বখাটেপনা ও যৌন হয়রানি

আহমদ রফিক
Published : 14 August 2010, 12:55 PM
Updated : 14 August 2010, 12:55 PM

'ইভ টিজিং' কথাটাতে আমার আপত্তি ইংরেজি বলে নয়, আরও একাধিক কারণ। বিশেষ করে এজন্য যে এসব ঘটনা তো সাদামাঠা 'টিজিং' বা বিরক্ত করা নয় বরং যৌন তাড়নায় কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা এবং এতটাই যে তা সহ্য করতে না পেরে তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। এ ধরনের খবর আমাকে মনে করিয়ে দেয় কয়েক বছর আগে একটি নিরীহ মেয়ের মৃত্যুর কথা। শোকাবহ ঘটনাটি উত্তর বঙ্গের। ছবিটা বড় করুণ। স্কুল ফেরতা ছাত্রীটিকে ঘিরে দুই তরুণ ষণ্ড, হয় তো বা তুলেই নেবে। কিছুতে পথ ছাড়ছে না, ঘরে ফিরতে দেবে না তাকে। উত্ত্যক্ত, ভীত, দিশাহারা মেয়েটি কোনো উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত সামনের পুকুরে ঝাঁপ দেয়, আর ওঠে না।

আইনের ভাষায় এটাই বোধ হয় 'প্ররোচনা মূলক আত্মহত্যা' যা হত্যাকাণ্ডের নামান্তর। এর পর পরই এই ধরনের কয়েকটি নিরীহ মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা কাগজে বেরিয়েছে। তবে বিষ খেয়ে ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে। অপরাধী তরুণের শাস্তি হয়েছে কি না জানি না। না হবার কথা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা স্থানীয় প্রভাবশালী বা ধনী পরিবারের বখাটে, নষ্ট চরিত্রের সন্তান। তাই রাজনৈতিক বা অর্থের প্রভাব খাটিয়ে প্রায়ই এরা পার পেয়ে যায়। এসব ঘটনা সমাজে আলোড়ন তোলেনি।

হয় তো সমাজটা পুরুষশাসিত বলে। ইদানিং অনুরূপ বেশ কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজে লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। এতগুলো মৃত্যু সমাজে কোনো আলোড়ন তোলেনি। এসব খবর পড়তে কষ্ট হয়। তাই আজকাল শিরোনাম পড়েই রেখে দেই। আর মনে হয় মেয়েগুলো এত অবুঝ কেন যে অপরাধীকে শাস্তি দেবার বদলে নিজেই অপরাধী সেজে নিছক আবেগের বশে বা রাগের মাথায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। প্রতিবাদ বা লড়াইয়ের কথা ভাবে না। হোক না তার শক্তি কম। মরতেই যদি হয় তবে লড়াই করে মরাই তো ভালো।

প্রতিবাদী মৃত্যু সম্মানের, পরাজয়ের নয়। এ ধরনের মৃত্যু বখাটেদের আরও সাহসী করে তোলে, অন্যায়ে আরও উৎসাহিত করে তোলে। মনে পড়ে, পঞ্চাশের মন্বন্তরের মৃত্যু নিয়ে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সাদামাঠা গল্প 'ছিনিয়ে যায়নি কেন'। অর্থাৎ মৃত্যুর মুখে সাহসী তৎপরতার জন্য আহ্বান। এসব ছাত্রীর অভিভাবকরাই বা কেমন? তাদের উচিত উত্ত্যক্ত সন্তানদের মানসিক সাহস জোগানো, পাশে দাঁড়ানো, উদ্যোগী হয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া। কিংবা সন্তানকে মানসিক পীড়নের অন্ধকার ভুবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখানো। সমাজে কি এমন একজন মানুষ নেই যার কাছ থেকে এ জাতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর সমর্থন পাওয়া যেতে পারে।

আমাদের সমাজ কি বর্বর আদিম যুগে ফিরে গেছে যে, যে যেমন খুশী নির্বিবাদ অন্যায় করে চলবে, কেউ বাধা দেবে না। কিংবা প্রতিবাদ প্রতিরোধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়াবে না। এমন কথাই তাহলে মেনে নিতে হবে যে সমাজ সুস্থ্য, মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বিকৃতবোধেরই প্রাধান্য যে জন্য একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রে নীতি নিয়ম আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন একই ধরনের অন্যায় ঘটে চলেছে। প্রতিদিন কাগজের পাতায় পড়ি শুধু বখাটেপনা নয়, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ও শ্বাসরোধে হত্যার মত ঘটনাবলী।

সমাজের দুর্বল সদস্য নারীর প্রতি নিয়ত অন্যায়, চরম অন্যায় ঘটে চলেছে। এ সমাজে কি 'সবলা' নারী জন্ম নেয়নি যে এ ধরনের যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারে? কিংবা নেই কোন আদর্শবাদী তরুণ বা পরিণত বয়সী মানুষ যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় পায় না। হয় তো নেই। যাঁরা আছে তারা ভয়ের দেশে লুকিয়ে থাকে। ভোগবাদে আচ্ছন্ন সমাজে অন্যায় ও নির্যাতনের শিকার নারী-কিশোরী, তরুণী, গৃহবধূ এমন কি নিষ্পাপ শিশু। অবশ্য এর পাশে রয়েছে বিপথগামী যুবক। উগ্র সন্ত্রাসী রয়েছে। সমাজের দুর্বল শ্রেণী যারা আমাদের আত্মপরায়ণ, ভোগবাদী সমাজে অন্যায় ও পীড়নের শিকার। আমাদের সমাজ বিশ্লেষকগণ বলে থাকেন বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, লোভ, দুর্নীতি, মুনাফার বাণিজ্যিকীকরণ সমাজটাকে মূল্যবোধহীন করে তুলেছে; লোভের, লাভের মুক্তবাজারে পরিণত করেছে।

ভোগবাদিতার তাড়নায় মূল্যবোধ পালিয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বে ভোগও একটি পণ্য যা যে কোনো মূল্যে কেনা যায়। এমন সমাজে সুস্থ্য সরল জীবন দাঁড়াতে পারার কথা নয়। আদর্শবাদী জীবন তো নয়ই, সে ফেরারি না হয়ে থাকলেও কোণঠাসা, দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে গেছে। এ সমাজে সংস্কৃতিও পণ্য। সমাজের বিত্তবান শ্রেণী মুনাফাবাজী ও দুর্নীতির মাধ্যমে হঠাৎ ধনীরা ওই বিকিকিনির বাজারে বড় খরিদ্দার। ভোগ-বিলাসিতা ও অপসংস্কৃতির টানে পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে করে তুলেছে পণ্য। নারী পণ্য শুল্কা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। ফ্যাশন শো, বিনোদন মডলের বড় আকর্ষণ নারী।

ইন্টারনেটের মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যেও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, কখনো 'ফেসবুক'-এর মাধ্যমে। গোটা ব্যবস্থাটাই যেন অনৈতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আপত্তিকর বিজ্ঞাপন, বিনোদনের নামে অর্ধনগ্ন অশালীন নাচ গানের দৃশ্য, হিন্দি ছবি বা সিরিয়ালের মুক্ত যৌনতা, বিনোদন পত্রিকার নগ্ন ছবি (প্রধানত বিদেশে, যেমন প্লেবয়, লুক ইত্যাদি) তরুণ মনে অসুস্থ্য প্রভাব ফেলে।

এর সঙ্গে নতুন উপদ্রব মাদকাসক্তি, বিশেষভাবে তরুণ-তরুণীদের অসুস্থ্য জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পারিবারিক সচেতনতার অভাব, ভাঙা পরিবারের বিশৃঙ্খল জীবন, অপসংস্কৃতির চর্চা সব কিছু মিলে সমাজে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নৈতিক দূষণের বড় আঘাতটা সহ্য করতে হচ্ছে নারীকে এবং তা বয়সের হিসাব না মেনে। বখাটেদের যৌন অনাচার এ সবেরই একটি অংশ।

আমরা অস্বীকার করতে পারি না এমন মতামত যে বোম্বাই ছবির চটুল যৌনতাধর্মী আচরণ, শো-ফ্যাশনের আকর্ষণীয় শরীরী দৃশ্যাদি যৌনতাধর্মী বখাটেপনার বড় প্রেরণা। অনেক রসদ রয়েছে সেখানে যা তরুণ মনকে তাতায়। সে তাড়না প্রকাশের পথ খোঁজে।

নিরীহ কিশোরী বা সামাজিক মর্যাদার সমর্থনহীন তরুণীরাই ওইসব বখাটেদের হাতে যৌন হয়রানির অসহায় শিকার। এমনকি কর্মজীবী সুদর্শনারাও যৌন হয়রানির শিকার, কখনো যৌন নির্যাতনের। মর্যাদাবোধ, পারিবারিক সম্মান রক্ষার দায়ে অনেক সময় সে সব ঘটনা বাইরে প্রকাশ পায় না। যা পায় তা জলে ভাসমান বরফের দৃশ্যমান সামান্য অংশ মাত্র। দুঃখজনক যে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায়তন পর্যন্ত এ ধরনের অনাচার থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত নয় অসুখী দাম্পত্য জীবনের পরিবারও। নিত্য এমন বহু ঘটনার সামান্য কিছু আমাদের সামনে নিয়ে আসে সংবাদপত্রের পাতা। যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত।

এ বিষয়ে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক ব্যবস্থা অনেক গুরুত্ব বহন করে। এক্ষেত্রে দরকার সুস্থ্য পারিবারিক পরিবেশ এবং পারিবারিক সুশিক্ষা যা পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানদের মধ্যে সুস্থ্য নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাবে। মূল্যবোধহীন সমাজ, আধুনিকতার নামে একান্তই ভোগবাদী সমাজ সুস্থ্য তারুণ্যের
বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাই পরিবারের মতো সমাজের ভেতরেও দরকার সুস্থ্য পরিবেশ। এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে তাতে দরকার সমাজের আগপাশতলায় পরিবর্তন, যা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। একটি সামাজিক রেনেসাঁসের খুবই দরকার ছিল আমাদের।

সে অভাব পূরণ করতে অন্তত দরকার সুস্থ্য সংস্কৃতিচর্চা। চার দেয়ালে আবদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা নয়, দরকার মুক্ত অঙ্গনে সংস্কৃতিচর্চার মুক্ত প্রকাশ। যা তৈরি করবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে কতটা ফলপ্রসূ সে উদাহরণ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ধরা রয়েছে। সুস্থ্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রভাবে সৃষ্ট সামাজিক আন্দোলনই পারে আকাঙ্ক্ষিত সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে।

পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমাদের সমাজকে যদি ইতিবাচক কিছু উপহার দিয়ে থাকে, এবং তা দিয়েছে বলেই ইতিহাসের সাক্ষ্য, তাহলে সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলন বা নব রূপায়ণ সম্ভব হবে না কেন? অবশ্যই তা সম্ভব। আর তা সম্ভব করতে দরকার আদর্শবাদী সংস্কৃতিকর্মীর সমন্বয়ে গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন–সুস্থ্য আধুনিকতার সংস্কৃতি চর্চা, নিজস্ব ঐতিহ্যনির্ভর সংস্কৃতি চর্চা, একদা চর্চিত গণসংস্কৃতির নবায়ন যা সামাজিক মূল্যবোধের নব নির্মাণে সহায়তা করবে। চল্লিশের দশকে অল্প সময়ের জন্য হলেও সংস্কৃতির শক্তিমান রূপ আমরা দেখেছি।

তাই বলতে হয় সে সব ঐতিহ্য আমাদের সহায়। শুধু সেখান থেকে যথাযথ উপাদান তুলে আনতে হবে, ব্যবহার করতে হবে সমকালের উপযোগী করে। না হলে গ্রহণযোগ্য হবে না নতুন প্রজন্মের কাছে।

শেষ কথা হল, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের যথাযথ বিচারের জন্য সঠিক আইন প্রণয়ন ও আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার খুবই জরুরি। কিন্তু তার পরও সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা অধিকতর জরুরি। চিকিৎশাস্ত্রে ওই যে বলে না 'প্রিভেনশন বেটার দ্যান কিয়ার,' সেটাই আসল কথা। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এই তিনে মিলে সুস্থ্য পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বখাটের হাতে যৌন হয়রানি বন্ধ হতে পারে। কিন্তু সে কাজের জন্য কাউকে না কাউকে, একা নয় সংঘবদ্ধভাবে, এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক পরিবর্তনের কাজ মোটেই সহজ নয়।