দারিদ্র্য কমাবে বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধির কৌশল

মইনুল ইসলাম
Published : 6 July 2013, 09:42 AM
Updated : 6 July 2013, 09:42 AM

১৪ জুন, ২০১৩ তারিখে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত দেশের জনগণের দারিদ্র্যহ্রাসের প্রশংসনীয় সাফল্য সম্পর্কিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের খবরটি পরদিন অনুষ্ঠিত চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের ভরাডুবির খবরের ডামাডোলে প্রায় হারিয়ে গেছে। অথচ ওই সাফল্যের স্বীকৃতি সারা দুনিয়ার কাছে অনেক বেশি 'চমকপ্রদ' হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নের অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে তদানীন্তন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ড. হেনরি কিসিঞ্জার নব্যস্বাধীন দেশটিকে 'আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি' অভিহিত করার পর থেকে বিশ্বের 'সর্বাধিক জনসংখ্যার ঘনত্বের' ভারে জর্জরিত স্বল্পোন্নত দেশ (Least developed country, LDC) বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যহ্রাসের সংগ্রামে জাতিসংঘ ঘোষিত আটটি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ((Millennium development goals, MDGs)-এর সবচে' গুরুত্ববহ প্রথম লক্ষ্যটিই নির্ধারিত সময়সীমা ২০১৫ সালের দু'বছর আগেভাগেই অর্জন করে ফেলেছে– এ খবর উন্নয়নচিন্তকদের কাছে সত্যিকার প্রশংসার দাবিদার মনে হবে নিঃসন্দেহে।

পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০০০ সালের বার্ষিক অধিবেশনে ওই আটটি এমডিজি গৃহীত হয়েছিল, যার প্রথমটিতে ১৯৯০ সালের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ জনসংখ্যাকে ২০১৫ সালে ২৯ শতাংশে হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল বাংলাদেশের জন্যে। একেক দেশের জন্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার একেক রকম শতাংশকে অর্ধেকে নামানোর এই ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে থাকা বিশ্বের মাত্র ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

তাই FAO ওই ২০টি দেশকে এ সাফল্যের ডিপ্লোমা প্রদানের জন্যে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ১৭ জুন, ২০১৩ তারিখে ডিপ্লোমাটি গ্রহণ করেছেন। ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ যেহেতু ২৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে, তাই ২০১৫ সালে এদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা ২৫ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা যায়। তার মানে দাঁড়াবে, ২০১৫ সালে এদেশের মোট দরিদ্র জনসংখ্যা গত ৪২ বছরে প্রথমবারের মতো চার কোটির নিচে নেমে যাবে।

অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি দারিদ্র্য-সমস্যাকে সমাজব্যবস্থার বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন ব্যবস্থা (উৎপাদন সম্পর্কসমূহ) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। তাই এ সম্পর্কে আমার দৃঢ় অবস্থান হল, আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক 'সিস্টেম' প্রতিনিয়ত সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে।

দারিদ্র্য বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা এবং তাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত আমার বই 'The Poverty Discourse and Participatory Action Research in Bangladesh দেশের খ্যাতিমান গবেষণা সংস্থা রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ (রিব বা RIB) কর্তৃক ২০০৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে বহুল-আলোচিত। মোট বারোটি প্রধান ডাইমেনশনে বা প্রক্রিয়ায় এদেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি হচ্ছে বলে আমার গবেষণায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের সীমিত পরিসরে এই প্রক্রিয়াগুলোর ব্যাখ্যা প্রদানের অবকাশ নেই। তাই প্রধান কয়েকটি প্রক্রিয়া ও ক্ষেত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করছি। এদেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই কৃষিখাত। কৃষিখাতের নিচের প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে তা প্রধানত ক্রিয়াশীল :

১. ভূমি-মালিকানার খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রের আয়তন হ্রাস;

২. ভূমিহীনতার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব;

৩. ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের নিঃস্বায়ন ও প্রান্তিকীকরণ প্রক্রিয়া;

৪. অনুপস্থিত ভূস্বামীদের হাতে ভূমি-মালিকানার পুঞ্জভবন এবং এর ফলে ভূমিস্বত্ত্ব ব্যবস্থায় বর্গাদারির ক্রমবর্ধমান বিস্তার;

৫. কৃষিজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণে দালাল, ফড়িয়া, মহাজন, পাইকারদের মতো মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা;

৬. কৃষকের ঋণগ্রস্ততা ও মহাজনী ব্যবস্থার অব্যাহত দৌরাত্ম্য;

৭. বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, কালবৈশাখীর ফলে কৃষকের ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, গৃহস্থালি দ্রব্যাদির এবং কৃষিউৎপাদনের বিপর্যয়;

৮. কৃষি উপকরণের বাজারিকরণ বৃদ্ধির কারণে কৃষিকাজ না পেরোনোর সমস্যা।

যথোপযুক্ত কৃষিসংস্কার ও ভূমিসংস্কার নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা রাজ্যের মতো এদেশেও কৃষিখাতে দারিদ্র্যসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলো মোকাবেলা করা সময়ের দাবি হলেও রাজনৈতিক কারণে এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে এদেশের সরকারগুলো পিছুটান অব্যাহত রেখেছে বলা চলে।

এতদসত্ত্বেও বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষকবান্ধব বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে সাম্প্রতিককালে দেশের কৃষিখাতে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছি আমরা। তরিতরকারি ও মাছ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। খাদ্যশস্যের বাজারদাম মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের খাদ্য-নিরাপত্তা অর্জনে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্যহ্রাস প্রক্রিয়া তরান্বিত হওয়ার মাধ্যমে। এমনকি শহরাঞ্চলের শ্রমজীবী বিত্তহীন জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য নিরসনেও গতি সঞ্চার হয়েছে এই ক্রমবর্ধমান খাদ্যশস্য নিরাপত্তার কারণে।

দারিদ্র্যহ্রাস প্রক্রিয়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ এখন বিদেশে অভিবাসন করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এসব প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৯০-৯৫ শতাংশই স্বল্পশিক্ষিত, কম-দক্ষ গ্রামীণ তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা বিদেশে নিম্ন মুজরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কিন্তু স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা, ভাইবোন-আত্মীয়-স্বজনদের প্রয়োজন মিটানোর তাগিদে এবং পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের নিম্ন-আয়ের একটা বড়সড় অনুপাত তারা নিয়মিতভাবে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নানান চ্যানেলে।

গত অর্থ-বছরে বৈধ চ্যানেলসমূহের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ ১৪.২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এ বছর সেটা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। এর বাইরে হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় আসা এবং দেশে আসা প্রবাসীদের সরাসরি বহন করা মালামাল ও বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহের পরিমাণ আরও ৬ বিলিয়ন থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

অতএব, বৈধ-অবৈধ পথে প্রতি বছর অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স যোগ হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা এদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পালে জোর হাওয়া লাগিয়ে চলেছে। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি প্রতি বছর বিদেশে পাচার না করলে এবং অর্থনীতিতে দুর্নীতি ও পুঁজিলুণ্ঠনের প্রকোপ কিছুটা কমাতে পারলে দেশের জিডিপি এবং জিএনআই-এর প্রবৃদ্ধির হার ইতোমধ্যেই ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। (জিএনআই হল জিডিপি এবং নিট রেমিট্যান্সের যোগফল। নিট রেমিট্যান্স হল বিদেশ থেকে দেশে আসা রেমিট্যান্স এবং দেশ থেকে বিদেশে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পার্থক্য।) দেশের জনগণের দারিদ্র্যহার হ্রাসের গতি তরান্বিত হওয়ার পিছনে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কৃষিখাতের সাফল্যের প্রায় সমপর্যায়ের অবদান রাখছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এর কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে গার্মেন্টস ও নিটওয়ার শিল্পখাতের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশের মোট পণ্য ও রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই অর্জিত হচ্ছে এই খাত থেকে। আবার, এই খাতের জন্যে আমদানিকৃত মেশিনারি, ম্যাটেরিয়ালস এবং এক্সেসরিজ আমদানি ব্যয় প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। তাই এ খাত থেকে বাংলাদেশের নিট রপ্তানি প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়।

সে হিসেবে জনশক্তি রপ্তানি খাতই দেশের প্রধান রপ্তানি-আয়ের সূত্র। তা সত্ত্বেও তৈরি পোশাক শিল্প প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে জনগণের দারিদ্র্যহ্রাস প্রক্রিয়ায় বিশাল অবদান রেখে চলেছে। বিশেষত উল্লেখযোগ্য যে, জনগণের মধ্যে সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর নারীসমাজকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এই খাতটি দেশে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছে বলা চলে।

প্রফেসর ইউনূসের যুগান্তকারী উদ্ভাবন 'ক্ষুদ্রঋণ' এদেশের গ্রামীণ নারীসমাজের দারিদ্র্য নিরসনকে তরান্বিতকরণের আরেকটি চলমান বিপ্লবের অনুঘটকের ভুমিকা পালন করে চলেছে। এদেশের কয়েক হাজার এনজিও'র বেশিরভাগই সাম্প্রতিক দুই দশক ধরে গ্রামীণ নিম্নবিত্ত জনগণের কাছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই প্রধানত পালন করে চলেছে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় বেশি এবং এ জন্যে ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকদের কাছে এটা একটা বহুল-ব্যবহৃত সমালোচনার অস্ত্র।

কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারকে তুলনা করা উচিত মজাজনী সুদের হারের সঙ্গে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সূদের হারের সঙ্গে নয়– একথাটা ওইসব মতলববাজ সমালোকদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র দূর করা যাবে না, এটা আমারও কথা। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে সেটা অস্বীকার করার তো কোনো কারণ দেখছি না। কাউকে খুশি করার জন্যে যারা প্রফেসর ইউনূসকে 'সুদখোর' ডাকার কোরাসে যোগ দিয়ে নিজেদেরকে বিশ্বের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে সেসব চাটুকারদের জন্যে রইল ধিক্কার!!

ক্ষুদ্রঋণের নানারকম ক্রটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, সে সব ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা ভোগে অপচয় করে না তাদের প্রায় ২৮-৩০ শতাংশ উপার্জনশীল বিনিয়োগে ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে নিজেদের পরিবারকে টেনে তুলতে সমর্থ হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রঋণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা স্রেফ মতলববাজি।

দেশের জনগণের একেবারে হতদরিদ্র অংশের জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রামে সহায়তা করার জন্যে এদেশের সরকারি ব্যয়ের একটা অংশ সামাজিক নিরাপত্তা জাল (Social safety net) কর্মসূচিগুলোর জন্যে বরাদ্দ করা হয়। এ ধরনের কর্মসূচির সংখ্যা প্রায় নব্বইয়ের মতো। সহায়তাপ্রাপ্ত জনগণের সংখ্যাও প্রায় আড়াই কোটি বলে সরকার দাবি করছে। এ কর্মসূচিগুলোর বেশিরভাগই দরিদ্র জনগণের জীবন কিছুটা সহনীয় করায় সামান্য অবদান রাখছে। এর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি উৎপাদনশীল ও আয়বর্ধনকারী কার্যক্রমকে উৎপাদিতও করে চলেছে, যা দারিদ্র্য মোকাবেলায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এতদসত্ত্বেও বলা প্রয়োজন, সামাজিক নিরাপত্তা জাল কর্মসূচিকে মূল্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে আরও কার্যকর করাটা সময়ের দাবি। দারিদ্র্য নিরসনে অর্জিত এদেশের জনগণের সাফল্যের পেছনে সে সব বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমান গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই প্রধান প্রধান দারিদ্র্য-সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো।

দারিদ্র্যের যমজ ভাই বলা হয় আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে। যে সমাজে বৈষম্য বাড়ানোর আয়োজনগুলো শক্তিশালী করা হয় ওই সমাজে দারিদ্র্য নিরসন কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় মাথাপিছু জিডিপি ৪৮,০০০ ডলার হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কারণে ১৭ শতাংশ মার্কিন জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ২০০৭ সালে এই অনুপাত ছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু চলমান মন্দা এবং আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বৃদ্ধির শিকার হয়ে গত ছয় বছরে আরও ছয় শতাংশ মার্কিন নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

শুধুমাত্র আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্যের কারণেই লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী দেশ ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, চিলি, নিকারাগুয়া ও ইকুয়েডরের জনগণের বিশাল অংশ কিছুদিন আগেও দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে ছিল। ওইসব দেশের নির্বাচিত বামপন্থী সরকারগুলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে 'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' অর্জনের কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যহ্রাস প্রক্রিয়াকে গত এক দশকে নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছেন।

ভেনিজুয়েলার হুগো চাভেজ, ব্রাজিলের লুলা ডি সিলভা, নিকারাগুয়ার ওরটেগা, বলিভিয়ার মোরালেস– এসব নাম এখন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল রাষ্ট্রনায়কদের একগুচ্ছ প্রাতঃস্মরণীয় নাম। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশের জনগণের দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলো দুর্বল করে দিয়ে দেশের সম্পদকে দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছেন। ওই প্রক্রিয়াগুলো এদেশেও বৈষম্য এবং দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। তালিকাটা দেখুন :

১. শিক্ষাখাতে বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার লালন,

২. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাজারিকরণ ও বৈষম্যমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তার;

৩. ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধনাঢ্য গোষ্ঠীর একচেটিয়া দখলে রাখা,

৪. সরকারি রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থার গণবিরোধী চারিত্র্য বহাল রাখা;

৫. রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির তাণ্ডব; ও

৬. বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য নিয়ে দুর্নীতির মোচ্ছব।

সে জন্যেই বলছি, এদেশের জন্যেও 'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' কৌশল গ্রহণ দারিদ্র্য নিরসন ত্বরান্বিত করার জন্যে আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' কৌশলটি বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর বা 'দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি' কৌশলের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল দর্শন ধারণ করে চলেছে।

'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' কৌশলের মূল দর্শন হল : সমাজের আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থামিয়ে দিয়ে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নীতিমালার মাধ্যমে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনকে সক্রিয় অগ্রাধিকার দিলে বৈষম্য ক্রমেই কমে আসবে এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও তাতে বেগবান হবে।

অতএব, দারিদ্র্যকে টার্গেট না করে সরাসরি বৈষম্যকে কমিয়ে আনাকে টার্গেট করতে হবে, আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনের কৌশল ও নীতিমালার মাধ্যমে।

মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, চিলি, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশ একইসঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন এবং আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের পরিমাপক গিনি সহগ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার মাধ্যমে ওইসব দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী দরিদ্র জনসংখ্যার অনুপাত দ্রুত কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে।

এসব দেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে চলেছে, আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য সক্রিয় নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমাতে চাইলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে যে ধারণা নয়া ক্লাসিক্যাল তাত্ত্বিকরা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে প্রচার করে চলেছেন, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ভিত্তিহীন 'মতাদর্শিক প্রোপাগাণ্ডা'। পুঁজিবাদের সমর্থনেই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এই তাত্ত্বিক অবস্থানটি সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেৎস তাঁর বিখ্যাত 'কুজনেৎস কার্ভ' তত্ত্বের মাধ্যমে এই ধারণাটিকে উন্নয়ন-অর্থনীতির মূল ফোকাসে নিয়ে এসেছিলেন। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য ছিল, প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পারলে বৈষম্য প্রাথমিকভাবে বাড়বে, কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল চুঁইয়ে চুঁইয়ে সমাজের দরিদ্র জনগণের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ওভাবে মাথাপিছু গড় আয় বেড়ে একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর আর বৈষম্য বাড়বে না, এটাই উন্নত শিল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। অতএব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে মাতামাতি না করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর দিকেই নজর দেওয়া শ্রেয়।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকেই ওই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করেছিল এবং বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্যবৃদ্ধির প্রকোপ বিশ্বের প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশকে সমস্যাভারাক্রান্ত করে ফেলেছিল। দারিদ্র্য-সম্পর্কিত 'মৌল প্রয়োজনসমূহ মেটানোর' কৌশল সত্তর দশকে অগ্রাধিকার পেতে থাকে দারিদ্র্য সমস্যাকে মোকাবেলার জন্যেই। কিন্তু আশির দশকে 'মুক্তবাজার অর্থনীতি' এবং বিশ্বায়নের দর্শন যখন পুঁজিবাদের নতুন আগ্রাসনকে সারাবিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালাতে শুরু করে, তখন আবারও বৈষম্যের ইস্যুটিকে সযতনে উন্নয়ন-চিন্তা থেকে বাদ দেওয়ার প্রয়াস জোরদার হয়।

এতদসত্ত্বেও, গত দুই দশকে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন তাত্ত্বিক বিতর্ক এবং বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন-অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের ধারা 'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' কৌশলকে পুনরায় উন্নয়ন বিতর্কের মূল মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈষম্য নিরসনের সাফল্য প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রবৃদ্ধির মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই; অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলেই বরং দারিদ্র্য মোকাবেলা করা কঠিন প্রমাণিত হয়।

এদেশের বিশ্বখ্যাত তিনজন অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন চিন্তাবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন, প্রফেসর আনিসুর রহমান এবং প্রফেসর ইউনূস এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে বলছেন, দারিদ্র্য নিরসনের চাবিকাঠি ধারণ করছে বৈষম্য নিরসনে। প্রফেসর আনিসুর রহমান সমাজের অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক 'সিস্টেম' কর্তৃক দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি প্রক্রিয়াকে একটি চলন্ত নিম্নগামী এসকেলেটরের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন- ওই নিম্নগামী এসকেলেটরের সুইচ বন্ধ না করে একতলা থেকে দোতলায় উল্টোদিক থেকে উঠতে গেলে তা যেমন কঠিন হবে, তেমনি 'সিস্টেম' না বদলিয়ে, বৈষম্য নিরসনে ব্যবস্থা না নিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

তাই 'বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি' অর্জনের জন্যে শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য নিরসন, গুণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদারকরণ, ব্যাংকিংকে সাধারণ জনগণের সেবায় ফেরানো, সরকারি কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল করা, সরকারি ব্যয়কে গণমুখী ও উৎপাদনমুখী করা এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেই হবে।

ড. মইনুল ইসলাম : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।