গণ্ডির উর্ধ্বে উঠতে পারলেন না ড. ইউনূস

আবু সাইয়ীদ
Published : 31 August 2013, 03:03 AM
Updated : 31 August 2013, 03:03 AM

আড়াই বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেবার পর থেকেই সরকার এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি ঘটে। সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হলে ড. ইউনূস হেরে যান।

এরপর উভয়ের মধ্যে চলে বাকযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এর অবসান ঘটবে না তা অনেকটাই স্পষ্ট।

প্রথম থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যেমন অভিযোগ সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করে দিচ্ছে– তেমনই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২২ আগস্ট, ২০১৩ সিলেটে এক সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা অভিযোগ এনে বলেছেন, ''গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করার ব্রতটি অধ্যাপক ইউনূস নিজেই দুই বছর ধরে বহাল রেখেছেন।''

একে অপরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনছেন তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে– বিস্তারিত এবং সুনির্দিষ্টভাবে কেউ এখনও কিছু বলেননি। অর্থাৎ ড. ইউনূস কীভাবে বা তাঁর কী কী পদক্ষেপের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করার ব্রতটি দুই বছর ধরে বহাল রেখেছেন, তা অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেননি।

অনুরূপভাবে ড. ইউনূসও সরকারের কী কী পদক্ষেপের কারণে গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংস হতে চলেছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দেননি।

তবে সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তে এক কমিশন গঠন করেছে, অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্পষ্ট যে এই রিপোর্টটি দ্রুতই প্রকাশ পাবে। ধ্বংস-বিষয়ক অভিযোগের উভয়পক্ষ বা কোনো একটি পক্ষের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা থাকুক চাই না থাকুক– একটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার কোনো প্রক্রিয়াই সমর্থনযোগ্য নয়।

গ্রামীণ ব্যাংক একদিনে গড়ে ওঠেনি, অনেক শ্রমে এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যদি এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বা কর্মপদ্ধতিতে কোনো নেতিবাচক দিক থেকেই থাকে বা বর্তমান বাস্তবতায় যদি কোনো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে যতটুকু প্রযোজন শুধুমাত্র সেটুকু পদক্ষেপই যথেষ্ট এবং অবশ্যই তা যৌক্তিকতার নিরিখে এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতি পূর্ণ মমত্ববোধ রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে।

২২ আগস্ট, ২০১৩ সকালে রাজধানীর মিরপুরে ইউনূস সেন্টারে আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ''নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে আগামী সংসদ নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।''

তার এ বক্তব্য যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার এ মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে বেশ বিতর্কের ঝড় উঠেছে। অধিকাংশই তার বক্তব্যের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং বেশ কড়া কড়া মন্তব্যই করেছেন।

আবার তার পক্ষে কেউ কেউ অবস্থান নিয়ে বলেছেন, আর দশজন সচেতন নাগরিক হিসেবে উনিও মন্তব্য করতেই পারেন বা করাটাই স্বাভাবিক, ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও মনে করি, মন্তব্য করার অধিকার তিনি রাখেন এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারেই।

এর আগের দিন ২১ আগস্ট, ২০১৩ মিরপুরের ইউনূস সেন্টারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ''গ্রামীণ ব্যাংককে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের দেশের প্রতি কোনো মমত্ববোধ নেই। তাদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়।''

ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের নেতৃত্বে সংগঠনের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। ২২ আগস্টের বন্তব্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে উনি বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু ২১ তারিখের বক্তব্যে তিনি একটি দল বা জোটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

একটি দল বা জোটকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব না দেবার কথা বলে পক্ষান্তরে এ দল বা জোটকে ভোট না দেবার কথাই বলেছেন তিনি। এ রকম অবস্থানও উনি নিতেই পারেন এবং এ অধিকারও উনার আছে। এমনকি উনি কোনো জোটভুক্তও হতে পারেন, নির্বাচন করতে পারেন অথবা সরকারি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনও হতে পারেন।

কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংককে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের দেশের প্রতি কোনো মমত্ববোধ নেই বা শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করতে চাওয়ার ইস্যুতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাকে দিতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁর এ বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে পারেননি অনেকেই। বরং তারা একে বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই গ্রহণ করেছেন এবং তা সঙ্গত কারণেই।

রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের যে সংকীর্ণতা– যা আজ দেশকে গভীর সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে– তার উর্ধ্বে উঠতে পারলেন না ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ক অবস্থান দেশের প্রতি মমত্ববোধ বা দেশপ্রেমের ব্যারোমিটার হতে পারে না কোনোভাবেই এবং তার ভিত্তিতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নির্ধারণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তারপরেও যদি সরকার গৃহীত কোনো পদক্ষেপ, যা গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংসের সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হত– তাহলে হয়তো এমন একটা ভাবনার সুযোগ থাকলেও থাকতে পারত। হাজার সমস্যার দেশ বাংলাদেশ। এমন একটি দেশে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন তিনি বা তার দল, যিনি অধিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবেন এবং যার পদক্ষেপসমূহ সুশাসনের অধিকতর নিকটবর্তী। হয়তো আপাতত এমন একটি সরকার পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তারপরেও সকলের ব্রত ও পদক্ষেপসমূহ হতে হবে এমন একটি সরকার গঠনের অনুকূলেই।

এছাড়া বেশ কিছুদিন যাবৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু বক্তব্য, 'করতে হবে', 'হতে দেওয়া হবে না' ইত্যাদি ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের কথার মতো শোনাচ্ছে, যা উনার মতো একজন ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। সে কারণেই হয়তো ফেসবুকে এবং অনলাইন পত্রিকা বা কোনো কোনো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এত বেশি সংখ্যক বা অধিকাংশ মতামতদাতা তার সাম্প্রতিক বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

বেশকিছু মতামত এতই আক্রমণাত্মক যে, মনে হতে পারে উনার কাছ থেকে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক বক্তব্য পছন্দ করছেন না অথবা তারা শান্তিতে নোবেলবিজয়ী একজন ব্যক্তিত্বের উচ্চারণে অশান্তিপূর্ণ শব্দ 'ধ্বংস', 'করতে হবে', 'হতে দেওয়া হবে না' মেনে নিতে পারছেন না।

আজ সর্বত্রই সবকিছুকে দলীয় বা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হচ্ছে, সার্বিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত এ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নন। যা কিছু আমার, যা কিছু আমার ক্ষেত্র বা দলের, যা কিছু আমার স্বার্থের অনুকূলে তার সঙ্গেই আমি এবং তাই সঠিক– আর সবই মিথ্যা।

নিজের গণ্ডির উর্ধ্বে উঠতে পারছেন না কেউ। এ প্রবণতাই বিবিধ সংকট সৃষ্টির কারণ। বেরিয়ে আসতে হবে এ থেকে, সঙ্গে অতিকথন থেকেও।

রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সর্বপ্রকার অতিকথনে ক্লান্ত সবাই।

আবু সাইয়ীদ : চলচ্চিত্রনির্মাতা, প্রযোজক ও লেখক।