কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান

রণেশ মৈত্র
Published : 28 August 2013, 05:53 AM
Updated : 28 August 2013, 05:53 AM

বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে। আর এর পটভূমিতে যে সুদীর্ঘ, সুতীব্র এবং ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস আছে তা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে করতেই আমরা শেষতক স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শুরু করেছিলাম। এর পেছনে ছিল গণতন্ত্রের লড়াই, নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক ও আপোষহীন কামনা।

সত্য বটে, গণতন্ত্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দেয় না। গণতন্ত্র মানুষের একমাত্র এবং সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষাও হতে পারে না। গণতন্ত্র হচ্ছে একটি অতিআবশ্যিক মাধ্যম যার সাহায্যে আমরা গণমানুষের সকল আকাঙ্ক্ষা, সকল দাবি পূরণের অবাধ অধিকার অর্জন করতে পারি।

তাই জাতির মুক্তির জন্য স্বাধীনতা যেমন একটি পূর্বশর্ত– জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন পরিচালনার জন্যও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আমরা সমগ্র বাঙালি জাতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপোষহীন লড়াই করেছি দীর্ঘ তেইশটি বছর। অকাতরে প্রাণ ঢেলে দিয়েছি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে। বছরের পর বছর সবিচারে বা বিনাবিচারে কারাগারে নিভৃত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছি।

জানি, স্বাধীনতা যেমন চাওয়ামাত্র সহজেই পাওয়া যায় না–- তার জন্য সুদীর্ঘ লড়াই করতে হয়– তেমনই আবার গণতন্ত্রও কোনো দেশে রাতারাতি অর্জিত হয় না। আমরাও তো এ যাবত সেটা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আজও আমাদের সে জন্যে লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়েছে। যদিও তা ভিন্ন প্রকারে।

আসলে আমরা সবচেয়ে বড় যা অর্জন করেছি স্বাধীনতার পরে তা হল আমাদের সর্বজনপ্রশংসিত বাহাত্তরের সংবিধান। ওই সংবিধানের মাধ্যমে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার এবং তার মাধ্যমে পাঁচ বছর অন্তর সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে।

সে অঙ্গীকার আজও অব্যাহত। কিন্তু তার যাত্রাপথে নানা বিপদ, বাধা, প্রতিকূলতা বিদ্যমান এবং সেগুলি আমরা এখনও অতিক্রম করতে পরিনি। আর পারিনি বলেই আমাদের রাজনীতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত সামরিক হস্তক্ষেপ চলছে। আজও প্রকৃত অর্থে অবাধ, দলীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা।

দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ বছর পরপরই কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচনকে কীভাবে সংশয়মুক্ত করা যাবে, কীভাবে সকল দলমতের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যাবে তা নিয়ে অহেতুক কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবেই নানা বিতর্ক ও জটিলতার মধ্যে পড়ছে দেশ।

তেমনই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজকের বাংলাদেশে বিরাজ করছে যা নিয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষই শুধু নয়, বহু বিদেশি রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সাম্প্রতিককালে এ বিতর্ক এমনই তীব্র হয়ে উঠেছে যে দেশের সাধারণ মানুষ মাত্রই সংশয়াচ্ছন্ন যে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা। আবার হলে তাতে সকল দল অংশগ্রহণ করবে কিনা বা সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে সকল দল দ্রততম সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাবে কিনা।

এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে– অন্তত আমার বিবেচনায়– সরকার যখন নানা মহলের প্রদত্ত অভিমত অগ্রাহ্য করে বিরোধী দলসমূহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে, নেহায়েতই একতরফাভাবে, সংসদে সরকারি দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার সুবাদে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে দীর্ঘদিন যাবত সাফল্যের সঙ্গে প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে চলমান রাজনৈতিক সরকারের অধীনে, তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবস্থাপনাধীনে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করল।

তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি সকল বিরোধী মহল থেকে, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তরফ থেকে অত্যন্ত জোরেসোরে উত্থাপিত হতে থাকল। সরকার তাতে কর্ণপাত না করে তাদের মনমতো চলতে শুরু করল। এক পর্যায়ে তারা বলতে শুরু করল, সংসদে এসে এ বিষয় আলোচনা করুন এবং সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব থাকলে তা পেশ করুন। তবে কোনোক্রমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, কারণ সংবিধানে তেমন কোনো সুযোগ নেই।

বিএনপি নেহায়েত অযৌক্তিকভাবে দীর্ঘকাল যাবত সংসদ বর্জন করে চলছিল। শুধুমাত্র যখনই তাদের সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখনই তারা দুয়েক দিনের জন্যে সংসদে গিয়ে যে কোনো একটা প্রসঙ্গ টেনে পুনরায় সংসদ বর্জন শুরু করে। এভাবেই তারা মাত্র কিছুকাল আগে পর্যন্ত চালিয়েছে। তারাও বলে বসল, প্রস্তাব তারা আনবে না। সরকার পক্ষকেই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ওরা তা অনুমোদনের জন্যই কেবল সংসদে যাবে।

একটি সমাধান খুঁজে বের করার জন্য দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে সরকারের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য তাগিদও সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ফলোদয় হচ্ছে না। ফলে অনিশ্চয়তা দিন দিনই বাড়তে বাড়তে শুরু হল সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতি। একের পর এক হরতাল ডেকে বিরোধী দলগুলি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। অবস্থা এমন যে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে সম্মত নয়।

এ পরিস্থিতির মূল যে কারণ তা হল উভয় দলের চরম ক্ষমতালিপ্সা, লক্ষ্য হল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা অথবা যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা পুনর্দখল করা। যে জণগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারি দল সরকার গঠন করল বা বিরোধী দল সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে মর্যাদা পেল– সেই জনগণের কথা, তাদের স্বার্থের কথা, তাদের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কথা এবং সর্বোপরি দেশের কথা, সংবিধান ও গণতন্ত্রের কথা কারও-ই আর খেয়ালে থাকল না।

সংসদীয় গণতন্ত্রের যে কতগুলি মৌলিক নীতিমালা আছে, যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা দেশের সুধীজনেরা হরহামেশাই বলে থাকেন সেগুলির অস্তিত্বও আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলসমূহ ও নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সংলাপ, ঘন ঘন নানা সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনায় বসা– এগুলি তো যে কোনো দেশের রাজনীতির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র আমাদের দেশে।

মাস কয়েক আগে হঠাৎ একদিন দেখা গেল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলে বসলেন, "সংলাপ করার জন্যে আওয়ামী লীগ প্রস্তুত। দুয়েকদিনের মধ্যেই বিএনপির কাছে লিখিত আমন্ত্রণপত্র যাবে।''

সারা দেশে বিপুল আশবাদের সৃষ্টি হল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি চেয়ারপার্সন এক আলটিমেটাম দিয়ে বসলেন। আবার হেফাজতের সঙ্গে তার দলের সংহতি প্রকাশ করে তাদের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে ঢাকায় সকল বিএনপি নেতা-কর্মীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার আহ্বান জানালেন।

সমঝোতার যে ক্ষীণ সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। আর সংলাপের আমন্ত্রণলিপিও গেল না বিরোধী দলের কাছে। এখন বিএনপি বলে চলেছে, যদি অবিলম্বে সরকার তাদের দাবি মেনে না নেয় তবে অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে। লাগাতার কর্মসূচি বলতে কী বুঝায় জনগণ দীর্ঘদিন যাবত নিজেদের করুণ অভিজ্ঞতায় তা দিব্যি বোঝেন। জনগণকে তখন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের অর্থনীতি।

চলমান এহেন অচলাবস্থা দেশ ও জাতির পক্ষে চরম ক্ষতিকর অন্ধকারের শক্তিগুলির জন্যই সুযোগ এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের গণদাবির ভিত্তিতে অবশেষে বছর দুয়েক হল গুটিকয়েক শীর্ষ জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরের চরম মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। জনাকয়েকের বিচার শেষ হয়ে রায় ঘোষণা হয়েছে। এ মুহূর্তে আরও দুজনের রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী এ ট্রাইব্যুনাল ও তাদের বিচারকদেরও বেআইনি উল্লেখ করে আটক নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে দিনের পর দিন হরতাল, ব্যাপক সহিংসতা, ঘোর সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাট, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সম্পদহানি, মন্দির-গির্জা-বৌদ্ধ মন্দির প্রভৃতিতে অগ্নিসংযোগ, মূর্তিভাঙা প্রভৃতি কাজে লিপ্ত হয়েছে। এ কাজগুলি তারা পবিত্র রমজান মাসেরও করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এ মাসে তারা টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পর্যন্ত ডেকেছে।

শিগগিরই তারা বিএনপির সঙ্গে মিলিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবিতে কঠোরতর কর্মসূচি দেওয়ার জন্য পরস্পর আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়।

সরকারি দল স্পষ্টই জানে, এমন পরিস্থিতি নির্বাচন বিশেষ করে সবার অংশগ্রহণে, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অনুকূলে নয়। কিন্তু তাদের কথায় কোনো নড়চড় হতে দেখা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ তারা আহবান জানাচ্ছে প্রধান বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে। বিএনপিও তাৎক্ষণিকভাবে বলে দিয়েছে, আগামী অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব আনলেই তারা সংসদে গিয়ে আলোচনায় অংশ নেবে। নতুবা বাধ্য হবে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে।

অর্থাৎ কথার চাতুর্যে কেউ কমে যাচ্ছেন না। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুনির্দিষ্ট পথে কেউই অগ্রসর হচ্ছেন না। সংসদে গিয়ে আলোচনার আগে কেন বাইরে বসে পরস্পর আলোচনা হবে না– সংলাপ হবে না– সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করা হবে না তা বোধগম্য নয়।

বিয়াল্লিশ বছর হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, এ জাতীয় নির্বাচনি সংকট ও দলগুলির ও তাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাহীনতা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি!

এটাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয়।

রণেশ মৈত্র : লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।