প্রতিযোগিতা নয়, হার্দিক বন্ধন

আলী যাকের
Published : 10 August 2013, 09:33 AM
Updated : 10 August 2013, 09:33 AM

আমি নিতান্তই বালক ছিলাম পঞ্চাশের দশকে। কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছি ষাটের দশকে এসে। যৌবনে পদার্পণ করেছি ষাটের মাঝের দিকে। সত্তরের দশকে তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ। এরই মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। এভাবেই আমার বেড়ে ওঠা, ওই সময়েই। মধ্য পঞ্চাশ থেকে শুরু করে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টিই আমার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের শুরুর দিকের সময়্।

বাঙালির জীবনে উৎসব সবসময়ই বিচিত্র আনন্দের পসরা সাজিয়ে আসে। আমরাও শৈশবে, কৈশোরে, তারুণ্যে উৎসবের এই রূপ দেখেছি। তবে এখনকার সঙ্গে তখনকার পার্থক্য হল, তখন আমাদের ঈদ-উৎসবের মধ্যে অনেক বেশি সর্বজনীনতা ছিল। আমার পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানায়। কিন্তু ওখানে থাকা হয়নি কখনও। কারণ বাবা ছিলেন সরকারি আমলা্। তাই শৈশবে-কৈশোরে সারাদেশের নানা জেলায় ঘুরেছি।

আমার দশ বছর বয়স থেকে আমাদের পরিবার ঢাকাতেই স্থায়ী। একটা বিষয় বলব, সবখানেই দেখেছি ঈদ-উৎসবের সর্বজনীন রূপটি। তখন ধনী-দরিদ্রের ফারাক খুব কম ছিল। আজকে বিভিন্ন শ্রেণিকে বিভিন্নভাবে ঈদ উদযাপন করতে দেখা যায়। গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডি-বারিধারায় একভাবে ঈদ-উদযাপন হয়। একটু দরিদ্রতর এলাকাগুলোতে ঈদ এক রকম। আরও দরিদ্রতর এলাকাগুলোতে এই উৎসবের রূপটা আরেক রকম। ঢাকার বাইরে আবার ভিন্নতর রূপে এর বরণ। এমনটা আমাদের সময়ে ছিল না।

আজকালের উৎসব উদযাপনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমার একটি ভাবনার কথা বলব। আমাকে এখন যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অখুশি করে তা হল সোশ্যাল ক্লাইম্বিং। অর্থাৎ উপরে ওঠার প্রতিযোগিতা। যারা অর্থনৈতিক দিক থেকে নিচের দিকে আছে তারা কেনাকাটা, সাজসজ্জা, বিলাস-ব্যসন, এমনকি কথাবার্তা বা বাচনভঙ্গির দিক থেকেও সুবিধাভোগী শ্রেণির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আমাদের ছেলেবেলায় কিন্তু এমনটি ছিল না। তখন সবাই হৃদয়টাকে উন্মোচন করে দিত। সম্পর্কগুলো ছিল পারস্পরিক, পারিবারিক কিংবা সামাজিক। এগুলো ছিল হার্দিক সম্পর্ক; মানে হৃদয় থেকে উৎসারিত। এভাবেই আমরা ঈদ উদযাপন করেছি।

ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর থেকে আমরা ছিলাম গেণ্ডারিয়ায়। সেখানে পাড়া-পড়শি ছেলেরা মিলে দলবেঁধে ঘুরতাম এ দিন। মেলাগুলোতেও যেতাম দলবেঁধে। গেণ্ডারিয়ার বিখ্যাত ধুপখোলা ময়দানে ঈদে একটি মেলা হত। আমরা সে মেলা দেখতে যেতাম। লালবাগে, আজিমপুরেও ছিল মেলার আয়োজন। তাছাড়া অন্যদের বাড়িতে যেতাম অবলীলায়। ধনী-দরিদ্র নির্বশেষে। অন্যরাও আমাদের বাড়িতে আসত সেভাবেই।

কিন্তু কোথাও আজকালের মতো প্রদর্শন মনোভাবটা ছিল না। কে কত লাখ টাকার গহনা বা পোশাক কিনল তা একটি মানদণ্ড হয়ে গেছে এখন। এ সব আমরা চিন্তাও করিনি কখনও। এ নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামার প্রশ্নই ওঠে না। এমন নয় যে আমরা সচেতনভাবে এই দেখানোর মনোভাব এড়িয়ে গেছি। এটা আসলে কারও মধ্যে আসতই না। কেউ দেখাতে চাইত না। বরং এ ধরনের দেখানো মনোভাব কারও থাকলে সে সমাজে উপহাসের পাত্র হত।

এ প্রসঙ্গে একটি মজার ব্যাপার মনে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি একটি সিনথেটিক ফাইবার কাপড়ের শার্ট পরে গেছি একদিন। যেতেই লজ্জা পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে উপহাস করবে বন্ধুরা। আসলে হয়েছিলও তাই। ওরা বলছিল, 'ওহ. বড়লোক হয়ে গেছ, না?' আর এখন হলে কী হত? এখন তো আমার এত দামি বা অমুক জিনিসটা আছে এটা দেখানোই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম যখন আমাদের পরিবারে একটি গাড়ি ছিল তখন। ওটি আমার জন্য বরাদ্দ ছিল না, শুধু আমার ছোট বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে আসত। আমি যেদিন ওটিতে চড়ার সুযোগ পেতাম সেদিনও দেখা যেত অনেক দূরে গাড়ি থেকে নেমে যেতাম। কারণ বন্ধুদের ভয়, ওরা যদি আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তাহলে ভীষণভাবে খেপাবে।

এ ধরনের মূল্যবোধগুলো নিয়ে আমরা সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বেড়ে উঠেছি। এর বেশ ইতিবাচক একটি দিক আছে। তাতে মানুষের মধ্যে লোভটা তত বেশি কাজ করে না। উপরে ওঠার সিঁড়ি খোঁজার চেষ্টাটাও থাকে না। তাই তখন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবের আনন্দগুলো ছিল নির্মল। সেগুলো উদযাপনের জন্য অত বেশি ঐশ্বর্যের প্রয়োজন হত না।

অথচ এখন কী শুনতে পাই, কী দেখতে পাই? উৎসবে আনন্দ করার জন্য বাবা ছেলেকে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এক বন্ধু বললেন সেদিন, ঈদ উপলক্ষে এক বাবা তার ছেলেকে বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দিয়েছেন! তো, এই হচ্ছে দেখানোর মনোভাব যেটি এখন খুব প্রকট। এসব 'ফলস স্ট্যান্ডার্ড' ছিল না বলে আমাদের সময়ের ঈদ-উদযাপন ছিল অনেক বেশি নির্মল আর সত্যিকারের আনন্দের।

তবে একদিক থেকে দেখলে সমাজের এ পরিবর্তন যেন অনিবার্যই ছিল। কারণ আমাদের দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন হয়নি বা এটা তত দক্ষও হয়ে ওঠেনি। এর ফলে সমাজের সবার কাছে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফলটা পৌঁছে যাচ্ছে না। আর তাতে করেই বাড়ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জন করাটাই আজকের সমাজের 'নর্ম' হয়ে উঠছে। এটা এখন সাধারণ প্রবণতা।

এক হিসেবে এই পরিস্থিতিটি অনিবার্য ছিল, আবার নয়ও। বিশ্বে আরও অনেক সমাজ আছে যেখানে এ রকম ঘটনা ঘটে না। সমাজে ঐশ্বর্য তো বাড়বেই। কিন্তু তার একটি বৈষম্যহীন বণ্টন ব্যবস্থা থাকা খুব জরুরি ছিল। সামাজিক সমতা নেই বলেই সমস্যাটা বাড়ছে। এই প্রতিযোগিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে– বলব না যে এটা সর্বৈব– অবশ্যই অস্বাস্থ্যকর একটি প্রতিযোগিতা।

আমার তো মনে হয়, এই প্রতিযোগিতা এতটা অসুস্থ না হয়ে মেধার ক্ষেত্রে হতে পারত। কিন্তু সেখানেও আমাদের অ্যাটিটিউডের সমস্যা। আমার আত্মীয়দের মধ্যেও দেখেছি, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া সন্তানকে মা বলছেন, 'বাংলায় কোনো রকমে পাশ করলেই হবে, এরপর তো বিদেশে চলে যাবে, বাংলা আর পড়তে হবে না।'

এইসব দেখে খুব দুঃখ পাই আজকাল। আমাদের মূল্যবোধগুলো উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।

এত কিছুর মধ্যে আমাদের ঈদ-উদযাপনের একটি বিশেষ দিক কিন্তু আমার খুবই ভালো লাগে। আর তা হল শেকড়ের দিকে ফিরে যাওয়া। এটা সমাজের জন্য খুবই ভালো একটি লক্ষণ। বলা হচ্ছে, ঈদে এক কোটি লোক ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমি মনে করি না এত লোক দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তবে লাখ লাখ লোক তো বটেই। এই যে লাখো মানুষ অনেক কষ্ট করে টিকেট কেটে বাড়ি যাচ্ছেন, ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে উঠছেন ঝুঁকি নিয়ে, ট্রেনে বা লঞ্চের গায়ে এমনভাবে লেপ্টে যাচ্ছেন যে ওই যানটিকে দেখাই যায় না— এ সবের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, এর ফলে আমাদের সমাজের কিছু মূল্যবোধ টিকে যাচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এ প্রবণত্টা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যেই বেশি। উচ্চবিত্তের মধ্যে এটা নেই। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তো এই শ্রেণিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। ফলে তাদের এই ঘরমুখীনতা, শেকড়প্রবণতা সমাজের জন্য ইতিবাচক।

পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের উৎসব উদযাপনের রীতির তুলনা করতে পারি। আমি ইংল্যান্ড, জার্মানিসহ ইউরোপের কিছু দেশে এবং আমেরিকাতেও কয়েকবার ক্রিসমাস উদযাপনের সময় ছিলাম। বিশেষ করে পুঁজিবাদী বিশ্ববব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত আমেরিকাতে দেখেছি মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি খুবই শক্তিশালী। তাদের মূল্যবোধ, তাদের চিন্তাচেতনা মার্কিন সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী। পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, বন্ধু ও স্বজনদের ভালোবাসা, দুর্নীতির মতো বিষয়কে ঘৃণা করা, শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া– এ ধরনের মূল্যবোধগুলো মধ্যবিত্তের মধ্যে খুব শক্তিশালী।

মার্কিন সমাজে উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রেও মধ্যবিত্তদের সংস্কৃতিই প্রাধান্যশীল। তারা সেখানে আনন্দের মধ্যে মিলেমিশে ক্রিসমাস উদযাপন করেন। ওখানে বরং বেশি প্রাচুর্যময় লোকেরা একঘরে হয়ে থাকেন। আর সাধারণ মানুষই বেশি আনন্দের মধ্যে দিনটি কাটান। সেখানে আমাদের চেয়েও উৎসবের আনন্দ অনেক বেশি নির্মল।

আরেকটি বিষয় হল, প্রদর্শন মনোভাব বা এ জাতীয় কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমেরিকায় দেখা যায় না। কেউ এমন কিছু করলে ধরা পড়ে যায়। একে অসামাজিক বিষয় বলেই মনে করা হয়। খুব ছোট্ট বা সামান্য উপহার পেয়েও খুশি হতে শেখানো হয় শিশুদের। সান্তা ক্লজ রাতে প্রত্যেক শিশুকে একটি করে চকলেট দিয়ে যান। পরদিন সকালে ওই চকলেটটি খুব মূল্যবান ওই শিশুটির কাছে। এ রকমই নির্মল আনন্দটা ওদের আছে যদিও এটি একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।

তবে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য সেখানে আছে বলে আমাদের মতো উৎসবে বাড়ি ফেরার তাগাদা নেই। আমাদের ঢাকার মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের পরিবারগুলো সাধারণত গ্রামেই থাকেন। মধ্যবিত্তরা অনেক সময় যৌথ বা সম্প্রসারিত পরিবারে থাকছেন। এসবের ফলে শেকড়ের টানে যেতে হচ্ছে গ্রামে বা বাড়িতে। এটা ওখানে সেভাবে নেই। তবে উৎসবে নির্মলতাহীন ও প্রদর্শনমূলক আনন্দ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছে ওরা।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে বড় একটি ভোক্তাগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বলে কর্পোরেট দুনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা নতুন নতুন পণ্যের পসরা নিয়ে আসছে। কারণ চাহিদা ও জোগানের খুব সহজ তত্ব। শুধু ঈদ-উৎসব নয়, আমাদের পুরো রোজার মাস জুড়ে ইফতারে সামগ্রী তৈরি নিয়েও বিরাট ব্যবসা গড়ে ওঠে। এছাড়া জামা, জুতাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি নিয়ে তো নানা রকম উদ্যোগ আছেই।

এটা আবার অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হচ্ছে। প্রচুর কর্মসংস্থান হচ্ছে এ সময়। আর পণ্য যেসব তৈরি হচ্ছে তার বিক্রি-বাট্টা বেড়ে অর্থনীতিতে একটা গতিশীলতা আসছে। কনজিউমারিজম বেড়ে যাওয়ার এই দিকটি অর্থনীতির জন্য সুফলদায়ক সন্দেহ নেই।

অর্থনীতির এই দিকটি মাথায় রেখেও বলব, সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে ব্যবধান কমিয়ে আনা এবং ঈদ-উৎসবের হার্দিক পরিবেশটা ধরে রাখার মতো মূল্যবোধের চর্চাও জরুরি।