আরেকটি কালো আইনের হাতছানি

আরিফ জেবতিক
Published : 27 August 2013, 04:50 AM
Updated : 27 August 2013, 04:50 AM

কিছুদিন আগে কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। মূলত প্রজন্ম চত্ত্বরের গণজাগরণ বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে তারা আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে তাদের একজন বেশ খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, ''আমরা জেনেছিলাম তুমি বাংলাদেশের একজন ব্লগার। কিন্তু তোমার কোনো ব্লগ আমরা খুঁজে পাইনি!''

এ কথার উত্তর দেওয়া আমার জন্য আরও বেশি বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াল। তারপর আমি কিছুটা রাখঢাক করে বললাম, ''বর্তমান অনিশ্চিত পরিবেশে যেহেতু ব্লগাররা গ্রেফতার হচ্ছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবমাননাকর ভঙ্গিতে আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই তাদের জনসম্মুখে দাগী অপরাধী হিসেবে ছবি তুলে মিডিয়ায় দিচ্ছে এবং একাধিকবার আমার গ্রেফতারের গুজবও রটেছে– তাই ব্যক্তিগত হয়রানির আশংকা থেকে আমি ব্লগে লেখালেখি বাদ দিয়েছি। আমার সব পুরোনো ব্লগ আমি আর্কাইভ করে রেখেছি।''

প্রশ্নকর্তা পাল্টা জানতে চাইলেন, ''এতে করে কি হয়রানি থেকে একজন ব্লগার বাঁচতে পারবেন?''

আমি এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিইনি।

আমার ধারণা ছিল রাজনৈতিক হাঙ্গামা কিছুটা থিতু হলে, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কিছু ধারা-উপধারা নিয়ে আমরা জোরেশোরে কথা বলা শুরু করব। যেহেতু বর্তমান সরকার নিজেদের 'ডিজিটাল সরকার' হিসেবে দাবি করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে এ আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর তাদের ধরিয়ে দিলে তারা সেগুলো সংশোধন করতে এগিয়ে আসবেন।

কিন্তু হা হতোস্মি!

চারদলীয় জোট সরকারের সময় করা অস্পষ্ট ও হয়রানির সুযোগ রাখা আইনটি সংস্কার তো দূরের কথা, বর্তমান সরকার সে আইনের ব্যবহারিক প্রয়োগ সংক্রান্ত সব অসুবিধা জারি রেখেই আইনটি আরও কঠোর করার নামে ক্ষেত্রবিশেষে নিবর্তনমূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯ আগস্ট, ২০১৩ মন্ত্রিসভার বৈঠকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়েছে এবং সর্বনিম্ন শাস্তির মেয়াদ রাখা হয়েছে ৭ বছর।

সরকার আইনটির খসড়া তৈরির সময় এ সংক্রান্ত কোনো গণশুনানি করেছেন বলে আমার জানা নেই। এখন ভেটিংয়ের সময়ও এ রকম কোনো পরিকল্পনা আছে বলে শুনিনি। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ দল, বিভিন্ন ব্লগ সাইট ও ব্লগার, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কোনো মতবিনিময় হয়নি। যার ফলে আইনটি অন্য আরও দশটি আইনের মতোই ড্রাফট হয়েছে, কিন্তু ব্যবহারিক সমস্যাগুলোর কথা বিবেচনা করা হয়েছে বলে মনে হয় না।

বিশেষ করে ৫৭ ধারার কথাটি আমি আরেকবার বলতে চাই। এ ধারায় বলা হয়েছে, ''ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তার কারণে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।''

এটি স্পষ্টীকরণ করা না হলে ভবিষ্যতে এটি মতপ্রকাশের অধিকারে বড় আকারে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের যুগে একে ব্যবহার করে অপরাধের মাত্রাও বেড়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে অপরাধ চিহ্নিত করার নামে ব্যক্তি-হয়রানির সহজ পন্থাগুলো কীভাবে বন্ধ করা হবে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা এখন পর্যন্ত কোথাও দেখিনি।

এ আইনে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেটি হচ্ছে এ অপরাধে এখন পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। পুলিশের গ্রেফতার-বাণিজ্য সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন পুলিশের এ ক্ষমতা দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের উপর কত বড় ঝুঁকির সুযোগ তৈরি করবে।

এছাড়া আইনে এসব অপরাধকে জামিন-অযোগ্য করা হয়েছে। ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা প্রভাবশালী মহল, যাদের মুক্ত করে দিলে মামলার প্রমাণাদি নষ্ট হতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে জামিন-অযোগ্য ধারা আইনে সন্নিবেশিত করার প্রয়োজনীয়তা হয়তো আছে– কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কি এমন কোনো অপরাধের কথা বলা হয়েছে যেখানে অভিযুক্তকে জামিন দিলে বড় কোনো সমস্যা হবে? বিষয়টি বিচারকের প্রজ্ঞার উপর ছেড়ে দিলেই কি ভালো হত না?

এ আইনের বড় সমস্যা তৈরি হবে ইন্টারনেটে বিরুদ্ধমত দমন করতে। যে কোনো ব্যক্তির নামে ভুয়া একটি ব্লগ কিংবা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে বেআইনি লেখালেখি ঢুকিয়ে দিয়ে সহজেই হয়রানি করা যাবে। যেহেতু আইনে জামিনের কোনো বিধান নেই, তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলেও ততদিন জেলে পচে তার ব্যক্তিজীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের আমলারা তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ নন, আমাদের পুলিশ বাহিনী এ ধরনের তদন্ত করার ক্ষেত্রে পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করতেও পারেনি। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানির বেলায় তাদের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত।

এছাড়া এ ধারার কারণে দেশের বিকাশমান অনলাইন সাংবাদিকতাও হয়রানির মুখে পড়বে। যদি একটি মিথ্যা খবর পত্রিকায় ছাপিয়ে দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সে সাংবাদিকের জামিনের সুযোগ আছে; কিন্তু একই খবর অনলাইনে দেওয়া হলে সাংবাদিকের জামিনের সুযোগ নেই। নিঃসন্দেহে এক যাত্রায় পৃথক ফল কোনো সামাজিক ন্যায়বিচার হয় না।

আইন করার আগে এর প্রায়োগিক দিকগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। নিকট অতীতে, বিশেষ করে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন জরুরি অবস্থায় দেশের মিডিয়াগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে তখন এদেশের তরুণ সমাজই ব্লগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে জনমত সংগঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে যুদ্ধাপরাধী চক্র যখন কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিথ্যাচার করে গেছে তখন এ তরুণ গবেষকরাই বারবার সে বিকৃতি রুখে দাঁড়িয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে এদের সকলেই হয়রানির মুখোমুখী হবেন, এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কোনো সুযোগ নেই।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনলাইনে এখন যথেচ্ছা মিথ্যাচার চলছে। ব্যক্তি-হয়রানি, ফটোশপের মাধ্যমে ছবি বিকৃত করে রাজনৈতিক প্রচারণার নামে উস্কানি প্রদান– এসব এখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব বন্ধে আইন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সে আইন হতে হবে অনেক নিখুঁত এবং স্পষ্ট। আইনের প্রয়োগ কারা করবেন এবং তাদের যোগ্যতা কীভাবে নির্ধারিত হবে সে ব্যাপারে পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে আইনের মধ্যেই। আর অবশ্যই আইনটি, বিশেষ করে ৫৭ ধারার প্রয়োগের ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য রাখতে হবে।

আইন ভালো উদ্দেশ্যেই করা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানির ক্ষেত্রে সে আইনের অপপ্রয়োগ আমাদের সংস্কৃতিতে বহুল ব্যবহৃত। সুতরাং সরকারের এ শেষ সময়ে এসে তাড়াহুড়ো করে এমন কোনো আইন তৈরি করা ঠিক হবে না, যাতে একসময় আজকের অনলাইনের মিথ্যাচারীরাই এ আইনের জোরে ব্যক্তি-হয়রানির অভিযোগ তুলে সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সাহসী তরুণদের অ-জামিনযোগ্য শাস্তিতে জেলে পুরে রাখে।

নতুবা এ বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট ব্যবহারে অপ্রয়োজনীয় কড়াকড়ির এ আইন আমাদের ইতিহাসে আরেকটি 'কালো আইন'-এর নমুনা হিসেবেই চিহ্নিত হবে ভবিষ্যতে।