হুগো শাভেজের ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’

এম এম আকাশ
Published : 24 August 2013, 11:09 AM
Updated : 24 August 2013, 11:09 AM

৫ মার্চ ২০১৩ সালে ৫৮ বছর বয়সে ভেনিজুয়েলার 'ক্যারিসমেটিক' নেতা হুগো শাভেজ মৃত্যুবরণ করেন। একদিকে ফিদেল ক্যাস্ত্রো তাঁর সম্পর্কে শোকবাণীতে বলেছেন 'তিনি যে কত মহান তিনি নিজে তা বুঝতে পারেননি'। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর শোকবাণীতে বলেছেন, 'শাভেজ ছিলেন ক্যারিসমেটিক এবং অসম্ভব জনপ্রিয় এক নেতা, তিনি তাঁর পেছনে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রেখে গেছেন'।

এই দুই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে, একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একজন প্রধানমন্ত্রী উভয়েই 'শাভেজকে' উচ্চ প্রশংসায় প্রশংসিত করছেন। কিন্তু কেন? শাভেজের প্রধান কোন বৈশিষ্ট্য তাকে সমগ্র বিশ্ব নেতৃত্বের চোখে এতখানি উচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করতে সক্ষম হল?

আমরা যদি পুনরায় মনোযোগ দিয়ে শাভেজের জীবন এবং তাঁর বাস্তব কাজগুলি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব তিনি যে 'সমাজতন্ত্রের' কথা বলেন তা ঠিক 'বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের' পরিচিত মডেলগুলির অনুরূপ নয়, আবার তা 'বিদ্যমান ধনতন্ত্রের' প্রচলিত মডেলগুলির মতোও নয়। বিদ্যমান সমাজতন্ত্রে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি রয়েছে। রয়েছে একদলীয় শাসন। শাভেজের পরম বন্ধু ফিদেলের কিউবাতেও সেটা রয়েছে। কিন্তু 'শাভেজ' প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহুদলীয় গণতন্ত্র মেনে চলেছেন। উপরন্তু তাতে যুক্ত হয়েছে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন।

একমাত্র ভেনিজুয়েলার সংবিধানেই এমন বিধান রয়েছে যে, যে কোনো সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা যদি স্বাক্ষর দিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে, তাহলে সেখানে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনের মুখোমুখী হতে হবে। আর এ বিধান মানতে গিয়ে তিনি ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনে অবর্তীণ হতে কার্পণ্য করেননি। তবে তিনি তাতে জিতেছেন। হারেননি।

তিনি জনগণের ভোটের মুখোমুখী হতে কখনওই ভয় পাননি। কারণ তিনি জানতেন যে দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বা নিচের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষের জন্য নিবেদিত তিনি এবং তাঁরাও সেটা জানেন ও তাঁরাও তাকে ভোটটি দিতে কখনও কার্পণ্য করবেন না। তাঁর কাছে তাই 'গণতন্ত্র' [স্বীয় শাসনের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি আদায়] হচ্ছে অলঙ্ঘনীয় নীতি, নিছক কৌশল নয়।

তাঁর জনগ্রাহ্য শ্লোগান হচ্ছে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের' কল্যাণের শ্লোগান। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী একনায়কত্ব বা রাষ্ট্রক্ষমতা শ্রমিকশ্রেণি কর্তৃক বলপ্রয়োগ করে দখলের তাত্বিক বিমূর্ত শ্লোগান তিনি ইচ্ছা করেই তোলেননি। ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক সমর্থনের ভিত্তিতে বৈধ করতে হবে প্রথমে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে এমনভাবে যাতে তারা নিজেরাও সেটা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারেন এবং রাষ্ট্রকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো আমলাতন্ত্র বা দল বা একক কোনো নেতা বলে না ভেবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই ভাবতে শিখবে– এটাই ছিল তাঁর নীতির মূল বৈশিষ্ট্য।

তিনি নিজে তাঁর দলকে বা কোয়ালিশনকে সবসময়ই তাই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলক হিসেবে রাখতে চেয়েছেন। অংশীদারিত্ববিহীন প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রতিনিধি ও জনগণের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটে তা তিনি ভেনিজুয়েলাতে ঘটতে দেননি বা অন্তত তা যাতে না হয় সে জন্য সর্বদাই চেষ্টা করে গেছেন।। তাই চার চারবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। আর সংখ্যালঘিষ্ঠ শোষকরা তাকে 'সমাজতান্ত্রিক একনায়ক' হিসেবে যতই প্রচারের চেষ্টা করুক না কেন তা আদৌ হালে পানি পায়নি।

আমেরিকান বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'জনগণের ভোটে নির্বাচন' এবং 'জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শাসন'। কিন্তু সেখানে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলেও অর্থনীতিতে বুর্জোয়া আধিপত্যের কারণে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি পূরণে তারা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ তা শেষ পর্যন্ত 'জনগণের জন্য জনগণের নিজস্ব শাসন' হতে পারে না।

শাভেজের গণতন্ত্রের মর্মবস্তু হচ্ছে তা একই সঙ্গে 'জনগণের ও জনগণের দ্বারা এবং 'জনগণের জন্যও' বটে। জনগণের শাসনকে হতে হবে, "Of the people, by the people and for the people"

আর বুর্জোয়া গণতন্ত্র হচ্ছে 'Of the people, by the alienated representatives of the people', এবং সে জন্যই "Not for the people"

তাই 'বুর্জোয়া গণতন্ত্রে' বাস্তব অর্থনীতিতে বুর্জোয়ার স্বার্থটা অনেক বেশি, সেখানে গণতন্ত্রের অংশ অনেক কম বা নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। পক্ষান্তরে শাভেজের স্বপ্নের 'গণতন্ত্রে'– রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ই নির্ধারিত হচ্ছে বা হতে হবে গণতান্ত্রিকভাবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র শুধু নয়, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রও বটে।

কেউ কেউ ভাবতে পারেন এর সঙ্গে মার্কসবাদী ধারণার হু-ব-হু মিল নেই। আবার কেউ বলতে পারেন মার্কসবাদে যে 'প্রলেতারীয় একনায়কত্বের' কথা বলা হয় বা তাতে যে "vanguard" তত্ত্ব আছে তা সাময়িক এবং উত্তরণকালীন প্রয়োজন হিসেবে বলা হয়, অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ণের জন্যই সেটির সাময়িকভাবে দরকার হতে পারে এবং অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ন যে মাত্রায় সুসম্পন্ন হবে সে মাত্রায় ওই রাজনৈতিক একনায়কত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে থাকে এবং পরিপূর্ণ গণতন্ত্রই অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হয়।

তাছাড়া একটি দেশে প্রলেতারিয়েত ও তাদের মিত্ররা (কৃষক) যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হন তাহলে তাদের মৈত্রীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত প্রলেতারীয় একনায়কত্ব হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, যা গণতন্ত্রেরই আরেকটি রূপ। মর্মবস্তুর দিক থেকে মার্কসবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে "Of the people, by the people and for the people" জাতীয় পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো বিরোধ নেই। বরং বিরোধ আছে পুঁজিবাদের সঙ্গে।

আমার ধারণা, পৃথিবীর অধিকাংশ কমিউনিস্ট পার্টি একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের ব্যাখ্যার দিকেই ঝুঁকছেন বা না ঝুঁকলেও অচিরেই ঝুঁকবেন। কিন্তু এদিকে ঝোঁকা আর পরিপূর্ণভাবে তা অন্তরে ধারণ করে অনুশীলন করা এক কথা নয়।

লক্ষ্যণীয় যে শাভেজ তাঁর এই পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Both formal and real Democracy) প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে 'বিপ্লব' বলে অভিহিত করেছেন। এই বিপ্লবকে তিনি কখনও কখনও 'সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব' যেমন বলেছেন, তেমনি আবার কখনও কখনও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ল্যাটিন আমেরিকান বিপ্লবী বীর সাইমন বলিভারের নামানুসারে এর দেশীয় নামকরণ করেছেন 'বলিভারীয় বিপ্লব'।

প্রথম ও দ্বিতীয় নামটির পার্থক্য নিয়ে বাম মহলে নানা বিতর্ক ও গবেষণা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কমরেড তারিক আলী লিখিত 'হুগো শাভেজ এবং আমি' নিবন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারিক আলী লিখেছেন, ''ইউরোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মতো ছিলেন না হুগো শাভেজ। তিনি ওদের মতো কখনও ভাবেননি যে কর্পোরেট পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি জনগণের অবস্থার উন্নতি ঘটাবে এবং তার এই ভাবনা ২০০৮ সালের ওয়াল স্ট্রিটের সংকটের বহু আগে থেকেই তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। তাঁকে যদি কোনো লেবেল লাগাতেই হয় তাহলে আমি তাঁকে 'সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রী' ( Socialist democrat) বলেই অভিহিত করব। আমি বলব ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা থেকে অনেক দূরে ছিল তাঁর অবস্থান, নিজেকে নিয়ে বিভোর চর্চায় মগ্ন, অন্ধ এবং গতানুগতিক রুটিনে অভ্যস্ত ছোট ছোট বাম গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা বিকর্ষিত হয়েছেন তিনি। (২০০৯ সালে) ক্যারাকাসে আমি (তারিক আলী) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলিভারিয়ান প্রকল্প থেকে কী অর্জিত হবে? এর খুবই স্পষ্ট উত্তর ছিল তাঁর কাছে। তাঁর অনেক উচ্চকণ্ঠ ভক্তদের চেয়ে অনেক সুস্পষ্ট ছিল তাঁর উত্তর। তিনি বলেছিলেন, 'মার্কসীয় বিপ্লবের গোঁড়া অনুসিদ্ধান্তগুলোকে আমি বিশ্বাস করি না। আমি এটা মনে করি না যে আমরা এখন প্রলেতারীয় বিপ্লবের যুগে বাস করছি। অনেক কিছুই সংশোধন করতে হবে। বাস্তবতা প্রতিদিন সে কথাই বলছে। আমরা ভেনিজুয়েলাতে কি বর্তমানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ বা শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি? আমি তা মনে করি না। কিন্তু এ জন্য কেউ যদি আমাকে বলেন যে এর ফলে 'তোমার পক্ষে দরিদ্রদের জন্য কিছুই করা সম্ভব হবে না, যেই জনগণ শ্রমের দ্বারা এ যাবৎ দেশের সকল সম্পদ তৈরি করেছে এবং কখনও ভুলো না যে সেই শ্রমিকদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী ছিল দাসশ্রমিক, তাদের জন্য কিছুই তুমি করতে পারবে না'– তাহলে তাদের সঙ্গে আমার মিলবে না। আমি কখনও এ কথা মানব না যে সমাজের সম্পদের পুনর্বণ্টন অসম্ভব। আমাদের ধনীকশ্রেণি এমনকি করটুকুও দিতে চান না। এ জন্যই তারা আমাকে ঘৃণাও করে। আমরা বলেছি, 'তোমাকে কর দিতেই হবে'। আমি বিশ্বাস করি এক বিরাট বিপ্লবী সেজে বিশুদ্ধ এক ব্যানারের তলে বসে কিছু না করার চেয়ে যুদ্ধ করে মরে যাওয়াও ভালো। আমার প্রায়ই মনে হয়, বিশুদ্ধ বিপ্লবীর অবস্থানটি খুবই আরামদায়ক এবং এটি আসলে এক ধরনের অজুহাত… চেষ্টা কর, তোমার বিপ্রব সাধনের, যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, সামান্য অগ্রসর হও, এমনকি এটি যদি সঠিক দিকে এক মিলিমিটার অগ্রগতিও হয়– সেটাও হবে ইউটোপিয়ান স্বপ্নের চেয়ে ভালো।''

তারিক আলী উদ্ধৃত শাভেজের এ বক্তব্যের মধ্যে বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে 'সংস্কারবাদের' বা কল্যাণমূলক পুঁজিবাদের গন্ধ পাওয়া যাবে। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে এতে রয়েছে নীতিতে নিষ্ঠাবান কৌশলে নমনীয় একজন বিপ্লবীর এক নিবেদিত ঘোষণা। এটা একশত ভাগ খাঁটি সোনা নয়, কিন্তু এতে ততটুকু খাদই মেশানো হয়েছে যা না মেশালে ভেনিজুয়েলাতে তা দিয়ে অলংকার বানানো সম্ভব ছিল না।

আসলে 'সংস্কারের মাধ্যমে বিপ্লব' এবং 'বিপ্লবের মাধ্যমে সংস্কার' দুই-ই এই বক্তব্যের মধ্যে জড়াজড়ি করে আছে। বাস্তব দুনিয়ায় পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক সূত্রটিও কিন্তু তাই। বাস্তবে পরিমাণগত পরিবর্তন এবং গুণগত পরিবর্তনের মধ্যে সর্বদাই থাকে এক দ্বান্দ্বিক ঐক্য। একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করতে গেলেই বাম অথবা ডান বিচ্যূতি ঘটে। বিপ্লব হঠকারিতা অথবা সুবিধাবাদে পর্যবসিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়।

ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের আলোচনা করে এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি শেষ করব। 'বলিভারীয় বিপ্লব' কীভাবে মাত্র বিশ বছর সময়ে (১৯৯২-২০১২) জনগণের আস্থা অর্জন করে ক্ষমতা গ্রহণ করে ভেনিজুয়েলায় অর্থনীতির গণতন্ত্রায়নের পথে যাত্রা শুরু করল, সেই প্রশ্নটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর আলোচনার দাবি রাখে। এটা শাভেজের পক্ষে সহজেই সম্ভব হয়েছিল।

কারণ তিনি ১৯৯২ সালে মিলিটারি ক্যু'র মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ হয়ে দুই বছর কারাবাস করে ১৯৯৪ সালে যখন বেরিয়ে এলেন তখন গড়ে তুললেন 'ভেনিজুয়েলার সোশ্যালিষ্ট পার্টি' যার মূল এজেন্ডা তিনি নির্ধারণ করলেন- ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদের উপর ভেনিজুয়েলার জনগণের কর্তৃত্ব স্থাপন। জাতীয় সম্পদের উপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই এজেন্ডাই তাঁর দলকে তীব্রভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও ভেনিজুয়েলার সাম্রাজ্যবাদী তেল কর্পোরেশনের এলিট কর্মচারী ও বহুজাতিক দুই শেয়ারহোল্ডার (কনকো ফিলিপ ও এক্সন) কোম্পানির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী এক নম্বর দলে পরিণত করে। এরপর তিনি মাত্র ৬ বছরের মধ্যে হয়ে উঠলেন জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ভেনিজুয়েলা হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তেলের রিজার্ভের অধিকারী (প্রায় ১.৩৬ ট্রিলিয়ন ব্যারেল)। এত তেল সম্পদ নিয়ে এত দরিদ্র থাকার ট্র্যাজিডি ভেনিজুয়েলাবাসী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই সহজেই এই তেল এজেন্ডা নিয়েই ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শাভেজ জিতলেন। জেতার পরপরই প্রথমে বিদেশি বিনিয়োগকারী তেল কোম্পানির রয়্যালটির হার ১৬ গুণ বৃদ্ধি করলেন তিনি। তারা তাতে রজি না হলে বিনা দ্বিধায় ভেনিজুয়েলার সর্ববৃহৎ তেল কোম্পানিটিকে (PDVSA) তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত করলেন। এরপরই তেলের থেকে বিপুল অর্থ তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আনতে সক্ষম হলেন।

এর পেছনে একটা বড় কারণ ছিল। এই সময় বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু-হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অর্থনীতির পরিভাষায় আমরা যাকে বলি 'Windfall again' (অপ্রত্যাশিত লাভ) সেটি ভেনিজুয়েলার কপালে জুটে যায়। বিদেশি কোম্পানি ও তাদের উচ্চ বেতনভুক্ত এলিট কর্মচারিবৃন্দ, তেল বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা সকলেই তখন ভেবেছিলেন যে এই 'রাষ্ট্রায়ত্ত তেল' কারখানাটি দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে ব্যর্থ হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম তারা এই জাতীয়করণকে ব্যর্থ করার জন্য ধর্মঘটও করেছেন।

কিস্তু তেল কোম্পানির বাইরে অবস্থিত ভেনিজুয়েলার বিপুল দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাভেজকে আশ্বস্ত করেছেন এবং এই সংগ্রামে সর্বদাই বিপুল আত্মত্যাগসহ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কারণ তাঁর অন্যতম স্ট্র্যাটিজি ছিল তেলের টাকা দরিদ্রদের সামাজিক কল্যাণের জন্য ব্যয় করা। ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে সামাজিক কল্যাণের ব্যয় ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। জনগণও শাভেজের পক্ষে দাঁড়ায়। তেলের লড়াইয়ে জনগণের দৃঢ়তা থেকে শাভেজ তার মনোবল শক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই প্রক্রিয়ার একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে কমরেড তারিক আলীর স্মৃতিকথায়। শাভেজ স্বয়ং তাকে বলছেন, ''আমার মনোবল দুইটি কারণে টিঁকে ছিল। প্রথমত, সারা দেশের মানুষ আমাদের পক্ষে ছিলেন। আর যখনই অফিসে কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়তাম তখনই আমি একজন মাত্র পাহারাদার ও দুজন সাথীকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়তাম। আমি এইভাবে মানুষের কাছে গিয়ে মানুষের কথা শুনতে চাইতাম। সেইসব কথাই আমার উদ্দীপনা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। একবার এক মহিলা আমাকে বলল, 'শাভেজ তুমি আমার সাথে এসো, তোমাকে আমি একটা জিনিস দেখাব'। আমি তাকে অনুসরণ করে অতিক্ষুদ্র এক ডেরায় প্রবেশ করলাম। তার স্বামী ও সন্তানেরা ওই ঘরে তাদের খাবার স্যুপটি রান্নার জন্য অপেক্ষা করে বসেছিল। মহিলাটি আমাকে বলল, 'শাভেজ দেখ, আমরা আজ রান্না করার জন্য জ্বালানি হিসেবে আমাদের শোবার খাটের পিছনের অংশটা ব্যবহার করেছি। আগামীকাল আমি খাটের পাগুলো পুড়িয়ে রান্না করব। তার পরের দিন টেবিল, তার পরের দিন চেয়ার, তার পরের দিন দরজা পুড়াব। এরপরেও আমরা বেঁচে থাকব। তুমি কিন্তু এখন কোনোভাবেই এই শয়তানদের কাছে হার মেনো না।' এ কথা শুনে আমি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, পথে তরুণ ছেলেপেলের দল আমাকে ঘিরে ধরে করমর্দন করে বলেছিল– 'আমরা বিয়ার পান ছাড়াই থাকব কিন্তু You make sure you screw the mother fuckers' " (এটির বঙ্গানুবাদ বোধগম্য কারণেই করছি না– লেখক)।

ভেনিজুয়েলার সাধারণ দরিদ্র জনগণের এই যে দৃঢ়তা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের প্রতি তীব্র ঘৃণা– সেটাই ছিল শাভেজের ব্যক্তিগত উদ্দীপনা ও শক্তির অন্যতম উৎস।

শাভেজ কিন্তু জনগণকে তার ন্যায্য পাওনা পৌঁছে দিতে ভুলেননি। বিশ্ব ব্যাংকের পণ্ডিত অর্থনীতিবিদেরা তাকে বলেছিল, তেলের টাকা তেলেই নিয়োগ করতে অথবা আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড কিনে রাখতে, তিনি তা শুনেননি। বরং আমেরিকান ট্রেজারি বন্ড ভাঙিয়ে ২০ বিলিয়ন পেট্রোডলার প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন শাভেজ। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থা তেল কোম্পানিগুলি যখন একে একে তাদের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি ভেনিজুয়েলা থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল তখন তিনি ভয় না পেয়ে চীন এবং ইরানকে ভেনিজুয়েলাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলে তারা উৎসাহভরে এগিয়ে আসে।

এভাবে ভূ-রাজনীতিকেও তিনি বিপ্লবের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন। বিশাল উদ্বৃত্ত তেল-অর্থের একাংশ তিনি ব্যয় করেছেন ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বিপ্লবে সাহায্য করার জন্য। গড়ে তুলতে চেয়েছেন নতুন লাতিন আমেরিকান আঞ্চলিক ব্যাংক। কিউবাতে সস্তায় ভর্তুকি দিয়ে তেল সরবরাহ করে বিনিময়ে সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার ডাক্তার এবং তাদের সাহায্য নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিস্তৃত সামাজিক স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক। তৈরি করেছেন বস্তিবাসীর জন্য লক্ষ লক্ষ পাকা বাড়ি। গরিব মানুষের জন্য ব্যবস্থা করেছেন স্বল্পব্যয়ে খাদ্যের, বিশুদ্ধ পানীয় জলের এবং বিদ্যুতের।

ভেনিজুলেয়ার অতিদরিদ্র যে পাহাড়ী মানুষরা পাহাড়ের ঢালে উঁচুতে বসবাস করত তারা যাতে সহজে এবং দ্রুত রাজধানীতে আসতে পারে তাই তাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন 'কেবল কার' (বৈদ্যুতিক তারের গাড়ি)। এসব ব্যবস্থার ফলে ভেনিজুয়েলায় দারিদ্র্যের হার ১৯৯৬ সালের ৭১ শতাংশ থেকে ২০১২ সালে ২১ শতাংশে নেমে এসেছিল।

১৯৯৬ সালে ভেনিজুয়েলায় প্রতি ১০,০০০ লোকের জন্য ছিল ১৮ জন ডাক্তার। আর ২০১২ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ জন। ভেনিজুয়েলাতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের হার (গিনি সহগ) ৫১ শতাংশ কমে বর্তমানে সমগ্র লাতিন আমেরিকার মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনকি কিউবার চেয়েও কম! আর প্রতি তিনজন নাগরিকের মধ্যে একজনের জন্য শাভেজ ফ্রি শিক্ষার (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত) ব্যবস্থা করেছেন।

সুতরাং শাভেজ তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবতায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তেলের উদ্বৃত্ত সম্পদের কারণেই সেটি এত সহজে সম্ভব হয়েছে। শাভেজ অনেক বক্তৃতায় ঠাট্টা করে হাসতে হাসতে তাই বলতেন, ''আমার সমাজতন্ত্র হচ্ছে 'তেল সমাজতন্ত্র' (Oil Socialism)''।

এ কথা ঠিক যে শাভেজের বলিভারীয় বিপ্লব ভেনিজুয়েলার বিশেষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সফল ও কার্যকর হয়েছে। তাই বলে তার থেকে কি কোনো সাধারণ শিক্ষা আমরা পেতে পারি না? পারি। সেটা হচ্ছে সকল গৎবাঁধা ফর্মুলা থেকে মনকে মুক্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তির উপর আস্থা রেখে তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে বসতে হবে। তারা জরুরিভাবে বর্তমান মুহূর্তে সবচেয়ে আগে কোন বিষয়টি চাচ্ছেন সেটা তাদের মুখে শুনতে হবে। তারপরে তাদের জন্য জনপ্রিয় এবং বাস্তবানুগ উন্নয়নের কর্মসূচি প্রণয়ন করে লড়াই করেই তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।

সেই লক্ষ্যে কোথাও 'এক মিলিমিটার' এগোনোর সুযোগ পেলেও সেই সুযোগকেই কাজে লাগাতে হবে। তবে পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে সব দেশের কিন্তু ভেনিজুয়েলার মতো অঢেল তেল সম্পদ নেই যা দিয়ে আমরা রাতারাতি জনগণের জীবনযাত্রার মান মৌলিকভাবে বদলে দিতে পারব, বিশেষ করে তখন ভেনজুয়েলায় তা সহজেই সম্ভব হয়েছিল কারণ সৌভাগ্যক্রমে বিশ্ববাজারে তেলের দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

কিন্তু তেল না থাকলেও আমাদের বিশাল জনসম্পদ রয়েছে। যার ৬০ শতাংশই তরুণ এবং তারা এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য যে কী করতে পারে তা বাংলাদেশের কৃষক, গার্মেণ্টস শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক এবং দেশপ্রেমিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে খোলা চোখে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এই বিশাল উৎপাদনশীল নিম্নবর্গের শ্রেণিশক্তির আস্থাভাজন একটি গণমুখী বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। তবে বামপন্থীরা পরিকল্পিতভাবে এবং সঠিক কৌশলে সচেষ্ট হলে তা দ্রুতই সম্ভব বলে মনে হয়।

বাংলাদেশ এখন সেই প্রসববেদনা থেকেই ছটফট করছে।

এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।