মানবাধিকারকর্মী না ‘মানবাধিকার-ব্যবসায়ী’

এবিএম নাসির
Published : 13 August 2013, 08:38 AM
Updated : 13 August 2013, 08:38 AM

রাষ্ট্রের দায়িত্ব ন্যায়বিচার ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সম্পদের অপর্যাপ্ততার কারণে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশসহ অনেক উন্নত দেশেও জনগণের জানমালের তাৎক্ষণিক শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবসময় সম্ভব হয় না।

রাষ্ট্রে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যতটা দুরূহ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ততটা নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জনগণের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রের পরিচালকদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকা অপরিহার্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে জনগণের নিরাপত্তার বিধানও সহজ হয়ে যায়।

কিন্তু যে রাষ্ট্রে রক্ষকেরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের আশা করা অরণ্যে রোদনের নামান্তর। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিও তেমনি একটি রাষ্ট্র যেখানে রক্ষকেরা প্রায় সবসময় ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে এসেছে।

নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে ৪ টি নির্বাচিত সরকার ও ১ টি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ২০০১-০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়। জনাব আদিলুর রহমান ওই সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার শপথ নিয়েই তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ পদ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষায় জনাব আদিলুর আদৌ আন্তরিক ছিলেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে!

সে সময় বিএনপি-জামায়াতের তত্ত্বাবধানে গজিয়ে উঠা জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের বোমা হামলায় শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী ও নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ ১৩৭ জন মৃত্যুবরণ করেন। আহত হন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ ১৪৫৮ জন।

টেবিল ১-এ প্রদত্ত উপাত্ত দেখুন–

যেমন, হবিগঞ্জে বোমা হামলায় প্রাণ হারান প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আ স ম কিবরিয়া। বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের গাজীপুরের এমপি আহসানউল্লাহ মাস্টার। জামায়াতি হামলায় মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনূস।

হরকাতুল জিহাদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ। সিলেটে শাহজালালের দরগায় গ্রেনেড হামলায় আহত হন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী।

২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর সন্ত্রাসে মৃত্যু হয় হিন্দু সমাজের বহু লোকের। ধর্ষিতা হয় পূর্ণিমাসহ অনেক কিশোরী-তরুণী. এমনকি শিশুও। ঘরছাড়া হয় বহু হিন্দু পরিবার। কুপিয়ে আহত করা হয় এদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে।

২১ আগষ্ট, ২০০৪ প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় চালানো বাংলাদেশের ভয়াবহতম বোমা হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন নেতা ও কর্মী। মারাত্মক আহত হন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ শতাধিক নেতা ও কর্মী। এ হামলার ধকল সামলাতে না পেরে মোহাম্মদ হানিফকেও চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে।

একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব মর্মান্তিক ঘটনার সময় আদিলুর রহমান অধিষ্ঠিত ছিলেন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রধান আইনজীবীর পদে। তখন তার মানবাধিকারের মূল্যবোধ কোথায় ছিল! এ সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা তো দূরের কথা, বরং মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে অনেক কর্মীকে বোমা হামলার সাজানো মামলার জালে পোরা হয়েছিল। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়ার নাটক।

ময়মনসিংহ সিনেমা হলে বোমা হামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল বরেণ্য ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটক করা হয়েছিল লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে।

তাছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে র‌্যাব ও অন্যান্য বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সীমান্ত-হত্যার পরিমাণ ছিল নব্বই পরবর্তীকালের সরকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

টেবিল ২-এ দেখুন–

এমনকি বছরভিত্তিক গড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অন্যান্য সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, একজন সহযোগী অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষে তো আর রাষ্ট্রের সমস্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়? কিন্তু এমন একটি রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলেও একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কাজের প্রতিবাদ করতে বাধা কোথায়! আদিলুর রহমান কি বিএনপি-জামায়াতের সময় সংঘটিত ওইসব লাগামহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ব্যর্থতার প্রতিবাদ করেছিলেন? পদত্যাগ করেছিলেন?

তা তো করেননি! বরং তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঘটনাগুলোকে আইনি বৈধতা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তারপর আবার ক্ষমতার বাইরে এসে একজন মানবাধিকার কর্মীর তকমা গায়ে লাগিয়ে একের পর এক তথ্যবিকৃতির মাধ্যমে মানুষের 'পারসেপশন' পরিবর্তনের অসৎ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

বস্তুতপক্ষে বিএনপি-জামায়াত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে, আদিলুর রহমান মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।

যারা মানবাধিকারকে প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করেন তাদের 'মানবাধিকারকর্মী' না বলে 'মানবাধিকার-ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।

জনাব আদিলুর রহমান আজ নিজের শেখানো কৌশল ও বানানো জালে ধরা পড়েছেন। ওদিকে মায়া্কান্না শুরু হয়ে গেছে তার মানবাধিকার রক্ষার জন্য!

আমরাও সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, যে ন্যায়বিচার আদিলুর রহমান তার সরকারের সময় সন্ত্রাসের ভিকটিমদের নিশ্চিত করতে পারেননি, সে ন্যায়বিচার থেকে যেন তাকে বঞ্চিত করা না হয়।

তাতে করে তার অনুশোচনা ও শিক্ষার একটা সুযোগ অন্তত থাকবে। বাংলাদেশও এতে উপকৃত হবে।


এবিএম নাসির :
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।