ঘাতকদের বিচার: সন্তুষ্টির কারণ তো আছেই

আবদুল মান্নান
Published : 17 July 2013, 02:42 PM
Updated : 17 July 2013, 02:42 PM

১৭ জুলাই, ২০১৩ দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক বাহিনী আল-বদরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও বেগম জিয়ার মন্ত্রিসভার সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মো. মুজাহিদের রায় ঘোষণা করছিল। এ সময় হঠাৎ একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ল আমার।

বেশ কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টিভিতে উনসত্তরের রাজপথ-কাঁপানো আমাদের সময়কালের ছাত্রনেতা তোফায়েল আহম্মেদ, আমাদের সকলের প্রিয় তোফায়েল ভাই ওই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। ২০০২ সালের একটি ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তিনি। তোফায়েল আহম্মেদকে বিমান বন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাকে প্রিজন ভ্যানে করে কুষ্টিয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ি ফেরিতে উঠলে তিনি প্রিজন ভ্যানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন বাংলাদেশের পতাকা লাগানো একটি গাড়িতে বেগম জিয়ার সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মো. মুজাহিদ বসে আছেন।

তোফায়েল ভাই কথাগুলি বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলছিলেন, যারা দেশটা স্বাধীন করল তারা প্রিজন ভ্যানে আর যারা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারা পতাকাওয়ালা গাড়িতে। হায়রে আমার বাংলাদেশ!

১১ বছর পর ১৭ জুলাই ২০১৩-তে বেগম জিয়ার সেই মন্ত্রী আলী আহসান মো. মুজাহিদের বিচারের রায় যখন ঘোষণা করা হচ্ছিল এবং সব টিভি চ্যানেল প্রতি মিনিটে তার আপডেট দিচ্ছিল– তখন তোফায়েল ভাইয়ের ওই দিনের কথা স্মরণ করে আমি নিজেও অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।

বাংলাদেশ আসলেই একটি অদ্ভূত দেশ। হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই দেশের মানুষের হৃদয়টা পলিমাটির মতো নরম আর আকাশের মতো উদার। কিন্তু আবার দেশের প্রয়োজনে সঠিক নেতৃত্বের অধীনে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করতে পারে।

সেই একই দেশের কিছু মানুষ সেই দেশটির জন্মদাতা পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে পারে। হত্যাকারীরা যখন দেশের ক্ষমতা দখল করে তখন এই দেশটির বিরুদ্ধে যারা একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করতে পারে।

এই সব কথা যখন ভাবছি তখনই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল আলী আহসান মো. মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যে সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল তার পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

একাত্তরে জামায়াতের যে ক'টি কিলিং স্কোয়াড ছিল তার মধ্যে আল-বদর বাহিনী ছিল এলিট। এতে শুধুমাত্র ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ছাত্র শিবির) পরীক্ষিত সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হত এবং তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেছে বেছে দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যা করা। তারা হত্যা করেছিল সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন, আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনসহ অনেককে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলেও এটি হবে একটি মেধাশূন্য জাতি। আর এরকম একটি জাতি খুব বেশিদিন স্বাধীন থাকতে পারে না। তারা আর সপ্তাহ দুয়েক সময় পেলে দেশের এই সর্বনাশটুকু করে ফেলতে পারত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বক্ষণে এই ঘাতকদের অনেকেই দেশত্যাগ করে তাদের নিজ দেশ পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিল। এদের অন্যতম ছিল গোলাম আযম যাকে ট্রাইব্যুনাল ১৫ জুলাই, ২০১৩ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া সত্ত্বেও সবাইকে হতাশ করে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

সকলে গোলাম আযমের মতো ভাগ্যবান ছিল না। তারা এই দেশেই থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কেউ কেউ অতিবামদের সংগঠন সর্বহারা দলের সদস্য হয়ে শ্রেণিশত্রু খতম করার নামে মানুষের গলাকাটা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। কেউ কেউ জাসদ গঠিত হলে তাতেও ভিড়েছিল। ছোটখাট অনেককে পরবর্তীকালে দেখেছি আজমীর শরীফের খাজা বাবা দরগাহে গিয়ে খাদেমদের খাদেমগিরি করতে।

শুনেছি আলী আহসান মো. মুজাহিদ দেশেই ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার নামে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে ছাতা মেরামতের কাজ করতেন। সেই ঘাতকটির আজ বহুপ্রতিক্ষীত মৃত্যুদণ্ডের রায় হল। এ জন্য এদেশের স্বাধীনতার পক্ষের কোটি কোটি জনগণকে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই মামলার প্রসিকিউসন থেকে শুরু করে তদন্তকাজ– সবকিছুতেই যারা জড়িত ছিলেন তাদের কাছে জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে।

গোলাম আযমকে যখন ট্রাইব্যুনাল প্রত্যাশিত ফাঁসির আদেশ না দিয়ে নব্বই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে তখন দেশের কোটি কোটি মানুষ নিশ্চিতভাবে হতাশ হয়েছে এবং এই হতাশা তারা নানাভাবে প্রকাশ করেছে।

১৭ জুলাই, ২০১৩ মুজাহিদের রায় দেওয়ার পূর্বক্ষণে এই প্রসঙ্গে আদালত তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ''আদালতের রায় নিয়ে অনেকে নানা রকম সমালোচনা করেন। কিন্তু আমরা (বিচারপতিরা) তার জবাব দিতে পারি না।''

মহামান্য আদালতের মন্তব্য যথার্থ বলেই মনে হয়। কারণ আমরা অনেকেই (আমি নিজেও) অনেক সময় এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগ দ্বারা তাড়িত হই যা হওয়া উচিত নয়। তবে এটা হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংষ্কৃতি।

সকলের মনে এমন প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক যে আগামীতে যদি সরকার পরিবর্তন হয় এবং যারা একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে নির্দ্বিধায় পতাকা তুলে দেয় তারা যদি ক্ষমতায় আসে– তখন তারা যে দণ্ডপ্রাপ্তদের ছেড়ে দিয়ে আবার তাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে?

না নেই এবং নেই বলেই আবেগতাড়িত হয়ে অনেকেই কিছু কিছু রায়ের ব্যাপারে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে থাকেন।

তবে কোনোভাবে আদালত বিতর্কিত হোক তা নিশ্চয়ই কেউ চান না। কারণ সকলে এই সত্যটি উপলব্ধি করেন যে এই যাত্রায় যাদের বিচার হচ্ছে সেই বিচারকাজ যদি একটি যৌক্তিক পর্যায়ে না পৌঁছে তাহলে আগামীতে যদি কোনো কারণে সরকার পরিবর্তন হয় তাহলে সবকিছু শুধু ভেস্তেই যাবে না, যারা এই বিচার করছে বা বিচারের জন্য দীর্ঘদিন সোচ্চার ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা দিয়ে তাদের উল্টো বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে।

এর আলামত তো ইতোমধ্যে কিছুটা দেখা গেছে। ট্রাইব্যুনালের কাজ যখন শুরু হয় তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম জিয়াসহ তার দলের অনেক নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে বলে বেড়িয়েছেন, এই ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে একটি সরকারি আজ্ঞাবাহী ট্রাইব্যুনাল এবং সরকার বিরোধী জোটের একটি দলকে (জামায়াত) নেতৃত্বশূন্য করার জন্য বিচারের নামে প্রহসন করছে। সিলেট ও বগুড়ার জনসভায় বেগম জিয়া তো গোলাম আযম গংদের মুক্তি দাবি করে বক্তব্যও রেখেছেন। সুতরাং জনগণের মনে শঙ্কা থাকাটা অমূলক নয়।

জনগণকে শঙ্কামুক্ত করার দায়িত্ব অনেকটা সরকারের। বর্তমান সরকার বিয়াল্লিশ বছর পর এই ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করে তাদের একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এ জন্য জাতি বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে।

তবে তারা পুরো বিষয়টাকে আরেকটু সামনে নিয়ে যেতে পারেন। দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে ট্রাইব্যুনালের রায়গুলি কার্যকর করা দরকার যেমনটি প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আশা করেছেন। গোলাম আযমের রায়ের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত এই সন্তুষ্টির প্রধান কারণ বিয়াল্লিশ বছর পর এই ঘাতকদের বিচার করতে পারা। নিঃসন্দেহে এটি সন্তুষ্টির একটি কারণ।

তবে দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার উচ্চ আদালতে আপিল করবে যেমনটি প্রসিকিউশনও আশা করে। সংসদে বর্তমান সরকারের যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সুতরাং সরকার চাইলে সংবিধানের ৪৯ নং ধারা, যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া আছে সেই ধারায় একটি লাইন যোগ করতে পারে এই বলে যে, যে সকল ব্যক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হবে তারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাজা মওকুফের জন্য বিবেচিত হবে না।

এ যাবৎ ট্রাইব্যুনাল যতগুলি রায় দিয়েছেন তার প্রায় সবগুলি রায়ে জামায়াত-শিবিরকে (ছাত্র সংঘ) সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একটি দেশে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন আইনগতভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। সুতরাং এখনই সময় এই দুটি সন্ত্রাসনির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ করা।

বঙ্গবন্ধু নিঃশঙ্কচিত্তে তা করেছিলেন। তার কন্যা কেন তা পারবেন না? রাতে হয়তো তোফায়েল ভাই একটু শান্তিতে ঘুমাবেন।

এই পবিত্র রমজান মাসে একাত্তরের সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

১৭ জুলাই, ২০১৩