বিচার তো তবু হল

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 15 July 2013, 02:33 PM
Updated : 15 July 2013, 02:33 PM

একাত্তরে কৃত যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দেশীয় সহযোগীদের বিচারকাজ চলছে। আমাদের দেশের জন্য এটি একটি অনন্য ঘটনা। বিয়াল্লিশ বছর ধরে এ বিচারের কাজটি শুরু করা যায়নি এটা যেমন দুঃখের কথা, তেমনি শেষাবধি যে শুরু করা গেছে তার জন্যও আমরা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারি।

বর্তমান মহাজোট সরকার জনগণের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। মহাজোটের পক্ষে বিশাল গণরায় এটা প্রমাণ করেছে যে, জনগণ এ বিচার চায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি ছিল খুবই প্রত্যাশিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দু'কোটি তরুণ ভোটারের সংযুক্তি এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে তাদের প্রদত্ত গণরায় সরকারের জন্য বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার কাজটি সহজ করে দিয়েছে।

বিচার শুরু হয়েছে এবং আমরা দেখেছি এ পর্যন্ত বেশ কজন যুদ্ধাপরাধীর সাজার ঘোষণা হযেছে। এর মধ্যে কাদের মোল্লার মতো কসাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের রায় না হওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ তরুণ সমাজ পথে নেমে এসেছিল। শাহবাগে বিশাল গণজমাযেতের মাধ্যমে এ তরুণরা দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তাদের দাবি ছিল, কাদের মোল্লাসহ সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায দেওয়া। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেই তরুণরা চেয়েছিল যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার।

তরুণদের দাবির সঙ্গে তখন একাত্ম হয়েছিলেন গোটা দেশ। সাধারণ মানুষও নেমে এসেছিলেন পথে। সমর্থন দিয়েছেন তরুণদের দাবির পক্ষে। আমি নিজে বয়সের কারণে ওখানে যেতে পারিনি; কিন্তু বিয়াল্লিশ বছর পরও ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের এ ক্ষোভের সুসংগঠিত প্রকাশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি এ দাবির সঙ্গে একাত্ম ছিলাম।

তরুণদের দাবির প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের কিছু কিছু সমস্যা দূর করে একে আরও কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে কাদের মোল্লার বিচারের প্রক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের যে ত্রুটি ছিল তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। অন্য কটি মামলায় আমরা অপরাধীদের চরম শাস্তির দণ্ড পেয়েছি।

প্রশ্ন উঠেছে, গোলাম আযমের মতো একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বেলায় সর্বোচ্চ শাস্তি কেন পাওয়া গেল না? মামলার রায় দিয়েছেন বিচারকরা। বিচার ব্যবস্থার ওপর আমি সম্পূর্ণ আস্থাশীল। বিচারকের বিচারপ্রদানের বিষয়টি নিয়ে আমার কোনো মতামত নেই। কারণ ট্রাইব্যুনাল একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এর ভিত্তিতে এসেছে রায়।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, সাধারণ মানুষ হয়তো গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন। এটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু আমি বলব, তার যে শাস্তি হয়েছে এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন। গত বিয়াল্লিশ বছরে আমরা তো ওদের শাস্তির মুখোমুখিই করতে পারিনি। আমি বর্তমান মহাজোট সরকারকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাই যে তারা বিচারের কাজটি শুরু করতে পেরেছে এবং এটি এখন শেষ করে নিয়ে এসেছে।

যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে নেতৃত্ব দেওযার অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও বয়সের বিবেচনায় গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে বলে বিচারের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি একজন ঐতিহাসিক হিসেবে বলব, এ ধরনের উদাহরণ নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বেলায়ও নেই।

তবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কিন্তু এখন বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। আন্তর্জাতিকভাবে এটা এখন অগ্রহণযোগ্য। তাই গোলাম আযমকে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দেওয়াটা অবশ্যই লঘু শাস্তি নয়। এটিও চরম শাস্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই সাধারণভাবে গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশিত হলেও আমি বলব, তাকে যে শেষ পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি করে তার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দেওয়া হল এ কারণেই আমি খুশি। আমি এ রায়কে ইতিবাচক দিক থেকেই দেখছি।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবে গোলাম আযমের গুরুদণ্ড হল। কিন্তু তার দল জামায়াতে ইসলামী কিন্তু একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে শুধু অভিযুক্ত নয়. দল হিসেবে এটি আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ওরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে। তাই ওই দলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি করব আমি। দলটিকে এ দেশে এভাবে অবাধে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত নয়।

শেষ বিচারে বলব, চারদিকে এত অন্ধকার দেখছি আমরা। এর মধ্যেই একটু আলোর দিশা পেলাম গোলাম আযমের মামলার রাযের মাধ্যমে। জাতি হিসেবে আমাদের কলঙ্কমোচন হল। যুদ্ধাপরাধীদের সাজা দিচ্ছে মহাজোট সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও হল এ সরকারের সময়। অভিনন্দন প্রাপ্য এ সরকারের।

সালাউদ্দীন আহমদ: জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।