১৫ আগস্ট: একটি সতর্কবার্তা

মুহাম্মদ শামসুল হক
Published : 1 April 2011, 02:01 PM
Updated : 14 August 2013, 07:00 PM

বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাময় শোকাবহ দিন ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত দিবস। ১৯৭৫ এর এই দিনে খুব ভোরে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও উচ্চাভিলাষী সামরিক ব্যক্তি তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী চক্রের সহায়তা, আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ওই চক্রের দালালদের প্রশ্রয় এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু কথিত প্রতিবিপ্লবী অতি বাম নামধারী ব্যক্তির নীল নকশার ভিত্তিতে ওই হত্যাকান্ড সংঘটিত করা হয়। চক্রটি শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তৃপ্ত ছিল না। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্য-সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, এমনকি ছয়-সাত বছর বয়সী শিশু রাসেলসহ নিকটাত্মীয়, যাঁদের হাতের নাগালে পেয়েছে তাঁদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা হয়তো নিশ্চিত করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর রক্তের কোনো উত্তরসুরী যাতে আবির্ভূত না হন। তবে ভাগ্যের জোরে সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় ঘাতকের বুলেটের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

যে মানুষটি তাঁর দেশের সাড়ে সাত কোটি (তখনকার দিনে) মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে জীবনের সোনালী দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছিলেন নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে, সহ্য করেছিলেন বছরের পর বছর কারাভোগসহ অমানুষিক নির্যাতন, যিনি দেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন এবং সবশেষে '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির সেলে তৈরি ছিলেন প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য। সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কেন হত্যা করা হলো তার উত্তর ইতিমধ্যে জনগণের জানা হয়ে গেছে।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ঘাতকচক্র ও ঘটনার বেনিফিসিয়ারিদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, স্বীকারোক্তিমূলক দম্ভোক্তি, খুনিদের বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি এবং হত্যাকারীদের দফায় দফায় পুরস্কৃত করার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়, কারা ছিলেন এই জঘন্য ঘটনার পেছনে। পঁচাত্তরের পর থেকে বিভিন্ন সময় (১৯৯৬-২০০১ এর জুলাই পর্যন্ত এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বাদে) রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং পাকিস্তানি ভাবধারার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পুনর্বাসনের চেষ্টা চলে। এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে এই হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্যও। স্বস্থির কথা হলো সব নেতিবাচক অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়ে বর্তমান সরকার আদালতের রায়ে হত্যাকারীদের বিচারের রায় প্রায় বাস্তবায়ন করেছে। কতিপয় খুনি দেশের বাইরে পলাতক থাকায় তাদের শাস্তি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অবশ্য ঘটনার নেপথ্য নায়কদের অনেকেও বিচারের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন, হয়তো আপাত তথ্য-প্রমাণের অভাবে।

ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু এবং ঘটনার নায়কদের মুখোশ উন্মোচনের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু লোক প্রশ্ন তোলেন, 'অতুলনীয় জনপ্রিয় এই নেতার হত্যাকাণ্ডের পরপরই উচ্চকণ্ঠে কেন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হলো না?' তাঁরা বোঝাতে চান যে, ৭৫ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এতই কমে গিয়েছিল, যে কারণে তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কারো চোখে এক ফোঁটা জল আসেনি। কেউ প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি!

আসলে কি তাই হয়েছিল? বিষয়টি কিছুটা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে মূলত এ ধরনের মন্তব্য বা প্রশ্ন যাঁরা করেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন না বলে তাঁর জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বকে খাটো করে তাঁর মর্যাদাকে নিচে নামাতে চান।

দেশের সচেতন মানুষ জানেন সেদিন কী হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সেদিন 'অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর' অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল দেশব্যাপী। সে সময়ের রাজনৈতিক ও ভয়ঙ্কর সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আকস্মিকতায় অনেকের মধ্যে প্রথমেই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল-বঙ্গবন্ধুকে আসলেই হত্যা করা হয়েছিল কি না? ঘটনার কথা শুনে কুচক্রী গোষ্ঠী, উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক ও '৭১ এর পরাজিত শক্তির দোসররা ছাড়া সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বোবা কান্না ও দীর্ঘশ্বাস দেখা গিয়েছিল। অনেকেই প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে উঠে বিক্ষিপ্ত হলেও বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। তবে তা সামরিক জান্তার ভয়ে প্রচার পায়নি।

সেদিনের মানুষের মনের অবস্থা বোঝা যায় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ধৃতি থেকে। ড. মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন '… সেদিন আমরা শোকে, দুঃখে, বেদনায় ও কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। আমাদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। শুধু চোখভরা পানি। আমি ছিলাম তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা। সকালেই যখন খবর পেলাম তখন কি ভাবব, কি করব সবই যেন ভুলে গেলাম। …যেন সমগ্র দেশ, সমগ্র জাতি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে।'

শিল্পী হাশেম খানের অভিজ্ঞতা আরও মর্মস্পর্শী 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে? প্রথম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম মনে ও চিন্তায়। একেই বলে আঘাত। বাংলাদেশের মুক্তিদাতা যাঁকে আমরা সম্মান দিয়েছি জাতির পিতারূপে, বঙ্গবন্ধু নামে, তাঁকেই হত্যা করেছে কয়েকজন সাধারণ সৈন্য? ঘুম থেকে উঠে এমন একটি খবর যা বেতারে বার বার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল এতদিন পর ভাবতে গিয়ে শুধু বলতে পারি মানুষের মনের অবস্থা কখনো কখনো এমন হয়, যা শুধু অনুভবই করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, … সেদিন তাৎক্ষণিক মুহূর্তে যাকেই পেয়েছি, আমার মনের অবস্থা জানিয়েছি। অনেকেই বিশ্বাস করেনি, আমি খামোকাই এসব অশুভ চিন্তা করছি।'

আমিরুল ইসলামের গল্প থেকে, 'সেদিন স্তব্ধ মৃতপুরীর মতো এই নগর। হিংস্র, রক্তপিপাসু হায়েনার দল কোথাও কোথাও ভীরু সন্ত্রাসীর ন্যায় ট্যাংকের বহর লইয়া ছুটিতেছে। শোকগ্রস্ত নগরবাসী কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। কি করিব, কোথায় যাইবে? অকস্মাৎ সকল কিছু বিমূঢ় হইয়া গিয়াছে। যেন মরণ আসিয়া নীরব করিয়া দিয়াছে এই জনপদ। এ কী বীভৎস নারকীয় পরিবেশ? কে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া পথের দিশা দেখাইবে, কে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করিবে আগামী দিনের কর্মপন্থা?'

কলেবরের কথা ভেবে উদ্বৃতি বাড়ালাম না। তবে এসব উদ্বৃতিতে একটা কথা পরিষ্কার, বাঙালি জাতির মনটা একদিকে কোমল প্রকৃতির, আর একদিকে সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনাসমৃদ্ধ। কিন্তু যে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সুসংগঠিত হওয়া দরকার এবং এ জন্য যথাসময়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও উপযুক্ত নেতৃত্বের ডাক পড়া চাই। এদেশের জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বিভিন্ন প্রয়োজন-পরিস্থিতিতে ডাক শুনেছেন বঙ্গবন্ধুর, পেয়েছেন তাঁর যথাযথ নির্দেশনা। তাঁর অবর্তমানে বিশেষ করে '৭৫ এর ১৫ আগস্টের পরমুহূর্তে প্রতিবাদী চেতনার মশাল জ্বালানোর মতো বজ্রকণ্ঠ, মুক্ত নেতা দেশে ছিলেন না। ছিল না তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সমন্বিত প্রস্তুতিও।

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনছুর আলী, কামরুজ্জামানসহ যে কজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন, যাঁরা অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কৌশল নির্ধারণ এবং সাধারণ নেতাকর্মীসহ জনগণকে প্রতিরোধের নির্দেশনা দিতে পারতেন, তাঁরা বন্দী অথবা ঘেরাও হয়ে কড়া পাহারায় ছিলেন। তাঁদের নির্দেশ-উপদেশ সাধারণ নেতা-কর্মীদের কানে পৌঁছানোর মতো পরিবেশ বা উপযুক্ত কোনো মাধ্যমও ছিল না। এখনকার মতো এতগুলো টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যম, কিংবা দ্রুত যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোনও তখন ছিল না। এটাতো ঠিক যে, রাজধানীর মূল কেন্দ্র গণভবন, রেডিও-টিভি এবং সংবাদপত্র কব্জা করা গেলে সমগ্র দেশই বিভ্রান্তিতে ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক। শত্রুরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাল্টা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে এমন সবগুলো দিক বন্ধ করেই তাদের অভিযান শুরু করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চলাকালে আদালতে একজন সাক্ষী বলেছেন,'বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দায়িত্বরত সৈনিকদের সকালে নতুন গুলি দেওয়ার কথা বলে, তাদের আগের গুলিগুলো নিয়ে গেছে ঘাতকের দল, যাতে প্রতিরোধ সেখান থেকেও না আসে।' এতেই বুঝা যায়, ওরা কি রকম প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নেমেছিল এবং সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তাদের লোকজনের কী রকম অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।

এ অবস্থায় অনেকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে, অর্থাৎ নেতৃত্বের নির্দেশনার অপেক্ষায় থেকে দোটানা পরিস্থিতির মুখোমুখি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।

অনেকেই বঙ্গবন্ধু ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু ও শীর্ষ নেতাদের বন্দিত্বের খবর পেয়ে নিজের জীবনের মায়ায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ খন্দকার মোশতাকের নির্দেশ ও সশস্ত্র সৈন্যদের বন্দুকের নলের মুখে কাতর হয়ে যোগ দিয়েছিলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। এছাড়া সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ নামধারী ও মুজিব কোট লেবাসধারী অনেকেই ঘাতকচক্র ও হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে নোংরা সখ্য গড়ে তোলার কারণেও জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

এভাবে সময় ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে যে সহিংস ঘৃণা ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল তা নিস্তেজ হয়ে অহিংস রূপ লাভ করে। কিছু অদুরদর্শি, দুর্বল চিত্তের আওয়ামী লীগ নেতার ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মোশতাক চক্রের মন্ত্রিসভায় যোগদানের ফলে পরিস্থিতি ঘাতকচক্রের অনুকূলে যায়। অনেকেই এমনকি গ্রাম পর্যায়ে অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাও ভেবেছিলেন যে, একদল বিভ্রান্ত সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও পরিস্থিতি এবং সরকার আওয়ামী লীগেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই বঙ্গবন্ধু হত্যার শোক নিজেদের বয়ে বেড়াতে হলেও ঘাতকরা হয়তো রেহাই পাবে না। স্বাধীনতার অর্জনগুলো বৃথা যাবে না।

পরবর্তীকালে এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানপন্থী, মোশতাকচক্র ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ষড়যন্ত্রের এটা যে চরম পরিণতি একথা যখন সবাই বুঝতে পেরেছিলেন তখন ক্ষমতাকাঠামোর সার্বিক পরিস্থিতি ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনুকূলে চলে গিয়েছিল। তারপরও যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেষ্টা হয়নি তা নয়। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার কথা অনেকে জানেন। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও প্রতিরোধ-প্রক্রিয়া শুরু হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতাদের মধ্যে শামসুদ্দিন আহমদ, এম জাফর, এম এ মান্নান, কাজী আবু তৈয়ব, আকম শামশুজ্জামান, আনোয়ারুল আজিম, রফিকুল ইসলাম, খোকন নন্দী, চন্দন লালাসহ আরো কিছু ছাত্র-যুব নেতা এমএ জাফরের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ঘটনার পরদিন এবং তৃতীয় দিন এম এ জাফর ও ডা. ফয়েজ আহমদের নন্দনকাননের বাসায় পরপর দুটি বৈঠকে বিস্তারিত আলাপ হয়। সভায় উপস্থিত কাজী আবু তৈয়বের কাছ থেকে জানা যায়, প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে ডা. ফয়েজ সেদিন সম্মত না হওয়ায় বেতার আক্রমণের প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়। তবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সিটি কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ১৫-২০ জনের মিছিল বের করা হয়। মিছিল রিয়াজউদ্দিন বাজার আমতল এলাকায় গেলে পুলিশি আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর কয়েকদিন পর ধলঘাট পূর্ণেন্দু কানুনগোর বাড়িতেও বৈঠক হয়। এতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হরিসাধন দেব বর্মণ।

পরবর্তীতে কিছু ছাত্র ও যুব নেতা এস এম ইউসূফের পরামর্শে আগরতলা গেলেও সেখানকার কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাঁরা ফিরে আসেন। পরে এসব কর্মী কয়েকবছর জিয়া সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক জীবন-যাপন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদকারীদের অনেককে কারাগারে নিয়ে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। ৭৫ এর সেপ্টেম্বরে পটিয়া থেকে গ্রেপ্তার হওয়া মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমদ সম্প্রতি এ লেখকের কাছে তাঁর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের তৎকালীন যুবনেতা, মুক্তিযোদ্ধা মৌলভি সৈয়দ আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। পরে ফিরে এসে গ্রেপ্তার হন ঢাকায়। সেনানিবাসে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় তাঁকে ৭৭ সালের ১১ আগস্ট। নির্যাতনে দোহাজারির মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খসরু মারা গেছেন পাহাড়তলীর হাজি ক্যাম্পে।

প্রসঙ্গত; তখন বিধি জারি করা হয়েছিল মৃত ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধুর) নামে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে জামায়াত শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর যে রকম সদম্ভ উত্থান দেখা গেছে, তাতে স্পষ্ট যে, নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে সহযোগিতা করেছেন হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা, যাঁরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন আওয়ামী লীগ থেকে বিভিন্ন সময় বেরিয়ে যাওয়া হীনমন্য সুযোগসন্ধানী, কথিত বৈজ্ঞানিক ও অতিবাম লেবাসধারী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এরা কখনো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লুঠপাট এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমতার সিঁড়ি নিষ্কণ্টক করার নীল নকশা বাস্তবায়নে মদদ দিয়েছেন।

খন্দকার মোশতাকসহ ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনেকে এখন নেই। খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। চলছে স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজও। তারপরও বর্তমান আওয়ামী লীগ কিংবা প্রশাসনের অভ্যন্তরে কুচক্রীদের ছোট বড়ো প্রতিনিধিরা ছদ্মবেশে, প্রগতিশীলতার পোশাকে অনুপ্রবেশ করছে না তা হলফ করে বলা যায় কী ?

২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ধংসের চেষ্টার কথা ভোলার কথা নয়। তাঁরাসহ অন্য প্রগতিশীল নেতা, লেখক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের নির্মূলের প্রক্রিয়া যে চলছে না তা কী কেউ বলতে পারে? শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর পরিণতি বরণ করতে হবে এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও খবর বেরিয়েছে সম্প্রতি।

মনে রাখা দরকার, এখনো অনেকেই বন্ধু সেজে ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে কবজা করে উন্নয়নের যাত্রাপথে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্য মতের লোকজন ঢুকে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই সরকারের আমলে, গত বছরও কিছু বিপদগামী সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির সরকার উচ্ছেদের অপচেষ্টা নস্যাৎ করা হয়েছে বলে খবর প্রচার হয়েছিল।

মানবতাবিরোধী কিছু শীর্ষ ব্যক্তির বিচারকাজ চললেও তাদের অনুসারীরা নানাভাবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। মূলত সরকারি দলের সহযোগী ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা জনমুখী কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকার সুযোগ নিচ্ছে পরাজিত শক্তির লোকজন। নানান নামের সংগঠনের আড়ালে নতুন প্রজন্মের অনেককে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছেন তারা।

কাজেই আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের দূরভিসন্ধি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। '৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতির কথা স্মরণ রেখেই দলীয় কাঠামো বিন্যাস, নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী ও জনআস্থাশীল সংগঠন তৈরি এবং তা স্থায়ী রূপ দেওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে বর্তমান সরকারি দলের নেতৃত্বকে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে একটুখানি ভুলের কারণে দ্বিতীয়বার ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগস্টের মতো আঘাত হানার সুযোগ কোনো পক্ষ না পায়।