জাহাঙ্গীরনগরে হাইকোর্ট দর্শন ও হস্তী দর্শন

মানস চৌধুরী
Published : 3 August 2010, 04:01 PM
Updated : 3 August 2010, 04:01 PM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মাস্টার হিসেবে প্রায়শই আমার 'লজ্জা' নামক বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হতে হয়। অন্তত ইদানীংকালে। অনেক সহকর্মীকেই বলতে শুনি যে তাঁদের লজ্জা লাগে নানান রকম খবর শিরোনামে জাহাঙ্গীরনগর আসে বলে। এই কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালের এক চিকিৎসকও কায়দা করে জানতে চাইলেন জা.বি.'র সংবাদ-শিরোনাম-যোগ্যতায় আমার কেমন লাগে, বা হয়তো বোঝাতে চাইলেন যে আমার লজ্জা-লাগা উচিত। হতে পারে আমার লজ্জা-ঘেন্না কম।

আবার এও হতে পারে লজ্জা বা ব্রীড়ার মতো কোমলানুভূতি আমার গজিয়ে ওঠেনি বিশেষ। এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে কীসে ব্রীড়াবনত হতে হয়, কীসে কৌতুকবোধ করতে হয় আর কীসে নিয়মমাফিক ক্রোধ অনুশীলন করতে হয় সেসব নিয়ে আমার ফয়সালা স্পষ্ট। সারাংশ হলো লজ্জা আমার বিশেষ হয় না। হবার কোনো কারণও আমি খুঁজে পাই না। যেসব সহকর্মীদের লজ্জা হয় তাঁদের বড় একটা অংশকেই আমার কর্তব্য-নির্ধারণে সঙ্কটাপন্ন মনে হয় কেবল।

বেহায়া আমাদের সমাজে গালি বিশেষ। অনুশীলনলব্ধ স্বভাবে এই গালির একজন চৌকষ গ্রহীতা হিসেবে নিজেকে আমি প্রমাণ দিয়ে ফেলেছি অনেক বছর ধরেই। আমার উপায়ই বা কী! ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের নেতারা একটার পর একটা হল দখলের মহড়া দিলে সংশ্লিষ্টদের 'লজ্জা' হয় না; সেটার প্রতিবাদে মিছিলের খবর পত্রিকায় এলে তাঁরা লজ্জাবনত হন। এই নেতারা ইউনিয়ন পরিষদের গমের বস্তা নিয়ে সটকে পরলে কিংবা ভবন নির্মাণের ঠিকাদার থেকে জোরপূর্বক বখশিস (আসলে বখরা) নিলে তাঁদের লজ্জা হয় না; সেই খবর পত্রিকায় এলে হয়। প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের যৌন নিরাপত্তা বিধান করতে না পারলে তাঁদের লজ্জা হয় না, কিন্তু শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন করলে তাঁরা শরম পান।

এমনকি ছাত্রদের শারীরিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারার ব্যর্থতায় গ্লানির কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই, আছে যদি ওই আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার দাবি করে কোনো প্রতিবাদ-প্রদর্শন করেন তা নিয়ে। কোনো সহকর্মী অন্য সহকর্মীর সঙ্গে পেশাবহির্ভূত অমর্যাদাকর আচরণ করলে লজ্জার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় না। তবে লাজে-মরে-যাবার কথা শোনা যায় যখন আক্রান্ত সহকর্মী আপত্তি তোলেন। এমনকি একটা পুকুর কাটা উদ্বোধন করতে পুকুর বিষয়ক বা পানি বিষয়ক বা জাহাজ চলাচল বিষয়ক কোনো মন্ত্রী এলেও এঁদের লজ্জা হয় না, গৌরব হয়।

সম্ভবত, কাটা শেষ হলে এবং কিছু দর্শনীয় পানি জমলে, শ্বেতপাথরের একটা ফলকে মন্ত্রীর নামও খোদাই করা হবে। খোদাই জানেন! এহেন একটা লজ্জা-ব্যবস্থাপনার একজন গুণগ্রাহী থাকা সম্ভব কীভাবে! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক পালিয়ে-বেড়ানোর উপায় হিসেবে লজ্জা পাওয়ার প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমার মনে হয়, একটা নিয়মনিষ্ঠ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে পারলে আরও কিছু লাজুক শিক্ষক বেলাজ হবার গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন, এবং সম্পৃক্ত হয়ে প্রসঙ্গ ধরে কথা কইবেন। হয়তো। কোনোদিন।

নিজ কর্ম-এলাকা বলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক আলাপ করবার সুযোগ, এবং প্রেষণা, দুটোই আছে। আছে আরও নানান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলবার উপযুক্ত কারণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ গতিপ্রকৃতি; সরকার ও রাষ্ট্রের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ; বিশ্বব্যাঙ্কের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবার বাসনা ও উসখুসানি; দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার বিদ্যাজাগতিক এজেন্ডার রদবদল ঘটিয়ে দিতে পারার সামর্থ্য; গবেষণার নামে প্রাক-ফয়সালা ধর্মী সুপারিশপত্রের পুনর্মূষিক লাভ; প্রাইভেট উচ্চশিক্ষায়তনগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের ল্যাজে-গোবরে সম্পর্ক; প্রায় যে কোনো ব্যাবসা থেকে এসেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালাবার অনুমোদন লাভ; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের নিরন্তর গীবৎ; পেশাবাজারে প্রাইভেট-কর্পোরেট সিন্ডিকেটের তুলকালাম অবাধ ক্ষমতা; এনজিও স্থাপনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলবার দুর্দান্ত কল্পনাশক্তি ও সামর্থ্য; বিদেশী দাতাসংস্থাদের সঙ্গে 'সম্পর্কে'র সুবাদে তাদের 'এ্যাকাডেমিক ক্রেডিবিলিটি' ও 'প্রফাইল' বৃদ্ধি; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের বেতন-টেতন কম হওয়াতে প্রায় সর্বদাই মুখব্যাদান করে ভক্তিভাবে অনুগ্রহ যাচনা–এই তালিকাটা লম্বা হওয়াতেই বরং আমার লজ্জা করছে একটু।

কারণ এত বিষয় নিয়ে কথা কওয়ার সুযোগ আমার নেই। প্রকৃতির লীলা বড় কঠিন। মাথায় যত কিছু আসে, হাত তা কিছুতেই সহজে টাইপ করে ফেলতে পারে না। আপাতত, তাই, আমি ঠিক করেছি সাম্প্রতিক দুটো দর্শন-অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার আলাপ শেষ (বা শুরু, দরকার পড়লে) করব।

হাইকোর্ট দর্শন
হাইকোর্ট দেখার অভ্যাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের বেশ পুরনোই বলতে হবে। ক্যাম্পাসের ইতিহাস নিয়ে বিধিসম্মত কোনো গবেষণা কাজ হয়নি বলে সঠিক সন-তারিখ জানান দেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। আশা করি ইতিহাসের কোনো গবেষক, নিজের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও, এই কাজটা করতে শুরু করে দেবেন। তবে সাধারণ মানুষের স্মৃতিচারণ হিসেবে ভাবলেও কিছু দূর-অতীতে আমি মনে করতে পারি ১৯৯৩ সালের কথা যখন তৎকালীন ছাত্রদলের একদল অসন্তুষ্ট কর্মী (মতান্তরে ক্যাডার) শিক্ষকদের ক্লাব, অফিস ঘর ভাংচুর করে। মুখোশ পরে শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে বলেও জানা যায়।

এর ফল, কিংবা অজুহাত, হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় এক বছর বন্ধ ছিল। এই মামলাটা কোর্ট পর্যন্ত উঠেছিল। হাইকোর্টেই সম্ভবত। উৎসুক মানুষজন অবাক হয়ে জানলেন যে কোর্টে গিয়ে আক্রান্ত শিক্ষকদের মুখ্য অংশ অম্লান বদনে অস্বীকার করলেন যে তাঁদের উপর হামলা হয়েছে। নিন্দুকেরা আড়ালে আবডালে আবিষ্কার করে ফেললেন যে একটা 'ডীল' হয়েছে পক্ষ সমূহের মধ্যে। কেউই আমরা অবাক হই নাই যে এই পক্ষ কেবল ছাত্রদলের বিভিন্ন পক্ষ নয়। এর মধ্যে শিক্ষক দলাদলিতে সক্রিয় পক্ষও আছে। ফলে হামলাটির পিছনে 'জাতির বিবেক' থেকে থাকতে পারে এরকম অনুসিদ্ধান্ত লোকজন নিলেন, এবং ভদ্রতাবশে প্রায়শই গিলে ফেললেন। মার খেয়ে খাইনি বলার যে মহত্ত্ব তাতে হাইকোর্ট বিমূঢ় বোধ করেছিলেন কিনা জানা যায় না। তবে বিরোধী বিভিন্ন শিক্ষক গোষ্ঠী নিষ্পত্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে পাশাপাশি হাসাহাসি ঘুরেছিলেন বলে জানা যায়।

নিকট অতীতে হাইকোর্ট দেখানোটা ছিল সিভিল সমাজ ও এনজিও পক্ষ থেকে। বছর দুয়েক আগে। না দেখালে নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ছানোয়ার হোসেনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ আরেকবার বিবেচনা করবার প্রশ্নই আসত না। সিভিল সমাজের হস্তক্ষেপ স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেক সম্মানজনক নয় ঠিকই, কিন্তু নিরূপায় আন্দোলনকারীরা রেয়াত পেয়েছেন হাইকোর্টের কারণেই। স্বায়ত্ত্বশাসিত শিক্ষায়তন যদি গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে চারপাশের সংগঠনসমূহের হস্তক্ষেপ কাম্যই বরং।

অনেকেরই মনে পড়বে কথিত যৌন হয়রানিমূলক আচরণের পরও ছানোয়ার হোসেনের অবাধ বিচরণে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাঁর উপর হামলা করেছিলেন বলে জানানো হয়েছিল। এবং যথাসম্ভব দ্রুত শাস্তিও পেয়েছিলেন হামলাকারী শিক্ষার্থীরা। হাইকোর্ট সেটা নাকচ করে দেন এবং ছানোয়ার হোসেন প্রসঙ্গটিকে পুনর্তদন্তের নির্দেশ দেন। সাম্প্রতিক হাইকোর্টটিও কিন্তু দেখালেন আমাদের সহকর্মীরা, অবশ্যই যাঁরা তদন্ত করবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, এবং যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কাঠামোতে আছেন। তাঁদের সামনে ছিল দুটি ঘটনা–অধ্যাপক ছানোয়ার হোসেনের কথিত যৌন হয়রানি এবং ড. কাফি'র সহকর্মীকে কথিত যৌন হয়রানি।

অভিযোগ সেলের অনুমোদিত তদন্ত কমিটি ৮ই জুলাই প্রতিবেদন পেশ করে এবং সিন্ডিকেট ১৭ই জুলাই সিদ্ধান্ত নেয়। অধ্যাপক ছানোয়ার হোসেন পদাবনতি পান এবং দুই বছরের বাধ্যতামূলক ছুটি লাভ করেন। আর ড. কাফির বিষয়টি হাইকোর্টে নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়। অধ্যাপক ছানোয়ার এবং অধ্যাপক কাফি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দলাদলির দুই প্রান্তে অবস্থান করেন এই হিসেবটা লোকজন একটু হলেও মাথায় রাখছিলেন।

ফলে জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন না এরকম সহকর্মীরাও এমন একটা ফলাফল অনুমান করছিলেন যে ভিসি ও ভিসিপক্ষীয়দের স্নেহভাজন ড. কাফি আরও কিছু সময় নিশ্চিত করেই পাবেন। হাইকোর্ট দেখানোর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ সেটা নিশ্চিত করেছেন। ড. কাফির বায়োগ্রাফি ব্লগের কল্যাণে অনেকেই জানেন, ফলে সেটা নিয়ে আলাদা করে মাথা ঘামাচ্ছি না। কিন্তু এটুকু স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার মনে করছি যে কাফি কর্তৃক আক্রান্ত নারী সহকর্মী বিষয়টির সুরাহা করতে উপাচার্য পর্যন্ত ধর্ণা দিয়েছেন এক বছর কাল ধরে। উপাচার্য ড. কাফিকে যে 'বকা' দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হতে পারে, সিন্ডিকেটের হাইকোর্ট প্রদর্শন সেই 'বকা'রই পরিমার্জিত সংস্করণ। হাইকোর্ট আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, অনুমান করা যায় ড. কাফি দেখছেন সবচেয়ে সন্তোষের সঙ্গে।

তবে হাইকোর্ট না-দেখে অধ্যাপক ছানোয়ার যে বিশেষ নাখোশ হয়ে পড়তে পারেন তা মনে হয় না। এমনিতেই ক্যাম্পাসের মানুষজন তাঁর এই বাধ্যতামূলক ছুটিতে ঈর্ষা বোধ করতে শুরু করেছেন। তাছাড়া ক্যাম্পাসের ইতিহাসে পদাবনতি পাওয়া শিক্ষকদের ক্যারিয়ার সাধারণত খুব উজ্জ্বল হয়ে থাকে। সেই নজিরগুলো ইতিহাসের সম্ভাব্য সেই গবেষকের জন্যই বরং তুলে রাখি।

হস্তী দর্শন

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেবার ঠিক তিনদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর খবর শিরোনামে আসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই গোষ্ঠীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে। ৫ই জুলাই। যদি কেউ উৎসাহী হয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে এই মারপিটের কোনো সম্পর্ক খুঁজতে চেষ্টা করেন তাহলে তাঁদেরকে কন্সপিরেসি তাত্ত্বিক বলা যেতেই পারে। কিন্তু কেউ যদি নিতান্ত নিরুৎসাহী হয়েও ছাত্রলীগের বিশেষ ক্যাডার দলের সঙ্গে ড. কাফি বা অন্য কারো ঘনিষ্ট সম্পর্ক আবিষ্কার করে ফেলেন তাহলে সেটাকে কাকতালীয় বলাই নিরাপদ। মানুষে মানুষে ভাল সম্পর্ক থাকার মধ্যে মেহেরবানি করে দোষ খুঁজতে যাবেন না!

শোনা যাচ্ছে ছাত্রলীগের উপর প্রধানমন্ত্রীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে সেটা স্বীকার করা। এবং অবশ্যই তাঁর পারিষদের মধ্য থেকে তাঁদেরকে বিতাড়ন করা যাঁরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন অংশের মোড়ল হয়ে পরিস্থিতিটা সচল রাখছেন। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই কথিত নিয়ন্ত্রণহীনতা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। এটি সম্ভবত বিভিন্ন বিবদমান স্বার্থগোষ্ঠীকে একত্রে তুষ্ট রাখার একটা ছাড়পত্র। এভাবে ভেবে দেখা যায়। বিষয়টি আর তখন ছাত্রলীগ নামক কোনো অখণ্ড দলের নয়। একটা ক্ষমতা-ব্যবস্থাপনার।

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো সংঘর্ষের পরই দুইটা স্পষ্ট জিকির পাবলিক-জবানে শুনতে পাওয়া যায়। এ দফায় খুব জোরেসোরে শোনা গেছে। একটা হলো, সোনালী অতীতের গল্প। আর একটা হলো, ছাত্র[ছাত্রী] রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। কারও প্রতি বিদ্বেষ ছাড়াই, একটা প্রবচন হিসেবেই কেবল, হস্তী দর্শনের ব্যাপারটা মনে এল সে কারণেই। সোনালী অতীতওয়ালারা সকল কিছু ভুলে বলতে থাকেন 'এর থেকে নৃশংস কিছু কোনোকালে ঘটেনি।' কথাটি একদম ডাহা মিথ্যা কথা।

প্রথমত, নৃশংসতার মধ্যে মেধাবিচার করে অধিকতর নৃশংস আর অপেক্ষাকৃত কম নৃশংস রায় দেয়াতে ফায়দা কী! সহিংস রাজনীতি বন্ধ করার কোনো আগ্রহ যদি আমাদের থাকে তাতে কি কোনো উপকার হবে এতে? দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বড় হিংস্রতার ঘটনাটির সময় সেটিকেই সর্বোচ্চ মনে হয়। ৭০-এর দশকে সাত খুনের ঘটনাটিকে কোথায় রাখবেন? এরপর এরশাদের ট্রাক চাপা দেয়া? জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রদলের দুই গ্রুপে হাত-পা (আঙুল) কাটাকাটি হয়েছে, শিবিরের সাথে তো তামাম বাংলাদেশেই নৃশংস মারামারিই হয়ে থাকে। ফলে হঠাৎ সর্বোচ্চ হিংস্রতা দেখার প্রচারণা করা অহেতু কাজ। এটা আসলে 'গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থাকার আনন্দ' উদযাপন মাত্র।

বিপরীতে, শিক্ষার্থী রাজনীতি বন্ধ করে দেবার বাসনা অনেক বিপজ্জনক। এই বাসনাটাকে আমি দেখি মূল সঙ্কটগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবার একটা ভোঁতা প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এমনও হতে পারে সংশ্লিষ্ট আলাপকারীরা আসলে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ব্যবস্থাকে ভাল মতো বুঝতে চান না। উদাহরণ দিয়েই বলা যায়। যেমনটা শোনা যাচ্ছে, যদি আশপাশের জমির দালালি এবং ভবন নির্মাণের সুবিশাল অর্থ এই কুস্তির অন্যতম কারণ হয়, তাহলে একটা সংগঠন আনুষ্ঠানিক বন্ধ করে দিলেই কি স্বার্থগুলো হাওয়া হয়ে যাবে? মন্ত্রী-মিনিস্টার, এলাকার এমপি, কমিশনাররা এতকাল যা লালন করেছেন সেই খাস-পাইক বা বরকন্দাজ খেদিয়ে দেবেন? ছাত্র রাজনীতির অনুপস্থিতি বরং ওই ব্যবস্থাটাকে বিনা প্রতিরোধে পার পেয়ে যেতে দেবে।

পাবলিক-প্রাইভেট জটিলতাটা যাঁরা বিশেষ আলোচনা করতে চান না, তাঁদের অনেক ভরসা ছিল 'ওখানে রাজনীতি হয় না।' ক'দিন আগে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন ব্র্যাক, এনএসইউ, এআইইউবি সমেত অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিলেন যে কর্পোরেটের মুনাফার পাশাপাশি তাঁদের কিছু স্বার্থও রাষ্ট্রের দেখতে হবে। রাজনীতিটা তো আমরা ওখানেই করতে চাই। আমাদের নাগরিক দাবিনামা কিংবা পেশাজীবিতার স্বার্থ নিয়ে। করতেই হবে আমাদের। আমরা তো আর আল বেরুনি হলের ছাদ থেকে কাউকে ফেলে দিয়ে পাশের জমির দালালিটা হাতিয়ে নিতে চাইছি না।

(ভাষানটেক ২৫শে জুলাই এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ০১লা আগস্ট; ঢাকা ২০১০।)