ন্যায়বিচার ও গোলাম আযমের বয়স

ইমরান এইচ সরকার
Published : 14 July 2013, 01:14 PM
Updated : 14 July 2013, 01:14 PM

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এ দিনটির জন্য আমরা অপেক্ষা করেছিলাম। রাজাকারদের শিরোমণি গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামীকাল। ২০১০ সালের ১ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল। ২০১২ সালের ১৩ মে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ, দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনসহ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে গত ১৭ এপ্রিল গোলাম আযমের মামলাটি অপেক্ষমান রাখা হয়। প্রায় ৩ মাস অপেক্ষমান থাকার পর মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হল।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু যথার্থভাবেই বলেছিলেন, ‍‍''গোলাম আযম শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ‌'মাস্টারমাইন্ড' ছিলেন না, তিনি ছিলেন মূল নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী।''

সুতরাং গোলাম আযমের মামলার রায় সামগ্রিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ এর ২০(২) ধারা অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হতে হবে তার কৃত অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী। গোলাম আযম ১৯৭১ সালে যে মাত্রার অপরাধ করেছেন তাতে তার উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড।

গোলাম আযমের মামলার রায় গোষণার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি তার বয়সঘটিত ব্যাপার নিয়ে কিছু কথাবার্তা উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বয়সের কারণে তার সাজা কমে যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যুদ্ধকালীন অপরাধ এমন মাত্রার অপরাধ যার বিচারের ক্ষেত্রে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করতে হয়।

এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, জার্মানির কোর্টে অপরাধীর বয়স ও যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বিতর্ক হয়েছে। সেখানে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, বয়স যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে না। সাবেক নাজি সদস্য হেইনরিখ বোয়েরের (Heinrich Boere) শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির একটি কোর্ট যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে হেইনরিখ বোয়েরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের তিন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার দায়ে আদালত তাকে এ দণ্ড প্রদান করে।

দণ্ড প্রদানের সময় হেইনরিখ বোয়েরের বয়স ছিল ৮৮। তাই এ ডাচ নাগরিকের পক্ষে বার্ধক্যজনিত দণ্ড মওকুফের বিষয়টি তোলা হয়। কিন্তু আদালত যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। উল্লেখ্য যে, জার্মানিতে মৃত্যুদণ্ড নেই (পশ্চিম জার্মানি ১৯৪৯ সালে এবং পূর্ব জার্মানি ১৯৮৭ সালে মুত্যদণ্ড বিলোপ করে), যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই সেখানে সর্বোচ্চ দণ্ড।

সুতরাং এটি বলা যায় যে, আদালত হেইনরিখ বোয়েরেকে সর্বোচ্চ দণ্ডই দিয়েছে। বয়সের কারণে সাজা কমিয়ে দেয়নি। ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিবিসি হেইনরিখ বোয়েরের দণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, হেইনরিখ ৯০ বছর বয়সে কারাদণ্ড ভোগ শুরু করেন।

গোলাম আযমের মামলার রায়ের সঙ্গে হেইনরিখ বোয়েরের মামলার রায় খুবই প্রাসঙ্গিক। যারা বলছে বয়সের কারণে গোলাম আযম লঘু দণ্ড পেতে পারেন তাদের হেইনরিখ বোয়েরের মামলার কথা মনে রাখা উচিত। বাংলাদেশে আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ নয়। এখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পাঁচটি অভিযোগ গঠন করে। এগুলো হল: মানবতাবিরোধী অপরাধ ও এর অনুরূপ আন্তর্জাতিক অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। পাঁচটি অভিযোগে ৬০টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের ছয়টি, পরিকল্পনার তিনটি, উস্কানিদানের ২৮টি, সহযোগিতার ২২টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের ১টি ঘটনা। এসব অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে গোলাম আযমের শাস্তি নির্ধারিত হবে বলে আশা করা যায়।

কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। কিন্তু কিছু কিছু দেশে যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বিধানের ব্যতিক্রম রয়েছে। এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয়, সেসব দেশে যুদ্ধকালীন অপরাধকে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিছু কিছু দেশের প্র্যাকটিস অনুযায়ী, বয়স্ক লোকদের সাজা প্রদানের সময় নানা বিষয় বিবেচনা করা হয়। সেটি সাধারণত অন্যান্য ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। যা জার্মানির কোর্টে হেইনরিখ বোয়েরের মামলার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা জানি কাদের মোল্লার আপিল শুনানিতে ৭ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে অ্যামিকাস কিউরিদের কাছে একটি প্রশ্ন ছিল- ‌'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না।' এখনও পর্যন্ত চারজন মতামত জানিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হকের বক্তব্য- ''১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন (কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল) প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই।''

অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামের বক্তব্য- ''১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের বিরোধ থাকলে প্রথাগত আইন প্রযোজ্য হবে না।''

সুতরাং বলা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের সুযোগ রয়েছে। আইনের ২০(২) ধারার উদ্দেশ্য বিবেচনায় রেখেই গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই।

অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এরপর অনেক বছর চলে গেছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। তাই বলে কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের মাত্রা কমেছে? মনে রাখতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো ধরনের প্রতিহিংসাপ্রসূত অবস্থান থেকে করা হচ্ছে না, এর সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত ন্যায়বিচার জড়িত। একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ ও ৪ লাখ বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগের সঙ্গে সম্পর্কিত এ বিচার।

আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের নেতা গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে।

ডা. ইমরান এইচ সরকার: মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ।