লোহাখোররা ধ্বংস হোক, নিপাত যাক!

মোজাম্মেল বাবু
Published : 21 Feb 2008, 05:32 PM
Updated : 12 August 2010, 11:46 PM

সম্প্রতি পরিবেশবিধ্বংসী জাহাজ ভাঙা বাণিজ্যের পাশবিকতা নিয়ে নির্মিত লোহাখোর প্রামাণ্য চিত্রটি দেখে আমি রীতিমত বিবমিষার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। এ যেন একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে এলেক্স হেলির রুটস ছবিটির পুনঃ চিত্রায়ন। শিপ ব্রেকিং শিল্পের নামে চলে আসা অবাধ পরিবেশ দুষণ সম্পর্কে আমার কম-বেশি ধারণা ছিল, কিন্তু শ্রম শোষণের এত বড় পৈশাচিকতা আমি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নি।

'শিপ ইয়ার্ড' বলতে যা বোঝানো হয় তা আসলে উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকত ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে খোলা আকাশের নিচে লক্ষ লক্ষ ইলেকট্রোড পুড়িয়ে চলে পরিবেশ দূষণের কদর্য 'ফায়ার ওয়ার্কস'। আর জাহাজ টানার জন্য মঙ্গাপীড়িত এলাকা থেকে আসা ভূখা-নাঙা শ্রমিকের কাঁধে তুলে দেয়া হয় লোহার শেকলের দুঃসহ জোয়াল।

নিত্যদিন আগুনের তেজষ্ক্রিয় লেলিহান শিখার মধ্যে বসবাস ছাড়াও পরিত্যক্ত জাহাজটিতে এমন কোন দুষিত পদার্থ নেই যার সংস্পর্শে শ্রমিকরা পতিত হয় না। জাহাজ ভাঙার পর যা ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের পানিতে। তিন থেকে চার মাস এ নরকের আগুনে পুড়ে দুর্ঘটনার হাত থেকে দৈবাৎ বেঁচে মুমূর্ষু শ্রমিক একদিন বাড়ি ফিরলেও তারা ফুসফুস ভরে নিয়ে যায় পৃথিবীর দূষিততম বাতাস এবং কাঁধে রক্তজবার মত কৃতদাসের ক্ষত।

'ইন গড উই ট্রাস্ট' শ্লোগান নিয়ে পিস, হ্যাপিনেস অ্যান্ড প্রসপারিটির নামে পরিচালিত শতাব্দীর নৃশংসতম এ টর্চার সেলের ভয়াবহতা দেখে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে না কেন? সফেদ দাড়ির নরপিশাচ 'লোহাখোর'দের ওপর বিশাল আকাশ ভেঙে পড়ে না কেন?

এ সব কয়েদখানায় এক মওসুমের জন্য কাজ করতে আসা শ্রমিকদের খোরাকি নিয়মিত চালিয়ে রাখা হলেও দোকানের দেনা শোধ করা শেষে তাদেরকে শূন্য হাতেই বাড়ী ফিরতে হয়। নূরানী চেহারার নিষ্ঠুর মালিকরা এমনভাবে তাদের মজুরী নির্ধারণ করে যেন কোন রকমে তিন বেলা খাওয়াটা চলে এবং তা থেকে উৎপাদিত প্রতি ক্যালরি অ্যানার্জি দাসত্বের প্রক্রিয়ায় শুষে না যায়। হারভাঙা খাটুনির পর শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তারা যখন বলে, 'কাজের তুলনায় তোরা খাস বেশি', তখন আমার মাথায় খুন চেপে যায়!

তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশে এ পৈশাচিক কৃতদাস প্রথা চলতে দেয়া যায় না। কতিপয় নরপশুর আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার স্বার্থে বাংলাদেশকে কিছুতেই পৃথিবীর আস্তাকুঁড়ে পরিণত হতে দেয়া হবে না। এদেশের প্রতিটি মানুষ এখন সোনার বাংলা গড়তে প্রাণান্ত পরিশ্রম করছে। পৃথিবী জুড়ে আজ বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। কেউ বলছে 'বিউটিফুল বাংলাদেশ', আবার কারও মতে 'রেসিলিয়েন্ট বাংলাদেশ'! চায়নাকে বলা হয় 'পৃথিবীর কারখানা' এবং ভারত হচ্ছে 'পৃথিবীর ব্যাক অফিস'। আমরা যখন 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নিয়ে স্বপ্ন দেখছি তখন হাতে গোনা কয়েকজন কুলাঙ্গারের কারণে আমাদেরকে 'পৃথিবীর বর্জ্যখানা' বলতে দেয়া হবে কেন? কেনই বা আমরা অহেতুক বিরাট অংকের কার্বন ইমিশনের দায় নেবো?

জাহাজ ভাঙার ধান্দাটি শতভাগ মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যারা এ অসাধু ব্যবসাটিকে 'শিল্প' বলে আখ্যায়িত করে, তারা চুরি-ডাকাতি-খুন কোন কিছুকেই 'শিল্প' বলতে দ্বিধা করবে না। সুযোগ পেলে তারা মানুষের কাঁধেও জোয়াল তুলে দেবে। এতদিন তথাকথিত এ বিকাশমান শিল্পে দেড় লক্ষ কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে আজ পর্যন্ত তারা সর্বমোট আঠারো হাজারের বেশি শ্রমিকের তালিকা দিতে পারেনি।

এমনকি বিভিন্ন প্রপাগান্ডায় তারা দেশের সর্বমোট লোহার চাহিদার ৮০ ভাগ মিটিয়ে আসছে দাবি করলেও পরিসংখ্যান তাদেরকে ২৫ ভাগে বেঁধে দেয়। আরেকটি প্রচারণাকে তারা সবচেয়ে বড় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে–'জাহাজ ভাঙা বন্ধ হয়ে গেলে দেশে লোহার মহাসংকট দেখা দেবে, বাজারমূল্য আকাশ ছোঁবে এবং নির্মাণ শিল্প ধ্বংসের মুখে পরবে!' অথচ যে কোন চিন্তাশীল মানুষই বুঝবেন, ৭৫ ভাগ লোহা আমদানি করা গেলে, বাকি ২৫ ভাগ যাবে না কেন? তাছাড়া পরিমাণের বিচারে জাহাজ ভাঙা লোহা আমাদের ২৫ শতাংশ চাহিদা মেটালেও সামগ্রিক স্ট্রেংথ বিবেচনায় তাদের কন্ট্রিবিউশন আরও অনেক কম।

উন্নতমানের লোহা আমদানি করা হলে তার অর্ধেকেই আমাদের চাহিদা মিটে যাবে। গুণ বিবেচনায় এধরনের নিম্নমানের লোহার দাম অর্ধেকের চেয়ে কম হওয়া উচিত হলেও অর্থপিপাসুদের উচ্চ মুনাফার কারণে বাজারে গিয়ে আমরা মাত্র ১৫ ভাগ সাশ্রয় পাই। সর্বোপরি, কারও যদি নিম্নমানের লোহা দিয়ে কাজ চলে, তারা প্রয়োজনে 'স্ক্র্যাপ' আমদানি করবে, পরিবেশ বিনষ্টকারী বর্জ্যজাহাজ নিয়ে আসবে কেন?

পৃথিবীর কোন সভ্য দেশ নিজেদের ভূখণ্ডে আজ জাহাজ ভাঙতে অনুমতি দেয় না। আমরা কি তাহলে অসভ্য আর বর্বর নাকি? পরিবেশ দূষণ, জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমিক নির্যাতন সকল বিবেচনাতেই এ অশুভ বাণিজ্য বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। মন্দের ভালো হিসেবে মহামান্য হাইকোর্ট তাদের এক সাম্প্রতিক রায়ে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে যথপোযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে 'প্রি-ক্লিনিং সার্টিফিকেট' গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই চালাকির আশ্রয় নিয়ে 'ইন বিল্ট' বর্জ্যকে ক্লিনিংয়ের আওতা থেকে ছাড় দেয়ার পাঁয়তারা করছে। তারা নাকি এ সংক্রান্ত নীতিমালা এবং গাইডলাইন নিয়েও আলোচনা চালাচ্ছে, যেখানে পরিবেশবাদীরা চাইছে বলবৎযোগ্য কঠোর আইন, কেননা চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী!

আগামী ১৬ আগস্ট, ২০১০ তারিখে নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত করার জন্য শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশন দেশের সব সেরা আইনজীবিদের নিয়ে অ্যাপিলেট ডিভিশনে যাচ্ছে।

দেশের সকল বিবেকবান মানুষের প্রত্যাশা সরকার অর্থাৎ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস যেন দুষ্কৃতিকারীদের পক্ষ না নেয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত, আমি মনে করিনা এই ধরণের অনাচার তিনি চলতে দিবেন।