কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে

আলী কবীর
Published : 13 July 2013, 09:35 AM
Updated : 13 July 2013, 09:35 AM
চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন তরুণ সমাজ বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার তরুণ ও ভবিষ্যতে শিক্ষিত বেকারের দুঃসহ জীবন যাপন করতে পারেন এমন তরুণদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই আন্দোলনকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করতে চাচ্ছে– তবু আন্দোলনটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। আন্দোলনটির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হবে আমাদেরকে এর পিছনের কারণ ও প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

প্রথমত, এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলি যে জটিল ও দুর্বোধ্য কোটা-পদ্ধতির বেড়াজালে আবদ্ধ পৃথিবীর কোথাও তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুস্কর। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য চাকরির একটা ন্যূনতম কোটা সংরক্ষিত থাকে। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতেও ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তফসিলি জাতিসমূহের জন্য চাকরিতে কোটা সংরক্ষিত আছে।

উত্তরাধিকারসূত্রে সেই পদ্ধতি প্রথমে পাকিস্তানে ও পরে বাংলাদেশে চলমান থাকে। কিন্তু কোটা-পদ্ধতি শুধু অনুন্নত ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ অবদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো পরিস্থিতির এতটা অবনতি হত না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর সঙ্গে অন্যান্য কোটা যুক্ত হয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে মেধাবীদের চাকরির জন্য নির্বাচিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমরা যদি আমাদের শিক্ষিত তরুণ সমাজের জন্য ব্যাপকভাবে কর্মের সংস্থান করতে পারতাম তাহলে সম্ভবত তারা সকল ধরনের কোটার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠত না। ভারতেও অবস্থা অনেকটা আমাদেরই মতো। বিশাল ওই দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বিশাল। তারাও কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরিতে কোটার পরিসর বৃদ্ধির প্রস্তাবকারী মণ্ডল কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

পূর্বেই বলেছি, শুধু ঐতিহ্যবাহী ন্যূনতম কোটা বজায় রাখলে তরুণ সমাজে এতটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়তো হত না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর সঙ্গে যুক্ত হল জেলা কোটাসহ নানা ধরনের কোটা। আমাদের দেশে একসময় জেলার সংখ্যা ছিল ১৭। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯-য়ে। তখন মহকুমা বা সাব-ডিভিশনের সংখ্যা ছিল ৫৪।

বর্তমানে আমাদের জেলার সংখ্যা ৬৪। অর্থাৎ আগে আমাদের দেশে মহকুমার যে সংখ্যা ছিল এখন জেলার সংখ্যা তার চেয়ে ১০টি বেশি। এই অবস্থায় জেলা কোটা এমনকি বিভাগীয় কোটা বজায় রাখা শুধু দুরূহ, জটিল ও অযৌক্তিকই নয়, এটা এক ধরনের প্রহসন। এই প্রহসনের আড়ালে সরকারি চাকরির জন্য প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়।

অতীতে আমাদের দেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম হলেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। তাদের মধ্যে সরকারি কর্মকমিশন বা Public Service Commission (পিএসসি) ছিল অন্যতম। কিন্তু সেদিন এখন আর নেই। এখন পিএসসিও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খাতায় নাম লিখিয়েছে বলে শোনা যায়। পিএসসিতেও মফস্বলের স্কুল-কলেজের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। পিএসসির উচ্চ পদসমূহে চাকরি-বহির্ভূত নানা বিচিত্র বিবেচনায় কর্মকর্তারা নিয়োগ পান।

আগে যেখানে পিএসসিতে ৫-৬ জন সদস্য থাকতেন সেখানে এখন সদস্য সংখ্যা নাকি ১৫। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ভাগ্নেও আছেন, যিনি কয়েক বছর আগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। বস্তুত পিএসসি এখন চুক্তিভিত্তিক চাকরি-প্রত্যাশী অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটা আখড়া বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই পিএসসির কাছ থেকে জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে?

অবশ্য পিএসসির অবস্থার অবনতির সূচনা হয় আরও আগে যখন পিএসসি-১ ও পিএসসি-২-কে একীভূত করে একক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। এর ফলে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সকল কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে করতে হয়। মজার ব্যাপার হল, পিএসসি এর কোনো প্রতিবাদ করে না, অম্লান বদনে মেনে নেয় এবং সকল কাজই ক্রটিপূর্ণ ও দায়সারা গোছের ভাবে করে থাকে।

এহেন পিএসসি অযৌক্তিকভাবে বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি বা প্রাথমিক টেস্ট পরীক্ষায় কোট-পদ্ধতি প্রয়োগ করে বর্তমান আন্দোলন উস্কে দিয়েছে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তারা যে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাও 'ধরি মাছ না ছুঁই পানির' মতো। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তারা যে বক্তব্য দিচ্ছেন তাও অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী। চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একজন সদস্যের দেওয়া বক্তব্যের মিল নেই। আবার দুজনের বক্তব্যের সঙ্গে উপদেষ্টার কথার মিল নেই।

আমাদের দেশে এখনও সরকারই সবচেয়ে বড় চাকরি-প্রদানকারী বা employer, যদিও ব্যক্তিখাত বা প্রাইভেট সেক্টর চাকরির বাজারে ইতোমধ্যে বেশ খানিকটা সুযোগ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। শিক্ষিত তরুণ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা প্রধানত সরকারি চাকরি তথা বিসিএস পরীক্ষার জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকেন। কোটা-পদ্ধতির নামে তাদের এবার শুরুতেই বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এটা যুগপৎ ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। একটা কথা আমাদের সবার মনে রাখা দরকার। হতাশা থেকে যে ক্ষোভের জন্ম হয়, হতাশার কারণগুলি দূর না করে সে ক্ষোভ প্রশমিত করা সম্ভব নয়।

সরকার বা কর্তৃপক্ষ অবশ্যই খুঁজে দেখবেন এই আন্দোলনে ভাড়াটিয়া উস্কানিদাতারা সুযোগ নিচ্ছে কি না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা যেন আন্দোলনের কারণ ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে ব্যর্থ না হন। এই আন্দোলনের একটা বার্তা বা মেসেজ রয়েছে। সেটা তাদের অনুধাবন করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা ও অনুন্নত শ্রেণির কোটা ছাড়া ভৌগোলিক/আঞ্চলিক সকল কোটা বাতিল করে দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদের জন্য ও অনুন্নত শ্রেণির জন্য কোটা খুবই সাবধানতার সঙ্গে ও যৌক্তিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই চূড়ান্ত পরীক্ষা ছাড়া অন্যকোনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোটা আরোপ করা যাবে না। পিএসসির কাজের বোঝা কমিয়ে ফেলতে হবে। চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরগ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে বয়সসীমা বৃদ্ধি করতে হবে।

যারা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদেরও বুঝতে হবে, জনসংখ্যার অনুন্নত ও দুর্বল অংশের প্রতি সব দেশেই রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব থাকে। এটা আমাদের সকলের জন্যই প্রয়োজন। দেশ আরও উন্নত, আরও সমৃদ্ধ ও আরও স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।

আমার মনে হয় সরকার তথা সরকারি কর্মকমিশন কিছু কোটা বিলুপ্ত ও কিছু কোটার হার কমিয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। বিসিএস ব্যতীত অন্যান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আগামী অন্তত এক দশক নিম্নরূপ কোটা বহাল রাখার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধা-পোষ্য কোটা : ১০%

অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণি কোটা : ১০%

নারী কোটা : ১০%

বিসিএস পরীক্ষা দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এটি সম্পূর্ণরূপে মেধাভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। সরকার নিয়োজিত একটি কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৮৭-১৯৯৭ সাল, এ দশ বছরের মধ্যে বিসিএস-এ কোটা-পদ্ধতি উঠে যাওয়ার কথা (ইতোমধ্যে দীর্ঘ ১৬টি বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু কোটা-প্রথা এখনও বহাল রয়েছে।

তাই বিসিএস পরীক্ষায় কোটা-পদ্ধতি বাতিল করার প্রশ্ন বিবেচনায় এখনই সময়। আর যদি একান্তই বহাল রাখতে হয় তা হলে উপরে বর্ণিত হারে ২০২১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার স্বর্ণজয়ন্তী বছর পর্যন্ত তা বহাল রাখা যেতে পারে।

তবে সর্বাগ্রে সদ্যগৃহীত বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। আর দুটি বিষয়েই সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা আশু প্রয়োজন।

আলী কবীর : সাবেক সংস্থাপন সচিব, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক।