বেপরোয়া শিল্পায়ন ও চাপ-তাপের শ্রম আইন

সেলিম খান
Published : 23 July 2013, 08:31 AM
Updated : 23 July 2013, 08:31 AM

চাপ ও তাপ ছাড়া যেন আমাদের এ দেশে ভালো বা জনবান্ধব কোনো কিছুই হয় না। তা সে দেশের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই হোক আর আন্তর্জাতিক চাপেই হোক। অথচ যে মানুষজনের ভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন তাদের মাধ্যমে প্রণীত কোনো নীতি-পদ্ধতি বা আইনকানুনই কেন যেন জনবান্ধব হতে চায় না।

এর একটা ব্যাখ্যা হয়তো দেওয়া যেতে পারে এভাবে যে, যারা জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন তারা তো আর জনবান্ধব নন। তারা হচ্ছেন টাকার মালিক ( বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিক)। রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা যায়, লুটেরা ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি। তাই তারা সংসদে বসে যে সব আইন পাস করেন তা জনবান্ধব হবে না এটাই স্বাভাবিক নয় কি? যাহোক, যে বিষয়ে লিখব বলে উপরের কথাগুলো বললাম সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্পায়নের পূর্বাপর ও শ্রম আইন।

জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের দেশটি বিশ্বের সাত নম্বরে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অর্থনীতিও শ্রমনির্ভর। সর্বশেষ তথ্য মতে, এ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ৬০ শতাংশই শিল্পশ্রমনির্ভর। আর বাকি ৪০ শতাংশ কৃষিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল।

একসময় বলা হত দেশের আশিভাগ মানুষের যাপিত জীবন কৃষি ও কৃষিশ্রমনির্র্ভর। তবে এ হার সম্প্রতি অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে দেশে গার্মেন্টের মতো হালকা ও মাঝারি মানের শিল্পবিকাশই এ হার কমিয়ে আনার অন্যতম কারণ।

তবে কৃষিশ্রম-নির্ভরতা কমে আসুক বা একসময় বেশিই থাকুক, কখনও-ই এটি শিল্প অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তাই প্রণীত হয়নি কৃষিখাতসংশ্লিষ্ট শ্রম আইন। যা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাই এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছা রইল পরে কোনো এক সময়।

স্বাধীনতার পর অন্য সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় দেশের শ্রমপরিবেশ। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পমালিকদের ফেলে যাওয়া কলকারখানা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেওয়ায় ভিন্ন পরিস্থিতির জন্ম হয় দেশের শিল্পখাতে। এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক চিন্তনের বাত্যাবরণে চলতে থাকে দেশের শিল্পখাতের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা। যে কারণে এসবের শ্রমপরিবেশ ও শ্রমঅধিকারের মতো বিষয়গুলোতেও দাবি ওঠে জনকল্যাণকর হয়ে ওঠার। কিন্তু শ্রমিকদের সে আকাঙ্ক্ষা উবে যায় রাষ্ট্রব্যবস্থার ধরন ও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে।

একাত্তরে যে ১১ শতাংশ পুঁজির মালিকানা নিয়ে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল বাঙালি ধনিক শ্রেণি, তাদেরই শাসন ও শোষণ কায়েম হয় রাষ্ট্রের প্রতি পর্যায়ে। হোঁচট খায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক চিন্তন বাস্তবায়নের সামঞ্জস্যহীন প্রয়াস। যুদ্ধ-পরবর্তীতে মুক্তিকামী বাঙালির জনচেতনা তথা একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় আমলে (অন্তত বহিরাবরণে) নিয়ে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপরিচালনা শুরু করলেও খুব শিগগিরই বঙ্গবন্ধু সরকারকে নিতে হয় বিরাষ্ট্রীয়করণের উদ্যোগ।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায় বিরাষ্ট্রীয়করণ। একেবারে স্বল্পদামে, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিক্রি করা হয় রাষ্ট্রীয় সব শিল্পকারখানা। অবাধ করে দেওয়া হয় বেসরকারি পুঁজির চলাফেরা। মুক্তিযুদ্ধের জনচেতনা পেছনে ফেলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে সর্বাত্মকভাবে একটি 'লুটেরা ধনবাদী' দেশ।

এ ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ব্যাংক ও উন্নত দেশসমূহের চাপে ও প্রেসক্রিপশনে ধ্বংস করে ফেলা হয় দেশের ভারি শিল্প বিশেষ করে পাটশিল্প। অন্যান্য কলকারখানাও অনেকটাই পানির দরে বিক্রি করে দেওয়া হয় স্বাধীনতার পর শাসনব্যবস্থার নেতৃত্বে আসা ধনিক শ্রেণির কাছে। কীভাবে কতটা কম দরে এসব বিক্রি করা হয়েছে তার সার্বিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে বাংলাদেশ বেসরকারিকরণ কমিশনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর সম্পর্কিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।

এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের শিল্পব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে যায় ভারি শিল্পের অবস্থান। আশির দশকের শুরুর দিকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় যোগ হয় মাঝারি ও হালকা শিল্প। যার মধ্যে অন্যতম হিসবে জায়গা করে নেয় তৈরি পোশাক শিল্প। শিল্পটি গোড়া থেকেই সিংহভাগ সরকারি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠতে শুরু করে। কর-সুবিধা, বন্ড-সুবিধা, নগদ অর্থ সহায়তা, সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ ও ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ সুবিধার মতো বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার মাধ্যমে আজও এটি চলছে।

কর-সুবিধার কথাই যদি ধরি তাহলে দেখা যায়, শুধু গেল ২০১২-১৩ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে কর দিয়েছে এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে সরকারের কাছ থেকে তারা নগদ অর্থ সহায়তা নিয়েছে এক হাজার ৪১২ কোটি সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা।

আর গেল পাঁচ বছরের হিসেবে দেখা যায়, রফতানিমুখী বস্ত্রখাতের মালিকরা সরকারি কোষাগার থেকে চার হাজার ২১৫ কোটি টাকার নগদ অর্থ সহায়তা নিয়েছেন। এর সঙ্গে রয়েছে প্রায় চল্লিশ লাখ শ্রমিকের (যার অধিকাংশই নারী) সস্তাশ্রম। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে সস্তাশ্রম হিসেবে বিবেচিত।

এমনসব সরকারি প্রণোদনা আর সস্তাশ্রম মিলিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের বিদেশি বাজার এখন বছরে প্রায় বিশ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া দেশের আরও যেসব বিকাশমান মাঝারি ও হালকা শিল্প প্রক্রিয়া রয়েছে সেগুলোর অন্যতম ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, হিমায়িত মাছ, বিশেষ করে চিংড়ি। হালে ফের যোগ হয়েছে পাটশিল্প। এগুলোতেও রয়েছে নানা ধরনের সরকারি সুবিধা ও প্রণোদনা। পাটশিল্পকে ফের বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে সরকার রফতানিমুখী পাটজাত পণ্যে প্রতি একশ টাকায় ১০ টাকা নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

কাঠামোর দিক থেকে হালকা ও মাঝারি হওয়ায় আর বেপরোয়া সরকারি সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠায় এসব শিল্পমালিকরা দ্রুতই হয়ে উঠেছেন বিপুল সম্পদ ও অর্থের মালিক। এ প্রসঙ্গে খোদ দেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে পোশাকশিল্প মালিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ''অধুনা আমাদের দেশে একটি লক্ষ্যণীয় বিত্তশালী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরকার সবসময় তাদের কাছ থেকে যথাযথ রাজস্ব বা কর আদায় করতে পারে না।''

বলতে গেলে স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এমনিতর এক বেপরোয়া ধনিক গোষ্ঠী আজ বিপুল শক্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। তাই তারা শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত এমন কোনো আইন বা কাঠামো মানতে চাচ্ছেন না যা তাদের পক্ষে যায় না।

সবশেষ শ্রম আইন সংশোধনে সরকারের উদ্যোগ এর একটি বড় প্রমাণ। কলেবরের দিক থেকে বেশ বড় হয়ে ওঠা তৈরি পোশাক শিল্পে বিরাজমান নানা অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা বিবেচনায় নিয়ে প্রথম একে শ্রম আইনের অধীনে আনা হয় ২০০৬ সালে। যদিও তাতে জোর আপত্তি ছিল বস্ত্রখাত-সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে রফতানিমুখী বস্ত্রখাত মালিকদের।

এরই ধারাবাহিকতায় নানামুখী চাপ ও তাগিদে বর্তমান সরকারের সময়েই ২০১০ ও ২০১২ সালে দু দফা শ্রম আইন সংশোধনের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে ফের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর সংশোধনী প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয় চলতি বছরের ২২ এপ্রিল।

প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়ার এ বিশ্বে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় যে কোনো আইনের সংশোধন প্রয়াসই ইতিবাচক বলে বিবেচিত হওয়ার অবকাশ রাখে। কিন্তু সরকার মালিক শ্রেণির, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের চাপে এমন কিছু ইস্যুতে সংশোধন প্রস্তাব করে যা হয়ে ওঠে শ্রমিকস্বার্থবিরুদ্ধ।

নিয়মমতো শ্রম আইনের যে কোনো সংশোধনই সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতেই করা হয়ে থাকে, এমন দাবি বিশেষ করে সরকার ও মালিকদের দিক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শ্রমিক প্রতিনিধিদের অভিযোগ, খুব কম সময়েই তাদের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়।
এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। খোদ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মাইকেল শিপার বলেছেন, মালিকদের চাপে শ্রমিকবান্ধব অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না।

শ্রম আইন সংশোধন প্রক্রিয়া, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন এসবের মাঝে দেশের গার্মেন্ট শিল্পে ঘটে এক মানুষসৃষ্ট বিপর্যয়। রানা প্লাজা ধসে মারা যান ১১শর বেশি শ্রমিক। আহত হন আড়াই হাজারের বেশি। যাদের বেশিরভাগই এখন পঙ্গুজীবনের শিকার। এ বিপর্যয়ে টনক নড়ে বাংলাদেশের সস্তাশ্রমে তৈরি পোশাক-কিনিয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর। তারা সোচ্চার হয় বাংলাদেশের কারখানা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার দাবিতে। সে সঙ্গে সামনে চলে আসে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিও। যেগুলোর কোনোটাই দেশের অন্যতম বৃহৎ এ শিল্পে স্বীকৃতি পায়নি।

বিশেষ করে কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রশ্নে সোচ্চার হয় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু এ অভিযোগেই দেশটি বাতিল করে বাংলাদেশকে দেওয়া বাণিজ্য অগ্রাধিকার সুবিধা বা জিএসপি। একই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলো। যারা আমাদের দেশের তৈরি পোশাকের মোট রফতানির ৬০ ভাগই আমদানি করে থাকে।

আন্তর্জাতিক ক্রেতা সম্প্রদায়ের দাবি মেটাতে আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি ফিরে পেতে ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সংশোধিত শ্রম আইনের খসড়া আবারও যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় সরকার। যাচাই শেষে যা জাতীয় সংসদে আইন হিসেবে অনুমোদিত হয়েছে গেল ১৫ জুলাই।

কিন্তু সবশেষ সংশোধিত এ আইনকে আগের আইনের চেয়েও অনেক বেশি শ্রমিকস্বার্থবিরুদ্ধ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিকস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপে আইনে মোটাদাগে শ্রমিক কল্যাণে কিছু একটা করার আপাত প্রয়াস দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে নানা ধরনের শর্তের বেড়াজালে আটকে রাখা হয়েছে।

যেমন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রসঙ্গেই বলা যায়। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৭৮ ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সময় শ্রমিকদের নামের তালিকা মালিকদের দিতে হত যা বর্তমান সংশোধিত আইনে বাদ দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দিতে শ্রম অধিদফতরের যুগ্ম মহা পরিচালককে যথাযথ করা হয়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

কিন্তু একই সঙ্গে ১৭৯ ধারায় একটি নতুন উপধারা যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, শ্রম পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে 'সন্তুষ্ট' হলেই নিবন্ধন দেবেন। কিন্তু আমাদের দেশে 'সন্তুষ্ট' শব্দটির সঙ্গে নানা ধরণনের সমীকরণ জড়িত। যে সব সমীকরণের মধ্যে থাকে রাজনৈতিক বিবেচনা, দুর্নীতিপরায়ণতা এবং মালিকপক্ষের প্রভাব।

ট্রেড ইউনিয়ন সহজীকরণ করার দাবি করা হলেও এ আইনের ১৭৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে হলে সে উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিক সংখ্যার ৩০ শতাংশের সম্মতি থাকতে হবে। তা না হলে ইউনিয়নের নিবন্ধন পাওয়া যাবে না।

এ বিধানের ফলে ছোট কারখানাগুলোতে এ উদ্যোগ কিছুটা সহজ হলেও বড় কারখানাগুলো যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেন সেখানে এটা সম্ভব হবে না। এর পাশাপাশি মালিকদের অদৃশ্য হুমকি-ধামকি তো রয়েছেই। এছাড়া আইনটিতে বলা হয়েছে, কোনো কারখানায় স্ট্রাইক বা ধর্মঘট করতে হলে সংশ্লিষ্ট কারখানার দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকতে হবে। যা বিদ্যমান বাস্তবতায় কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বর্তমান সংশোধিত শ্রম আইনের সবচেয়ে বেমি শ্রমিকস্বার্থ-বিরুদ্ধ ধারাটি হচ্ছে ২৩ ধারার ৪ এর ১১ উপধারা। এতে বলা হয়েছে, ''জরুরি কাজ সম্পাদন করতে অথবা অপরিহার্য কারণে স্থায়ী ধরনের কাজে শুধু সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে বা চুক্তিভিত্তিক বা ঠিকাদারের (আউটসোর্সিং) মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করা যাইবে।''

এ শ্রমিক সংখ্যা কারখানার মোট শ্রমিকের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারবে। তবে এরা কারখানার বৈধ শ্রমিক বলে গণ্য হবে না। তাদের থাকবে না ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। আসলে এমনসব শর্তের বেড়াজালে কারখানার বৈধ শ্রমিকেরা কখনও-ই ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন না এটা জোর দিয়েই বলা যায়।

ক্রমিক নম্বর ৭ এর ধারা ২ (৪৫)-এ মজুরির যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে 'বাড়িভাড়া' বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই অযৌক্তিক ও আইনের অন্যান্য বিধি-বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংশোধনীতে বলা হয়েছে 'বাসস্থান সংস্থান'। প্রকৃত অর্থে 'বাড়িভাড়া' ও 'বাসস্থান সংস্থান' এক কথা হতে পারে না। শুধু তাই নয়, এতে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণে 'বাড়িভাড়া' বিষয়টিকে আমলে নেওয়া সম্ভব হবে না।

এছাড়াও শ্রম আইন সংশোধন সম্পর্কিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির আলোচনায় উত্থাপিত শ্রমিক প্রতিনিধিদের দাবি এমনকি সরকারি প্রতিশ্রুতি থাকার পরও মাতৃকল্যাণ সুবিধা ৬ মাস করা যায়নি। গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের আওতায় আনার কথা সংশোধনীতে নেই। এমনিক ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত কর্মস্থলে যৌন নিপীড়ন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও এ আইনে নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতিকারের বিধান রাখা হয়নি।

এছাড়া আইনে শ্রমিকদের নিয়োগ ও বরখাস্ত, প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে মালিকের অনিয়ম ঠেকানোর উপায় সম্পকির্ত কোনো বিধি-বিধানই স্পষ্ট করা হয়নি। যেমন বলা যায়, কোনো শ্রমিক বা কর্মচারি-কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ নয় মাস না হলে তিনি বা তারা ওই প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন না।

এ ক্ষেত্রে সঙ্গতভাবেই বলা যায়, কোনো মালিকই একজন শ্রমিকের চাকরি নয়মাসের বেশি হতে দেবেন না। কোনো না কোনো অজুহাতে তাকে ছাঁটাই বা বরখাস্ত করবেন। আর সেমনটা হলে তিনি কোনো বেনিফিটই পাবেন না। শ্রমিক বেশি বেতনের আশায় নয়মাসের আগেই কারখানা বদল করতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও তিনি বঞ্চিত হবেন।

এসব বিবেচনায় শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও শ্রমিকস্বার্থ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কথা হচ্ছে, এমনিতর আরও অনেক শর্তের বেড়াজালে ফেলে শ্রমিক কল্যাণের দাবি করা হয়েছে। এটা শ্রমিকের দুর্দশা দূর করার হাতিয়ার হিসেবে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে আইনের এসব সংশোধনে মালিকরা বেশ সন্তুষ্ট। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ আইনটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এটি বর্তমান সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ।

গেল ১৮ জুলাই মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয়তে বলেছে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিদ্যমান সমস্যাবলীর সমাধানে শ্রম আইন ফের সংশোধন করা হয়েছে। আর তা অনুমোদিতও হয়েছে দেশটির জাতীয় সংসদে। পত্রিকাটি বলছে, শ্রমিকদের ইউনিয়ন বা শ্রমসংঘ গঠন সহজ করার লক্ষ্যে শ্রম আইন পরিবর্তন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে বড় রকমের দুর্বলতা রয়েই গেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভবনধস, আগুনসহ অন্যান্য কারণে শত শত মানুষের দুঃখজনক মৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধে যতটা পদক্ষেপ থাকা দরকার ছিল, তা আইনটিতে নেই।

পত্রিকাটি নতুন শ্রম আইনকে 'হাফ-হার্টেড' বা অসম্পূর্ণ আখ্যা দিয়ে এ-ও বলেছে, এ আইন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রায় চল্লিশ লাখ শ্রমিককে বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ থেকে খুব কমই সুরক্ষা দিবে। সেজন্য ইউরোপ-আমেরিকাকে অবশ্যই বাংলাদেশের ওপর চাপ আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস।

আর সবশেষ যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেদেশে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি স্থগিতে তিন সপ্তাহ পর তা ফিরে পেতে বাংলাদেশ সরকারকে একটি কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে। ওবামা প্রশাসন বলেছেন, সে দেশে বিনা শুল্কে পণ্য রফতানি করতে হলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যেন সহজে ইউনিয়ন করার অধিকার পান এবং নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে বেশকিছু নিয়ন মেনে চলতে হবে। একে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছেন, 'বাংলাদেশ অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৩', অথচ খোদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিই বলছে, একজন শ্রমিককে ঠিক ততটাই কাঠামোতে আবদ্ধ রাখ যাতে সে তার তথা মালিকের কাম্য উৎপাদনশীলতা ধরে রেখে আবারও শ্রম দিতে পারে। আর উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে একজন শ্রমিকের দরকার কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মপরিবেশ ও সর্বোপরি মজুরি। একজন শ্রমিক এর সবটাই অর্জন করেন তার শ্রমের বিনিময়ে। শ্রমিকের এ শ্রম বিক্রির পথ ও পদ্ধতি কী ও কেমন হবে তা ঠিক করতেই প্রণীত হয় শ্রম আইন। এটি করে থাকেন একটি দেশের সরকার। আর তা মানতে বাধ্য থাকেন শিল্পমালিকরা।

শ্রম আইন প্রণয়ন করতে বিশ্বের দেশে দেশে মালিক, শ্রমিক প্রতিনিধি ও সরকারের সমন্বয়ে কাজ করে ত্রিপক্ষীয় একটি কমিটি। সব পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনগণের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি 'সরকার' একটি নীতি নয়, বরং প্রণয়ন করেন একটি আইন।

অথচ এটি আইন না হয়ে যদি হত 'নীতি', তাহলে বোধকরি সমস্যার সমাধান অনেকটাই সহজ হত। কারণ আইন শব্দটির মধ্যে একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আছে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। কেননা যে উৎপাদকের বা শ্রমিকের শ্রমে ও ঘামে পণ্যে মূল্য সংযোজিত হচ্ছে তাকেই বেঁধে ফেলা হচ্ছে আইনের কাঠামোতে। এর চেয়ে বড় বৈপিরীত্য আর কী হতে পারে!

তাই একে 'নীতি' হিসেবে বিবেচনায় নিলে তা প্রণয়নের ক্ষেত্রে চিন্তনের জায়গা অনেকটাই শ্রমিকবান্ধব হতে পারে।

সেলিম খান : সংবাদকর্মী।