এখন আর উৎসবে সর্বজনীনতা নেই

রাশেদা কে. চৌধুরী
Published : 9 August 2013, 04:01 AM
Updated : 9 August 2013, 04:01 AM

ষাটের দশকের শুরুর কথা। রথযাত্রা হচ্ছে সিলেট শহরে। কী বিশাল তার আয়োজন। শহরে আমরা ধর্মবর্ণনির্বিষেশে সব শিশুরাই মেতে উঠেছি আনন্দে। বড়রাও তাতে সামিল। রথযাত্রার পেছন পেছন ছুটছি আমি আর আমার বড় বোন। জলে নির্বাসন দেওয়া হবে রথটিকে। বিপুল আগ্রহ আমাদের।

ছুটতে ছুটতে কখন যেন আমরা দুবোন আলাদা হযে গেলাম। আমি রথযাত্রা দেখে আমার মতো ফিরে এলাম বাড়িতে। এসে দেখি বোনের খবর নেই। বাড়িতে হইচই, কান্নাকাটি পড়ে গেল। বোনের খোঁজ পেতে শুরু হল শহরজুড়ে মাইকিং। শেষ পর্যন্ত ওকে পাওয়া গেল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। বাড়ির পথ খুঁজে পায়নি। মাইকিং শুনে লোকেরা তার খোঁজ জানালে পরে তাকে বাসায় আনা গেল।

ঘটনাটির উল্লেখ করলাম আমার শৈশবে দেখা বাংলাদেশের সমাজের দুটি বাস্তবতা তুলে ধরতে। এক, আমরা, তখনকার শিশুরা এ দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক সামাজিক ব্যবস্থার অসামান্যতা দেখেছি। এক ধর্মের উৎসবে সামিল হত অন্য ধর্মের লোক। উৎসবগুলো তাই ছিল সর্বজনীন। কী হিন্দুর রথযাত্রা বা দূর্গাপুজা; কী মুসলিমের ঈদ বা মুহররম।

দুই, আমরা, ওই অর্ধশতাব্দী আগের শিশুরা আরেকটি জিনিস পেয়েছি। তা হল সামাজিক নিরাপত্তাবোধ। আমার বোনটি হারিয়ে গেলেও কেউ তার খুব বড় ক্ষতির কথা ভাবেননি। একটু খোঁজাখুঁজি করেই তাকে পাওয়া গেল। সে পথ হারিয়েছিল, এই যা। এখনকার মতো একটি শিশু, বিশেষ করে কন্যাশিশু হারিয়ে গেলে যে ভয়টি ছিল তা তখন এত তীব্র ছিল না।

ঈদ নিযে বলতে গিয়ে এমন একটি ঘটনা তুলে ধরার এটাই বড় কারণ। আমাদের সময়টাকে বোঝানো। সময়টা ছিল মুক্তির, নির্মলতার, সৌহার্দ্যের। বিশেষ করে আমার পিতৃমাতৃভূমির কথা বলতে গেলে সেটাই আমার চিন্তায় আসে।

আমার বেড়ে ওঠা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সিলেট শহরে। শাহজালাল মাজারের কাছে আম্বরখানায় জন্ম আমার। বাবা ছিলেন সরকারি কলেজের শিক্ষক। তখন সিলেট এমসি কলেজে পড়ান বাবা। শহরের অভিজাত একটি পরিবারে জন্ম হলেও আমাদর সময়ের শহরটি ছিল খুব খোলোমেলা্। আমরা শৈশবে সাম্প্রদায়িকতা ও তীব্র শ্রেণিবিভেদ দেখিনি। এখনকার সিলেটকে মানুষ ভিন্নভাবে দেখলেও তখন এটি ছিল অন্যরকম।

বাউল সাধকদের পূণ্যভূমি সিলেট। হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণের জন্ম দিয়েছে এই ভুমি। শাহ আবদুল করিম গেয়েছেন, 'গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান …. আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।' আসলেই সত্যি, কী সুন্দর ছিল আমাদের প্রিয় দিনগুলি তখন। ওইরকমই অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, উচ্চতর ভাবনার ভূমি সিলেটে তাই ঈদ আসত তার অসাধারণ বর্ণাঢ্যতা ও সরলতা নিয়ে।

মনে পড়ে খুব সেসব দিনের কথা। আমি পড়তাম শহরের আম্বরখানা গার্লস হাই স্কুলে। ঈদের আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল জামা-কাপড়ের। কিন্তু তাতে আনন্দ ছিল অনেক, বাহুল্য ছিল না। ঈদে একটা নতুন জামা, ব্যস, এই তো। এখনকার মতো এত বিলাস-ব্যসন, এত চাকচিক্যের কথা ভাবাই যেত না। আমাদের সেই পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি বা ষাটের দশকের শুরুতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের সবাই ওই নির্মল আনন্দের ঈদ পেয়েছেন।

আমরা যারা ওই নির্মলতার দেখা পেয়েছি তারা জানি কী গভীর প্রাণ ছিল তাতে। তখনকার সমাজের দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি লেখার শুরুতেই বলেছি। অসাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধ। বিশেষ করে শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য এ দুটি ছিল জরুরি। আমরা ঈদে নতুন জামা বানাতাম, আবার সে জামা পরে বাসায় বাসায় সেমাই খেয়ে বেড়াতাম। আমাদের সঙ্গে কিন্তু সামিল হত হিন্দু সম্প্রদায়ের বান্ধবীরাও। আমাদের উৎসব যেন ছিল ওদেরও। যেমনটি ওদের উৎসব ছিল আমাদের। ওই রথযাত্রার মতো দূর্গাপুজায়ও আমরা ঘুরতাম বাইরে, প্রসাদ নিতাম, দেবী দেখতাম।

এভাবে প্রতিটি উৎসব তখন ছিল সর্বজনীন। বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের উৎসব যখন এভাবে অবিশেষ হয়ে ওঠে তখন তাতে মাধুর্য থাকে অনেক। তার স্মৃতি মনের গভীরে গেঁথে যায়।

সিলেটকে আমরা বারো আউলিযার পূণ্যভূমি বলে ডাকি। এখানে জাতিগত বৈচিত্র্যও কিন্তু অনেক। আমরা শৈশবে দেখেছি মণিপুরিপাড়ায় থাকতেন মণিপুরি আদিবাসীরা। তাদের সঙ্গে আমাদের কিছু মিথস্ক্রিয়া হত। আবার বিশাল অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা চা বাগানে কাজ করতেন কুলি সম্প্রদায়। তাদের সঙ্গে নগরবাসীর নানা রকম যোগাযোগ ছিল। ফলে আমরা একটি বিশাল বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছি। যেখানে পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যার যার সংস্কৃতির চর্চা করেছি। প্রয়োজনে একের সংস্কৃতিকে অন্যে ভালোবেসেছি, পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় পরস্পরকে সাহায্য করেছি।

পাশাপাশি ছিল সামাজিক নিরাপত্তা, মেয়েশিশুদের জন্য বিশেষ করে যেটি জরুরি। তাই তো আমরা উৎসবে আরও এতটা প্রাণ পেয়েছি। এই যে আমরা মেয়েরা তখন দলবেঁধে ঘুরতে চলে যেতাম, এ বাসা, ও বাসা— অভিভভাবকরা কি এত দুশ্চিন্তা করতেন? মোটেই না। শুধু উৎসবের সময় কেন বলব, এমনিতেও আমাদের খেলার জন্য ছিল অবারিত মাঠ, যেখানে আমরা খেলেছি। অভিভাবকদের টেনশন করতে হয়নি, খেলাশেষে বাসায় ফিরেছি।

আমার বাবা একসময় সিলেট থেকে বদলি হয়ে চলে গেলেন রাজশাহীতে। আমি ততদিনে প্রাইমারি স্কুলেল গণ্ডি পেরিয়ে স্কুলের উচ্চতর ক্লাসে। ভর্তি হলাম রাজশাহীর পি এন গার্লস হাই স্কুলে। ওখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেছি আমি। রাজশাহীতে পেলাম ভিন্ন একটি পরিবেশ। সেখানে তখনও জমিদারির অবশেষ ছিল। বিশাল বিত্ত-বৈভবে ঠাসা ওই জমিদার শ্রেণিটি ওখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে একই রকম অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত ও নিরাপদ ছিল ষাটের দশকের রাজশাহীও। ঈদ, পুজা সেখানেও সর্বজনীন উৎসব। সেখানে আমার নির্মল কৈশোরে একই রকম আনন্দে কেটেছে উৎসবের দিনগুলো।

আমাদের সময়ের সঙ্গে তুলনা করে, বিশেষ করে একজন শিশু বা কিশোর-কিশোরীর জন্য ঈদের আনন্দের কথা উঠলে আমি বলব, এখনকার সময়ে কৃত্রিমতা ও বাহুল্যের ঝোঁক বেশি। এখন উৎসবে জাঁকজমক থাকে, কিন্তু প্রাণ নেই। সবচেয়ে বড় যেটি সমস্যা তা হল, এখন উৎসব অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন নয় মোটেই। এক সম্প্রদায়ের উৎসবে অন্য সম্প্রদায় যোগ দেয় না, শত হাত দূরে থাকে। কেন যেন এখন পুজাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ে্রই উৎসব, ঈদ মুসলমানের। যার যার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আমরা আছি।

সব মিলিয়ে সমাজে তাই একটা অস্থিরতা; চাকচিক্য আছে, নেই প্রাণপ্রাচুর্য। কথাগুলো নেতিবাচক মনে হতে পারে। কিন্তু সব শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য সহায়ক সুন্দর একটি সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে বৈকি।