকার মালিক হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই তিনি ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করলেন।
প্রথমে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দিয়ে শুরু হল। প্রতি নব্বই দিনে শতভাগ লাভের আশ্বাস দিলেন পঞ্জী। অতিমুনাফার লোভে প্রথমে কিছু লোক তার ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে রাজি হল এবং কথা অনুসারে উচ্চহারে লাভও পেতে শুরু করল। কথায় কথায় এটা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল এবং আরও বেশি সংখ্যক নতুন বিনিয়োগকারী পঞ্জীর ব্যবসায়ে যোগ দেওয়া শুরু করল।
নতুন লগ্নিকারকদের টাকা থেকে পুরাতন লগ্নিকারকদের উচ্চহারে লাভ দেওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্জী কোটিপতি হয়ে গেলেন এবং বিলাসবহুল জীবন কাটাতে লাগলেন।
পঞ্জী তার ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্যে উচ্চহারে কমিশন দিয়ে এজেন্ট নিয়োগ করলেন এবং সিক্যুরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। অতিমুনাফার লোভে মানুষ দলবেঁধে তার কোম্পানিতে টাকা রাখা শুরু করল। পঞ্জী এসব টাকা হ্যানোভার ট্রাষ্ট ব্যাংক নামে একটি ছোট ব্যাংকে জমা রাখতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তিন মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ওই ব্যাংকের একজন প্রভাবশালী মালিক বনে যান।
সাধারণ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি বিক্রি করে, ঘটিবাটি বন্ধক রেখে পঞ্জীর ব্যাংকে টাকা জমাতে থাকে। পঞ্জী নিজে তার অপরিমিত টাকা হ্যানোভার ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন নামিদামি ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করলেন। নিজের জন্যে আলিশান বাড়ি ও জীবন উপভোগ করার যাবতীয় সরঞ্জাম কিনলেন। এমনকি সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্যে বড় অংকের টাকা দান করাও শুরু করলেন।
পঞ্জীর বিলাসবহুল জীবন দেখে অনেকেই সন্দেহ করা শুরু করলেন যে, এত টাকা কোত্থেকে আসে। প্রথম প্রশ্ন আসে পঞ্জীর নিজের ব্যবসা যদি এতই লাভজনক হয়, তাহলে তিনি তাতে আরও টাকা খাটাচ্ছেন না কেন। বোস্টনের এক সাংবাদিক এ বিষয়ে লেখালেখি করায় পাঁচ লাখ ডলারের মানহানির মামলায় জড়িয়ে পড়লেন।
ওই সময়ের নিয়মানুসারে কারও বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তা প্রমাণের দায়িত্ব ছিল লেখক এবং যে পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছে তার মালিকের ওপর। ওই সাংবাদিকের হাতে পঞ্জীর বিরুদ্ধে বেআইনি কাজকর্মের তেমন অকাট্য দলিল ছিল না। কাজেই মামলায় তিনি হেরে যান।।
ফলে কিছুদিনের জন্যে পঞ্জীর বিরুদ্ধে লেখালেখিতে অনেকটা ভাটা পড়ে যায়। তবে মাঝে মাঝেই তার বিরুদ্ধে সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পঞ্জী তার আর্থিক সামর্থ্যের জোরে, বিশেষ করে হ্যানোভার ব্যাংক থেকে নীতিবহির্ভূতভাবে টাকা 'ধার' করে তার অর্থনৈতিক পতন কিছু সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু শেষরক্ষা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিকরা খোঁজাখুঁজি করে বের করেছিলেন যে, সিক্যুরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানিতে লেনদেনের যে পরিমাণ তা সত্য হলে বাজারে কমপক্ষে ১৬০ মিলিয়ন পোস্টাল কুপন থাকা দরকার। অথচ বাজারে বিদ্যমান কুপনের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭ হাজার।
এ ঘটনার পর সরকারি ও বেসরকারি তদন্তকারীদের নজর পড়ে পঞ্জীর ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ কোম্পানির ওপর। তদন্তে অনেক গোলমাল ও গরমিল ধরা পড়ে। পঞ্জীর বাকি জীবন মোটেই সুখের ছিল না। জেলের ভিতরে ও বাইরে বহু বছর কাটিয়ে অবশেষে ব্রাজিলে ভয়ানক দরিদ্র অবস্থায় মারা যান ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে।
পঞ্জীর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরেও পঞ্জী স্কিম বেঁচে আছে। আইনের ফাঁক পেলেই কিংবা আই্নকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেকেই এখনও পঞ্জীর অনুকরণে রামের টাকা দিয়ে রহিমকে বিদায় করার চেষ্টা করছে।
১৯৬০ সালে সাবেক নাসডাক (NASDAC) চেয়ারম্যান বার্নাড ম্যাডফ ওয়াল স্ট্রিটে ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিস নামে তার ব্যবসা শুরু করেন। স্টক মার্কেটের ডিভিডেন্ড কিংবা ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি হারে লাভ দিতেন ম্যাডফ। স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কোম্পানির ডিভিডেন্ড নির্ভর করে সে কোম্পানির অর্জিত লাভের ওপর। কাজেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা প্রতি বছর একই হারে ডিভিডেন্ড আশা করতে পারে না।
কিন্তু ম্যাডফ তার বিনিয়োগকারীদের প্রতি বছরই উচ্চহারে লাভ দিয়ে যাচ্ছিলেন (শতকরা প্রায় ২০ ভাগ)। এমনকি ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে যখন সারাবিশ্বের শেয়ার মার্কেটে অস্বাভাবিক দরপতন ঘটেছিল তখনও ম্যাডফ তার শেয়ারহোল্ডারদের শতকরা ছয় ভাগ লাভ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে অনুসন্ধানে ধরা পড়ে, এ সবই সম্ভব হয়েছিল ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারীদের অর্থের বদৌলতে– কোনো সত্যিকারের লাভজনক ব্যবসায়ের মাধ্যমে নয়।
শেয়ার বেচাকেনা ছাড়াও ম্যাডফের সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে আরেকটি শাখা ছিল। এ শাখার অধীন তিনি অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নেন। তদানীন্তন আইন অনুসারে কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে বছরে কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ দান করতে হত।
ম্যাডফ দেখলেন শতকরা পাঁচ ভাগ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান কদাচিৎ টাকা উঠাতে আসে। তার মানে প্রতি বিলিয়ন ডলারের জন্যে বছরে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার হাতে রাখলেই হল। কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই বিশ বছর পর্যন্ত চলতে পারে এভাবে।
এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যে বহু ফান্ড ম্যানেজারকে ম্যাডফ কমিশন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন। ফলে তার ফান্ডের গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। পঞ্জীর মতোই ম্যাডফ কোনো সার্ভিস কিংবা উৎপাদনশীল কাজে অর্থায়ন না করেও গ্রাহকদের মোটা অংকের লাভ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
অপরিমিত অর্থের মালিক হওয়ার পেছনে শেয়ার মার্কেটে বেচাকেনা সম্পাদনের জন্যে ম্যাডফের ব্যবহৃত অত্যাধুনিক টেকনোলজিও অনেকাংশে সহায়তা করেছে। কম্পিউটারভিত্তিক এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ম্যাডফ একদিনেই এত বেশি শেয়ার হাতবদলের কাজ করতে পারতেন যা করতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দু কী তিন দিন সময় লেগে যেত।
ম্যাডফ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের ডলারে এক সেন্টের বিনিময়ে তাদের বেচাকেনার কাজও করে দিতেন। বেশ সস্তায় এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দেবার জন্যে সবাই খুশি ছিল ম্যাডফের ওপর। তাহলে অসুবিধা কোথায়? সাংবাদিকদের নিরলস চেষ্টায় এবং সরকা্রি কর্মকর্তাদের সহায়তায় থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসে কিছুদিনের মধ্যেই।
ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিস এবং অন্যান্য সিকিউরিটিস কোম্পানির যারা ম্যাডফের মাধ্যমে বেচাকেনা করে, তাদের অর্ডারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে তিনি আঁচ করতে পারতেন কোন শেয়ারের দাম দুয়েক দিনের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে বা হ্রাস পাবে। সাধারণ ক্রেতাদের তুলনায় বাজারের সামগ্রিক চিত্রটি ম্যাডফের চোখে আগেই ধরা পড়ত। এ ব্যাপারে যত বেশি গ্রাহক ম্যাডফের মাধ্যমে অর্ডার দিত তার পূর্বাভাস তত বেশি বাস্তবভিত্তিক হত।
এ অবস্থায় ম্যাডফ অন্যদের আগেই শেয়ার কিনে লাভবান হতেন কিংবা বিক্রি করে দিয়ে লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে পারতেন। শেয়ার মার্কেটের পরিভাষায় একে বলা হয় 'ফ্রন্ট রানিং' বা 'ইনসাইডারস বিজনেস' যা প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ কিন্তু প্রমাণ করা বড় কঠিন।
বেশুমার অর্থের মালিক ম্যাডফ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ধরা পড়েন এবং ২০০৯ সালে জুন মাসে ফেডারেল কোর্ট তাকে ১৭ বিলিয়ন ডলার জরিমানাসহ ১৫০ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
ধরা যাক, ম্যাডফ ধরা পড়েননি এবং তার কোনো শাস্তিও হয়নি– তাহলে কতদিন যাবত তিনি ব্যবসা চালিয়ে যে্তে পারতেন? খুব বেশিদিন নয়। কারণ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতার কারণে একসময় তার পক্ষে সবদিক সামাল দেওয়া সম্ভব হত না এবং প্রকৃত বিনিময় তথা প্রকৃত উপার্জন না করেও রাজার হালে চলা সম্ভব হত না।
বস্তুত ২০০৫ সাল থেকেই ম্যাডফ প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন অ্যাসেটের পরিমাণ মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে তখন ম্যাডফ তার দুই ছেলে মার্ক ও অ্যান্ড্রুর কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের ১৭০ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম বোনাস দেওয়া হোক। সন্তানরা জানতে চায় যেখানে টাকার অভাবে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না সেখানে বোনাসের কথা আসে কী করে? ম্যাডফ স্বীকার করেন, তার সম্পদ বাবস্থাপনা ইউনিটটি ছিল "one big lie"… পঞ্জী স্কিমের একটি আধুনিক সংস্করণ।
এমএলএম তথা পিরামিড ব্যবসায়ের আরও অনেক অবাঞ্ছিত কাহিনি অর্থনীতির ইতিহাস কলঙ্কৃত করেছে। আমি দুটিমাত্র কাহিনি তুলে ধরলাম পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং বাংলাদেশে প্রস্তাবিত এমএলএম আইনটি আরও খতিয়ে দেখার জন্যে।
আলী আহমাদ রুশদী : শিক্ষক, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও গবেষক। বর্তমানে মেলবোর্নপ্রবাসী।