তোমার দেখানো পথে হে শহীদজননী

সাব্বির খানসাব্বির খান
Published : 25 June 2013, 08:36 PM
Updated : 25 June 2013, 08:36 PM

শহীদজননী জাহানারা ইমাম মৃত্যুবরণ করেন ১৯ বছর আগে, ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘ ১৩ বছর দুরারোগ্য কর্কটব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন তিনি ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি হেরে যাননি। বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশাল আন্দোলনগুলোর মধ্যে জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনের বীরোচিত বিজয় নিঃসন্দেহে অন্যতম এবং অতুলনীয়।

তাঁর মৃত্যুর মাত্র আড়াই বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় নাগরিক আন্দোলন, যা আজ দীর্ঘ ২১ বছরের কণ্টকপথ বেয়ে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। প্রজন্মের তরুণরা এ দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বর্তমান সরকারের আমলে উচ্চ আদালতের এক ঐতিহাসিক রায়ে '৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃপ্রবর্তনের রায় প্রদান করা হলেও, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কর্তৃক জারিকৃত যে 'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম' সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল– তা অদ্যাবধি সংবিধানে রয়ে গেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

তবুও আমরা আশাবাদী জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে। কোনো বিজয়ই রাতারাতি অর্জিত হয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে অনড় জাহানারা ইমামের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অপেক্ষা করেছে দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময়। আজ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম শহীদ জননীর দেওয়া দায় আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছে। সুতরাং জননীর বাকি দাবিগুলো তারাই আদায় করে ছাড়বে অবধারিতভাবে। ইতিহাস অন্তত সে সাক্ষ্যই দেয়।

২১ বছর আগে জাহানারা ইমামের আন্দোলনটি শুধু একটি আন্দোলনই ছিল না, একাধারে তা ছিল বিচক্ষণ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও। তিনি এ আন্দোলনের সূচনাপর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা এবং তাঁর মৃত্যুর পরও এর প্রাসঙ্গিকতাসহ নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন- "আমরা কেন বিচার চাই? রক্তাক্ত বিয়োগবিধুর এ প্রশ্নের উত্তর ও নারকীয় ঘটনাবলীর প্রমাণ ও সাক্ষী বাংলার ঘরে ঘরে আজও জাজ্বল্যমান। এমন কোনো পরিবার নাই, যেখানে ৭১-এর ক্ষতচিহ্ন নাই। ভাই হারিয়েছে বোনকে, মা হারিয়েছে ছেলেকে, স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে, কন্যা হারিয়েছে পিতাকে। যে ঘাতক দালালদের সহযগিতায়, যোগসাজশে মানব-ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এই হত্যাযজ্ঞ করতে পেরেছে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী সেই জামাত-শিবির, আবারও সেই একই কায়দায় মাথা তুলে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত করছে। আমরা সে জন্য আরও বেশি করে বিচার চাই।''

তিনি আরও লিখেছিলেন, "একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনর্বাসন বহাল রেখে একটি জাতির গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির ভবিষ্যত নির্মাণ করা কখনওই সম্ভব না। ঘরের মধ্যে সাপ এবং মানুষ একসঙ্গে বাস করতে পারে না। এই অবস্থা জেনে-শুনে যদি কেউ শান্তিতে ঘুমানোর উপদেশ দেয়, তাকে মূর্খ অর্বাচীন বলা যাবে না- সে আসলে ধূর্ত শয়তান। শান্তিপ্রিয় মানুষের সে বিনাশ চায় আসলে।''

শহীদজননীর এ কথাগুলো এখনও যেমন প্রাসঙ্গিক, ভবিষ্যতের জন্যও তেমন নিষ্কণ্টক পথনির্দেশনার ইঙ্গিত বহন করে। যে কথা তিনি অনেক বছর আগে বলে গিয়েছিলেন, কালের আবর্তে প্রজন্মের তারুণ্য আজ তা বুকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। গণজাগরণের এ পথ অচেনা মনে করছে না এ প্রজন্ম; বরং দ্বিধাহীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস মনে করছে- যা নিঃন্দেহে ইতিবাচক এবং ভরসার আশ্রয়স্থল।

যে কোনো দেশের সংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সূতিকাগার মূলত দেশটির সিভিল সমাজই হয়ে থাকে। কিন্তু সে অর্থে আমাদের দেশের সিভিল সমাজের সংজ্ঞা বরাবরই বিতর্কিত এবং অনেকটা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট থেকে গেছে। ঐতিহাসিকভাবে এ বিতর্কের গোড়াপত্তন হলেও স্বাধীনতা-উত্তর এ অস্পষ্টতা যেন আরও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সিভিল সমাজের সমর্থন নিয়ে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় গেলেও, পরে দেখা গেছে ক্ষমতাধররা সিভিল সমাজের ইচ্ছার বিপরীতেই কাজ করেছে। আবার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতাধররা সিভিল সমাজকে ব্যবহার করেছেন তাদের ক্ষমতার বলয়ের ব্যাপ্তি আরও প্রসারিত ও শক্তিশালী করতে।

যার ফলে শহীদজননী জাহানারা ইমামের স্বপ্নের একটি শক্তিশালী সিভিল সমাজ কখনওই এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। বরং একটি সচেতন সুস্থ্ চেতনায় সমৃদ্ধ নতুন প্রজন্ম সৃষ্টিকেই বাধাগ্রস্ত করেছে বারবার।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন সামরিক সমাজের প্রতিনিধি জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক-সংস্কৃতির তথা আমলাতন্ত্রের প্রসার ঘটানো– যা আমাদের দেশের জনগণের মানসিকতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমূল সাংর্ঘিক এবং সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। জেনারেলদ্বয় দেশের শিল্প-সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতি, সমাজ থেকে রাজনীতি– সর্বক্ষেত্রে বপন করেছেন সামরিকায়নের বীজ। বদলে দিয়েছেন একটি জাতির চেতনার মূল সংস্কৃতি। ভেঙে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাব এবং তার স্বপ্ন। সোজা ভাষায় যাকে বলে "জাতির মেরুদণ্ডে কুঠারাঘাত" করেছেন তারা।

জেনারেলদ্বয় তাদের এ হীনকার্য সম্পাদনে সাত সাতবার কুঠার চালিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্বলিত সংবিধানে। কেটেছেঁটে বাদ দিয়েছেন বাঙালি জাতির চেতনার মূল স্তম্ভ 'সমাজতন্ত্র' ও 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। মুসলমানিত্বের লেবাস পরিয়েছেন রাষ্ট্রের গায়ে, যা একাত্তরের মূল চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গণতন্ত্রায়নের কথা বলে খাল কেটে কুমির এনেছেন; পুনর্বাসিত করেছেন রাজাকার ও আলবদরদের। তৈরি করেছেন এক নতুন 'সিভিল সমাজ'। শহীদজননী জাহানারা ইমামের ভাষায় যাদের শুধু "মূর্খ-অর্বাচিন, ধূর্ত-শয়তান" হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। যাদের দৌরাত্ম্যে আর বাচলামিতে গভীর রাতের ঘুমই শুধু নষ্ট হয় না, সে সঙ্গে শান্তিপ্রিয় বাঙালির প্রতিদিনই নিত্যনতুন পদ্ধতিতে প্রতারিত হতে হয়।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে ঝাঁটাপেটা করে বিদায় করতে পারলেও, তাদের তৈরি সে শয়তানসম সিভিল সমাজ স্বঅবস্থানেই আছে এবং দেশের স্বাধীনতার সপক্ষের মূল সিভিল সমাজের চেতনাকেই বিঘ্নিত করছেন প্রতিনিয়ত। এ ক্ষেত্রেও জাহানারা ইমামের সে কথাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।

১৯৯০ এর পর জোটভিত্তিক হলেও পালা করে দেশের প্রধান দুটি দল রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে এবং এ দুটি দলই মূলত স্বৈরতান্ত্রিক এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। অথচ দল দুটি ঘুরেফিরে সেই সামরিক সরকারগুলোর সৃষ্ট সিভিল সমাজ দ্বারা চালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। অন্তত তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন ক্রিয়াকলাপে তা-ই দেখা যায়। দলদুটোর ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়ায় এ সিভিল সমাজই মূল ভূমিকা রেখে থাকে।

তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে, শক্তিশালী একটি সিভিল সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যুগ যুগ ধরে জাতির যে প্রত্যাশা- তা কি সফল হবে, নাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রক্ষমতা তাকে বারবার গ্রাস করবে? কেন একটি সৎ সুস্থ সিভিল সমাজের প্রয়োজন? কী হবে তাদের রূপরেখা ও কার্যপদ্ধতি? এসব প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করে একটি সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী হবে তা নিরূপণ করা।

আমাদের দেশের সিভিল সমাজ চালিত হয় মূলত দুটি ধারায়। প্রথমত রাজনৈতিক; দ্বিতীয়ত সামরিক গোয়েন্দাদের ধারায়। রাজনৈতিক ধারার সিভিল সমাজ আবার দুভাগে বিভক্ত। ক্ষমতাসীন আর বিরোধী পক্ষের হয়ে কথা বা কাজ করেন তারা। আর সামরিক গোয়েন্দা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিতরা একটি সুবিধাজনক স্থানে বসে রাজনৈতিক ধারার দুপক্ষের সিভিল সমাজকেই নিয়ন্ত্রণ করেন।

অর্থাৎ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী যে কোনো দলই ক্ষমতায় অথবা বিরোধী দলে থাকুক না কেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ছায়া হয় সামরিক সিভিল সমাজেরই প্রেতাত্মারা। আর এ কারণেই '৭৫ এর পর থেকে অদ্যাবধি সামরিক-বেসামরিক কোনো সরকারই একটি স্বাধীন সৎ সিভিল সমাজ আমাদের উপহার দিতে পারেনি। আর এ কারণেই সামরিক সিভিল সমাজের গোপন ইচ্ছার প্রতিফলনই আমরা দেখতে পেয়েছি বারবার, তা রাষ্ট্রক্ষমতায় যে-ই থাকুক না কেন!

সামরিক সরকারের করা পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী উচ্চ আদালতে বেআইনি ঘোষণার পরও স্বাধীনতার সপক্ষের সরকারও যখন সংবিধানের গা থেকে ধর্মীয় চাদর সরিয়ে নিতে পারেনি, তখন বোঝার আর বাকি থাকে কিছু? অথচ ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আকাশচুম্বী বিজয়ের বীজ কি শহীদজননী জাহানারা ইমাম বুনে যাননি ২১ বছর আগে? এর যত্ন না নিলে দায়ভার এ প্রজন্ম নেবে না। বরং ইতিহাস তার নিজ নিয়মেই নির্মম আঘাত করবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনের ফসল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের নিমিত্তে গঠিত 'আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত' কি আদৌ করতে পারবে একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচার? খোদ ট্রাইব্যুনালের ভিতরের অবস্থা এত ভয়াবহ যে, প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে। শুরু থেকে সেখানে যা হয়েছে, তাকে 'ছাগল দিয়ে লাঙল টানা'-র সঙ্গেই কেবল তুলনা করা যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

তারপরও কয়েকটি মামলার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু আপিল বিভাগে ঝুলে থাকা মামলার ভবিষ্যত কী হবে, তা খোদ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও জানেন না। ৩০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির বিধান করে সংসদে আইন পাশ হয়েছে খোদ মন্ত্রীর মাধ্যমেই। সমন্বয়হীনতা ও অপরিপক্কতার কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছে, যদিও আদালতে তার বিরুদ্ধে বেশিরভাগ অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, শুধুমাত্র শিথিল প্রসিকিউশনের কারণেই বিজ্ঞ বিচারক যাবজ্জীবনের চেয়ে বেশি কিছু সাজা দিতে পারেননি। এর জন্য কি অপরিপক্কতা না অনীহা দায়ী? ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত অনেকের চালচলন দেখলে তাদের অনীহার দিকটাই স্পষ্টত চোখে পড়ে। তাহলে কি তারাও সেই বিশেষ শ্রেণির সিভিল সমাজ দ্বারা পরিবেষ্টিত ও পোষ্য?

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে প্রজন্ম চত্বরে গড়ে ওঠা গণজাগরণ ইতিহাসের সফলতম আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটি। জাহানারা ইমামের বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ছবির পাদদেশে জমায়েত হওয়া লাখো মানুষের ঢল জননীর কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ সে আন্দোলনও কোনো এক অদৃশ্য চাপে বা ইশারায় স্তিমিত হয়ে যায় বারবার। কথাটা হতাশার হলেও ফিরে দেখা দিনগুলোর দিকে তাকালে এ হতাশা থাকে না।

গত একুশ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সূচিত আন্দোলনও অনেক চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েছে। ধাবমান এ স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে সাময়িকভাবে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও অন্যান্য সব আন্দোলনের মতো আপোসের সংস্কৃতিতে তলিয়ে যায়নি।

এখানেও ছিল উল্লেখযোগ্য অনেক অন্তর্ঘাত, ছিল প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতা। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন তার গোয়েন্দারা বারবার অনুপ্রবেশ করেছে আন্দোলন স্তিমিত করে দিতে। অত্যাচারিত হয়েছেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুনসহ অনেকে। কিন্তু জাহানারা ইমামের সন্তানেরা ভেঙে পড়েননি। যত বেশি আঘাত এসেছে, তত বেশি যেন শক্তি সঞ্চয় করে দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে গেছেন তারা শত্রুর বিরুদ্ধে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিপক্ষ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দোসর অন্যান্য মৌলবাদী দল সেক্যুলার মানবতাবাদী, সমাজতন্ত্রী ও গণতন্ত্রকামীদের 'ভারত ও আওয়ামী লীগের চর' হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রপাগাণ্ডা করেছে বিরামহীনভাবে।

ওদিকে সামরিক সিভিল সমাজের কূচক্রীদের কূটকৌশলে শাহরিয়ার কবিরকে কারাবরণসহ নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে একাধিকবার। দেশের প্রত্যান্তঞ্চলের নির্মূল কমিটির নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা মাসের পর বাড়িছাড়া থেকেছেন। অনেকে অত্যাচারিত এবং বিতাড়িত হয়েছেন নিজ ভিটামাটি থেকে। তবুও দমানো যায়নি আন্দোলন আর জননীর দামাল সন্তানদের। নিজ গতিতেই এগিয়েছেন তারা।

শহীদজননীর শেষ আদেশ নির্মূল কমিটির নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একদিন। তারপর থেকে আন্দোলনের স্রোতধারা সাময়িক স্থবিরতা বা মন্থরগতির পরও আবার বেগবান হয়েছে। নির্মূল কমিটি এ আন্দোলকে দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলের গণ্ডি ছাড়িয়েও পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রতিপক্ষের নোংরা আগ্রাসী প্রচারণায় অনেক সময় আন্দোলনের কর্মীরা বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ঠিকই, তবে একদল তরুণের জায়গায় আরেক দল এসেছে। আন্দোলনের শাখা-প্রশাখা ও শেকড় বিস্তৃত হয়েছে দেশের মাটিতে ও দেশের বাইরে।

জাগরণ মঞ্চের তরুণেরা সে জায়গা বদল করা জাহানারা ইমামের স্বপ্রণোদিত কর্মীরাই। তাদের ক্ষয় নেই। তারাও জামায়াতের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাদের নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ঠিক একই ভাষায় যেমন বিষোদগার করে জাহানারা ইমাম, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনদেরও বলা হয়েছে বিভিন্ন সময়। শাহরিয়ার কবিরকে যেমন হত্যা করার জন্য মৌলবাদী জামায়াতিরা হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরে, ডা. ইমরান সরকারদের হত্যার জন্যও সেভাবে খোঁজে। এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে রাজিবকে, যেমন হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল ড. হুমায়ূন আজাদকে।

প্রজন্মের পালাবদল শুরু হয়েছে একটি আদর্শের ছায়াতলে। যে আদর্শের মূলমন্ত্র গেঁথে গেছেন ১৯ বছর আগে একসময় শহীদজননীকে নিয়ে।

ইমরান সরকারদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, যত বিপদই আসুক, আসুক যত ভয়ভীতি আর প্রলোভোনের ইশারা– আপনারা জানেন মায়ের নির্দেশিত অভিষ্ট লক্ষ্য কোথায়। প্রজন্মের পালাবদলে যে আদর্শের জোয়াল আপনারা কাঁধে তুলে নিয়েছেন, দেখবেন তা যেন লক্ষ্যে পৌছায়। আমরা আছি, থাকব, দেহের শেষ রক্তবিন্দুটি থাকা পর্যন্ত আপনাদের পাশে।

মনে রাখবেন, আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আছে একটা গোটা জাতি আর তার ভবিষ্যত। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আমাদের জননী জাহানারা ইমাম। আকাশে, বাতাসে, প্রেরণায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো।

আসুন আমরা বিশ্বাস করি, "মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। গণআদালতের গণজাগরণ আজ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।"

সাব্বির খান : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।