গতিশীল অর্থনীতি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
Published : 2 July 2013, 08:20 AM
Updated : 2 July 2013, 08:20 AM

২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পাশ হল ৩০ জুন। আলোচিত-সমালোচিত এ বাজেটের বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। নানা জন নানাভাবে এর বিশ্লেষণ করছেন। মহাজোট সরকারের বর্তমান মেয়াদের সর্বশেষ বাজেট এটি। আমি কিন্তু মনে করি, এবারের বাজেট অত্যন্ত দৃঢ় সামষ্টিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।

এ কথা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত চার বছরে আমরা ৬ শতাংশের ওপর হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। রপ্তানিপ্রবৃদ্ধি ৩ বছরের টার্গেট পূরণ করেছে। মূল্যস্ফীতি ১০.৭ হয়ে গিয়েছিল একসময়। এখন এটা রয়েছে ৭.৫। তার মানে আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে। রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলার আছে, যে হারের দিক থেকে আমরা পৃথিবীতে ষষ্ঠতম অবস্থানে রয়েছি। ওদিকে রিজার্ভ রয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের।

সব মিলিয়ে অর্থনীতির যে স্থিতি তা খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। পৃথিবীবিখ্যাত মান নির্ণয়কারী সংস্থা এসএমপি এর মূল্যায়ন করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের মান ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সের সমান। এটা অত্যন্ত ভালো একটা দিক।

প্রবৃদ্ধির হারের ব্যাপারে চার ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে বলেছেন ৬, এমনিতে বলেছেন ৬.৩। বিবিএস বলেছে ৬.০৩। আর আইএমএফ বলেছে ৫.৪। আইএমএফ সবসময়ই রক্ষণশীল। তবে এবার কেন যেন অতিমাত্রায় রক্ষণশীল।

কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও সবসময় বলছে, রপ্তানি কমে যাচ্ছে। রেমিটেন্স আসবে না। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। এগুলো তারা বলতেই পারেন। এসব তাদের মত। তবে আমি কিছু ফ্যাক্টস তুলে ধরে কথা বলতে চাই।

এখন অনেকে বলছেন যে এটা উচ্চাভিলাষী বাজেট। আমি যদি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি- বড় হতে হলে বড় কিছু আকাঙ্খা থাকতে হয়। এবারের বাজেটের সাইজ কত? ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এটা বর্তমান জিডিপির শতকরা ১৮ ভাগ। তত্ত্ব, তথ্য ও সূত্র বলছে– যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি দেশের জাতীয় বাজেট জিডিপির শতকরা ২০ ভাগ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি পরিমিত আকারের। তার মানে বাজেট এখনও ছোটই আছে। বরং বাজেটের আকার আরও বড় করার সুযোগ রয়েছে। দেশটা অনেক বড় হয়েছে। জিডিপি বেড়েছে। প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। এখন দেশে অনেক কর্মসংস্থান দরকার। তাছাড়া মহাজোট সরকারের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলেও কিছু কিছু বাদ রয়ে গেছে। সেগুলো পূরণ করতে গেলে বাজেট বড় করতে হবে।

তবে একটা বিষয় সবাই বলছেন, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে– সেটা আসলেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের যে ঘাটতি ছিল তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের টার্গেটও পূরণ হওয়া অসম্ভব নয়। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা– সেটিও পূরণ হবে।

আরেকটি সুখবর হল, গত সাড়ে ৪ বছরে ১৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে। ৩ কোটি টন থেকে হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। এর জন্য ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। একমাত্র যেটি নেতিবাচক দিক তা হল শতকরা ৫.৬ ভাগ হারে আমদানি কমেছে। একটা বিষয় অনেকেই জানেন না, আমদানি কমলে জাতীয় আয় বাড়ে। জাতীয় আয়ের ইকুয়েশন হল—
সি বা কনজাম্পশন এক্সপেনডিচার (ভোগব্যয়) + আই বা ইনভেস্টমেন্ট এক্সপেনডিচার (বিনিয়োগ ব্যয়)+ এক্স বা এক্সপোর্ট রেভিনিউ (রপ্তানি রাজস্ব)– এম বা ইমপোর্ট এক্সপেনডিচার (আমদানি আয়)। কাজেই জাতীয় আয় বাড়লে আমদানি কমে।

তবে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেলে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশে হয়নি কারণ প্রবৃদ্ধি গ্রামে চলে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি বিশাল অংশ পল্লীবাংলায় হচ্ছে। কৃষিখাতের যে উৎপাদ তাকে উপাদান ধরে অগ্রগতি হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ শতকরা ৩০ ভাগ। এগুলোর অর্থনৈতিক তাৎপর্য অনেক। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ালে বাজেটকে তো বড় করতেই হবে।

আমদানি বাড়ানোর জন্য বর্তমান বাজেটে সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও অবশ্য রয়েছে। যেমন মৎস্য, পোল্ট্রি ও জাহাজনির্মাণ শিল্প থেকে শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সব খাতের উন্নয়ন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এগুলোর উন্নয়ন হলে আমদানি বাড়বে।

তাই যদি হয় তাহলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। এটা সুখবর, কারণ আমাদের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই এখন কর্মসংস্থান। এটা বাড়লে আয়-রোজগার বাড়বে। দারিদ্র নিরসন হবে। আওয়ামী লীগ সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। দুস্থ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিধবা ভাতা দেওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের আগের আমল, অর্থাৎ ১৯৯৬-২০০১ সাল থেকেই। এবার এ খাতে বরাদ্দ আরও বেড়েছে। সেটা ঠিক আছে । কিন্তু সে সঙ্গে পল্লী অঞ্চলেও ইনকাম জেনারেটিং করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয় আমি উল্লেখ করতে চাই। জাতিসংঘের হিসেবে প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সে হিসেবে আমাদের দেশের দেড় কোটি মানুষ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক। তাদের একটি পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান সরকারের হাতে থাকা দরকার। প্রত্যেকের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকবে সেখানে। কার কী ধরনের সমস্যা সেটা জানা যাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, তারা একটি সার্ভের মাধ্যমে তথ্যগুলো নেবেন।

কিন্তু আমি মনে করি, মন্ত্রণালয় যে পথে হাঁটছে তা ভুল। ওভাবে সার্ভে না করে প্রত্যেককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হলে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা যাবে। এ জন্য আমার পরামর্শ হল প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করতে হবে। ওদিকে সরকারের আরেকটি পরিকল্পনা ছিল প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনকে সরকারি দপ্তরে পরিণত করা। কিন্তু এদেশে ও বিদেশে আগে যারা সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার পক্ষে ছিলেন তারাই এখন এর বিরুদ্ধে বলছেন। আমার পরামর্শ হল, একে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এর দেখভাল করতে পারেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আর সেমিনার শুনতে চাই না। এভাবে দেড় কোটি মানুষকে উন্নয়নের মূলস্রোতে আনা যাবে।

আমার আরেকটি সাজেশন হল, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে সমাজ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় করা। সমাজ কল্যাণ বললে কেমন যেন চ্যারিটির কথা মনে হয়। কিন্তু যিনি প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক– এ দেশ ও সমাজের সব ক্ষেত্রেই সমান সুযোগ ও বিকশিত হওয়ার পরিবেশ পাওয়ার পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে।

বাজেটের জন্য রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি নিয়ে বলব, রাজস্ব আদায় কঠিন হবে কিন্তু এটি অসম্ভব নয়। সরকার ইতোমধ্যেই রাজস্ব খাতে জনবল বৃদ্ধি ও এর কর্মপরিবেশ উন্নত করেছেন। পাশাপাশি দু-তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে।

প্রথমত, অল্টারনেট ডিসপিউট রেজুলেশন (এডিআর) বা যেসব ক্ষেত্রে কর-বিষয়ক দ্বিমত রয়েছে বা মামলা হয়েছে, সেগুলোকে আদালতের বাইরে ফয়সালা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগ কিছু ছাড় দিবে, তাতে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের করের বোঝা কমে যাবে। এভাবে সমঝোতার কাজটি করতে দিচ্ছে না রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্মকর্তা। সমঝোতা হয়ে গেলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে। কিন্তু এভাবে ফয়সালা করতে পারলে রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা আসবে।

আমার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করা সংক্রান্ত। এগুলোর মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। যেমন, রেফ্রিজারেটরের নামে পঁচাত্তরটি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করা হয়েছে, এগুলোর অকশন হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক হচ্ছে কিনা বা কারা এর সঙ্গে জড়িত সে সব খুঁজে দেখতে হবে। যে আমদানিকারকরা এ ধরনের কাজ করছে তারাও তো অপরাধী। এদের সবার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দরকার।

সবশেষে বলব, যেহেতু আমাদের অর্থনীতি জোরদার হচ্ছে তাই রাজস্ব আদায় বাড়বে। আমাদের রাজস্ব বিভাগকে আরও গতিশীল ও দক্ষ করে তুলতে হবে।

বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে অনেকে দাবি করছেন। যারা বলছেন তারা কিন্তু হিসেব মেলাতে পারছেন না। বিনিয়োগ কমে যায়নি, স্থবির ছিল। বিগত ৩ বছরে এটা ছিল জিডিপির ২৪ ভাগ। এবার বেড়ে হয়েছে ২৫ ভাগ। বর্তমান অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে শতকরা সাতাশ ভাগ। হয়তো এটা একটু উচ্চাকাঙ্খী টার্গেট। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জিডিপির আকার কিন্তু গত ৩ বছরে বেড়েছে বছরে ৬ শতাংশ হারে; তাতে ৪ বছরে বেড়েছে ২৪ শতাংশ। মানে ১২৪ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু এটা কম্পাউডেড হয়েছে ১৪০ শতাংশ। তার মানে অ্যাবসলিউট বিনিয়োগ কিন্তু বেড়েছে।

এখন অর্থমন্ত্রী বলছেন আগামীতে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। আমি মনে করি ২৬ শতাংশ হবে। তবে অ্যাবসলিউট অ্যামাউন্ট কিন্তু বড়। বিনিয়োগের আশি শতাংশ বেসরকারি ও ২০ শতাংশ সরকারি খাতে। সে হিসেবে ২৫ এর মধ্যে ২০ হচ্ছে বেসরকারি খাতের যা ১ শতাংশ কমে ১৯ হয়েছে। কিন্তু সরকারি খাতে তা ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ হয়েছে। যে ঋণটা পড়ে আছে সেটি সরকার নিয়ে সুদ দিয়ে গেলে আমি দোষের কিছু দেখি না।

সরকার এবার কৃষিতে ভর্তুকি দিয়েছে বলে অনেকে নানাভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিন্তু বিনিয়োগ বনাম ভর্তুকি একটা বিতর্ক রয়েই গেছে। কৃষিতে ৪ বছর ভর্তুকি দেওয়া হল, এতে কিষান-কিষানীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন বিনিয়োগ করলে তার উৎপাদন খরচ যাতে কমানো যায় অথবা আমরা যাতে তাকে মূল্য-সমর্থন দিতে পারি, সেটা দেখা দরকার। উপাদানে ভর্তুকি বনাম মূল্য-সমর্থন একটি বড় বিতর্ক। উপাদানে ভর্তুকির দরকার আছে। কিন্তু এখানে একটি বড় সমস্যা রয়েছে; ভর্তুকির ফলে বীজ ও ডিজেলের দাম কমে গেলে এটি পাচার হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু মূল্য-সমর্থনে তা নেই। ধানের মণ উৎপাদন করতে কিষান–কিষানীর যদি পাঁচশ টাকা খরচ হয়ে থাকে, আর আমরা যদি তাদের ছয়শ টাকা দিই তাহলে সেটাই হবে মূল্য-সমর্থন।

কিন্তু এখানে হিসেবের একটি গরমিল রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ধান উৎপাদন করে কৃষকের পড়তায় পড়ছে না। কৃষকের নিজের যে খোরাকি, সেটি বাদ দিয়ে যদি উৎপাদনের হিসেব করা হয় তাহলে বলব, পড়তায় পোষাচ্ছে। এখন কথা হল, আমরা যে মূল্য-সমর্থন দেব সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে, কৃষকদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তারা যাতে মিল মালিকদের পক্ষে কাজ না করে কৃষকের পক্ষে কাজ করেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আর সমস্যা থাকবে না।

অনেকে বলছেন, দেশে আগামী দিনগুলোতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলবে এর ফলে এ বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব হযে পড়বে। তাদের বক্তব্য, এ বাজেট বাস্তবায়ন করবে তিনটি সরকার। বর্তমান মহাজোট সরকার, মাঝের স্বল্পকালীন তত্বাবধায়ক সরকার ও আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার। আমি মনে করি, মাঝের স্বল্পকালীন বা তত্বাবধায়ক সরকারের সময় কাজে গতিশীলতা আসে। কাজেই সেটা সমস্যা নয়। অন্য দুটি সরকারের বেলায় বলব, বর্তমান সরকারের যেহেতু এটি শেষ বাজেট, তাই তারা চেষ্টা করবে সর্বশ্রেষ্ঠভাবে এটি বাস্তবায়ন করে জনগণের কাছে যেতে। দ্বিতীয়ত, আগামী সরকারও চাইবে এটা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে। ফলে এ বাজেটের বাস্তবায়ন অন্তঃবর্তী সময়ে হচ্ছে বলে সমস্যা হবে সেটা মনে করি না।

তবে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি অস্থিরতা তৈরি করতে চায়, লাগাতার হরতাল-বিক্ষোভ করে যদি তারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় তাহলে সমস্যা হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হল, তারা কি তা জেনে-বুঝেই করছেন? আর যারা বলছেন যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে তার কীভাবে সেটা জানলেন?

আমি সচরাচর রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু একটি বিষয়ে বলব। আমাদের রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে যারা বাধা দিযেছে, গণহত্যা ও ধ্বংসের মাধ্যমে আমাদের জাতিগত পরিচয়ের যুদ্ধকে শেষ করে দিতে চেয়েছে— সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া খুবই জরুরি। সেটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

তবে আমি মনে করি, দেশের বড় দুটি দলই কিন্তু এখন নির্বাচনমুখী। তাই এখন যে সংঘাত দেখা যাচ্ছে হুট করে সেটা বন্ধ হয়ে তাদের মধ্যে সমঝোতা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে।

আরও দুটি বিষয়ে আমি একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি যে দুটি জিনিস তার একটি হল অবকাঠামো। আরেকটি হল বিদ্যুৎ জ্বালানি। গত সাড়ে চার বছরে সরকার ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে বলে দাবি করেছে। এতে অতিরঞ্জন থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জন্যই লোডসেডিং কম হয়েছে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে খরচের ব্যাপারটি নিয়ে আমি বলব, কুইক রেন্টাল ইত্যাদির ফলে খরচ অনেক বেড়েছে। এটা কমানো যেত। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিক রাখার জন্য এটা জরুরি ছিল।

তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে যে কথাটি বলতে চাই তা হল, মধ্যমেয়াদী যেসব প্রকল্প রয়েছে বা পুরনো প্রকল্পগুলো রয়েছে– সেগুলোর কেন আধুনিকায়ন করা হল না? ঘোড়াশালে সাড়ে তিনশ মেগাওয়াটের প্রকল্প ঠিক করতে সাড়ে তিন বছর লাগল কেন? আশুগঞ্জের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি বদলে দিয়ে এর ক্ষমতা দ্বিগুণ করা যাবে বলে সিমেস যে প্রস্তাব দিল সেটা কেন করা গেল না? এসব আমার বোধগম্য নয়। আমি বলব সরকারের হাতে এখনও সময় আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এগুলো ঠিক করে ফেলা যায়।

আমাদের এখন সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি তা হল কর্মসংস্থান বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে পুরনো মডেলগুলো বাদ দিতে হচ্ছে। আশিভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এ খাতের হাতেই যাচ্ছে আশি ভাগ ব্যাংকঋণ এবং অন্তত পঁচাত্তর ভাগ ব্যাংকের মালিকানা। তাই পিপিপির মাধ্যমে কীভাবে কর্মসংস্থান করা যায় সে ব্যাপারে সরকারের সমস্ত শক্তি ব্যয় করা উচিত। তবে এ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। গ্রামেগঞ্জে চালাতে হবে এসব কর্মকাণ্ড। আমাদের কৃষিকাজ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে এটা সম্ভব। এছাড়া অবশ্যই সৌরবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাসের মাধ্যমে কিছু কর্মসংস্থান সম্ভব।

সবশেষে যে বিষয়টি নিয়ে বলব তা নিয়ে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি। আমাদের রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে ১০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে মাটির নিচে যে উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লা আছে, তার আশিভাগ ব্যবহারযোগ্য। এটা তুলে ব্যবহার করলে আগামী পঞ্চাশ বছরে প্রতি বছরে ২০ হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

এ ব্যাপারে আমাদের রাজনীতিবিদদের সব বাদ দিয়ে খুব দ্রুত একটি জাতীয় ঐক্যমতে পৌঁছানো উচিত। অন্যসব বিষয়ে যতই তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থাকুক, এ বিষয়ে তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্তে আসতে পারেন খুব সহজেই। তারা যদি সরাসরি বসতে নাও পারেন তাহলে কোনো মাধ্যমে আলোচনা শুরু করতে পারেন। আমরা যদি এ মুহূর্তেও এ সিদ্ধান্ত নিই তাহলে কয়লার সাহায্যে পুরোপুরি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জায়গায় যেতে আরও পাঁচ বছর লেগে যাবে। তবে আগামী বিশ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যাবে।

তবে এজন্য আমাদের কয়লানীতি তৈরি করে সৎ ও যোগ্য মানুষদের হাতে উত্তোলনের দায়িত্ব দিতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার পাবে এখন কয়লার প্রসঙ্গটিই।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।