‘রচিয়াছো তুমি নিজের অপমান’

জোবাইদা নাসরীনজোবাইদা নাসরীন
Published : 23 June 2013, 05:00 PM
Updated : 23 June 2013, 05:00 PM

এক

বর্তমানে সংসদে বাজেট নিয়ে চলছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বাজেটের বাইরে জোরেশোরে তর্ক-বিতর্ক এবং রাজনৈতিক বিলাপ চলছে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির জয় এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হারের বিষয় নিয়ে। হিসেব-নিকেশ চলছে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। সংশয়-সম্ভাবনার দোলাচলে চলছে রাজনীতির গুটি।

কিন্তু সংসদ সদস্যদের একে অন্যের প্রতি শব্দচয়ন শুনে মনে হয় না এসব কিছু নিয়ে তাদের মাথাব্যথা রয়েছে; বরং মনে হয় তারা সংসদে এসেছেন তাদের 'কাজিয়া-প্রবণতা' ধারালো করার জন্য। জাতীয় সংসদে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন চলার সময় সরকারি এবং বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের শিষ্টাচার-বহির্ভূত কথাবার্তা শুধুমাত্র সংসদ অধিবেশনকেই হালকা করেনি, বরং অনেকটাই খাটো হয়ে গেছে 'নারী-প্রাধ্যান্যশীল এবারের সংসদ'-এর মতো গর্ব করার বোধটিও।

বাংলাদেশের দুদলের নেতানেত্রীদের একে অপরের প্রতি শিষ্টাচার-বহির্ভূত বক্তব্য প্রদান এ প্রথম নয়। একসময় বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেছিলেন, 'সরকারকে লুলা বানিযে দেব।'

আবার প্রধানমন্ত্রীও বিরোধী দলকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, 'আপনাদের খবর আছে।'

এভাবে শুধু একে অন্যের প্রতি নয়, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য আশরাফি পাপিয়া তৎকালীন স্পিকারকে বলেছিলেন, 'মাইক দে।'

এর কোনোটিই কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এ রকম বক্তব্য আশা করি না।

এর আগে এ অধিবেশনই বিরোধী দলীয় আরেক সংসদ সদস্যের বক্তব্য 'তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে চুদুরবুদুর চইলত ন' নিয়ে তোলপাড় হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়া ও গণমাধ্যমে। কারণ 'চুদুরবুদুর' শব্দটি আমাদের সনাতন মধ্যবিত্ত মননের সঙ্গে যায় না। প্রমিত বাংলা চর্চাকারীরাও একে সংসদে ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। যদিও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষরা শব্দটি হরহামেশাই ব্যবহার করেন এবং সেখানে কোনো ধরনের অশ্লীলতার প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। এটি একটি আঞ্চলিক শব্দ। বলা হয়, 'কোনো কোনো অঞ্চলের বোল, কোনো কোনো অঞ্চলের গাল'।

যাহোক, যেহেতু সংসদে সব অঞ্চলের প্রতিনিধি থাকেন সেখানে সকলের বোঝার মতো ভাষা ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। তাই অনেক আলোচনা-সমোলাচনা চলছে এ নিয়ে।

দুই.

তবে সব ধরনের কোন্দল-প্রবণতা ছাপিয়ে সংসদ এখন হৈচৈমুখী। এ হৈচৈ-এর মূল কারণ দুদলের কোনো কোনো নারী সংসদ সদস্য একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য নারীর প্রতি অবমাননাকর অশ্লীল বাক্য এবং শব্দ ব্যবহার করছেন। 'যার যেখানে জায়গা' কবি হেলাল হাফিজের একটি বিখ্যাত কবিতা। কিন্তু এ কবিতার শেষ দুটো লাইন ব্যবহৃত হয়েছে এক মাননীয় সদস্যের মুখে। চলতি সংসদেরই বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য শাম্মী আকতার হেলাল হাফিজের কবিতার সে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, 'আমিও গ্রামের পোলা, চুতমারানি গাইল দিতে জানি।'

এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কবিতা আবৃত্তি করার জন্য উনি সংসদে আসেননি কিংবা 'চুতমারানি' শব্দটার অর্থ তিনি জানেন না। তিনি এটাও ভালোভাবে জানেন জাতীয় সংসদ কবিতা আবৃত্তির জায়গা নয়। তবে সত্যি এটাই যে, তিনি উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই এটি ব্যবহার করেছেন। আমরা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যে হাসি-তামাশা কিংবা রসিকতা করি সেটা নিশ্চয়ই জনসমাবেশে বা শ্রেণিকক্ষে করি না। মানুষ একেক পরিবেশে একেক আচরণ করে। মানুষের আচরণ তার সামাজিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ। আর এ চাহিদা নির্ভর করে পরিবেশের উপর। কোথায় কোন কথাটা পাড়তে হবে, জায়গাটি কোথায়, শ্রোতা কারা–এগুলো বিবেচনায় আনা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি বড় গুণ।

আর ব্যক্তিটি যদি হন জনপ্রতিনিধি তাহলে তার দায়িত্ব থাকে অনেক বেশি। শাম্মী তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নারীকে অসম্মান করেছেন, নারীকে হেয় করা পুরুষতান্ত্রিক 'গালি'র মাধ্যমে। শুধু সংসদেই নয়, সংসদ ছাপিয়ে শাম্মীর এ উদ্ধৃতি স্থান পেয়েছে ফেসবুকে, নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি এ পর্যায়ে গেছে যে, ফেসবুকে একজন শাম্মী হক দুঃখ করে লিখেছেন, 'শাম্মী নামের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে এখন চুতমারানি।'

তার নাম 'শাম্মী' বলে তাকেও অনেকেই এ ধরনের শব্দ লিখছেন, গালিগালাজ করছেন। তিনি টেলিফোন করে তার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছেন কেন তার নাম 'শাম্মী' রাখা হয়েছে।

সংসদ সদস্য শাম্মী যেমন নারী হয়ে পুরুষতান্ত্রিক গালি দিয়ে অন্যকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন ঠিক তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও শাম্মীকে হেয় করা হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক অশ্লীল গালি ব্যবহার করে। মানুষ হিসেবে মানবিক সম্পর্কের ভিতর দিয়ে হাঁটা সংসদ সদস্যদের এ ধরনের আচরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

দুঃখের বিষয়, শাম্মীর এ ধরনের আচরণের পর আরেক নারীর প্রতি অসম্মান দেখিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অপু উকিল। তিনি বলেছেন, 'খালেদা জিয়া এক ইহুদি চা-মালিকের ঔরসজাত সন্তান'। এর আগে বিরোধী দলীয় একজন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূর ইহুদি পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন; এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য অপু উকিল খালেদা জিয়া সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য দিলেন।

কেন নারী সংসদ সদস্যরা এভাবে নারীর প্রতি অবমাননাকর শব্দচয়ন করে পরস্পরকে আঘাত করছেন? একজন নারী যখন নারীকে অসম্মান করছেন তখন আরেক নারীও প্রতিক্রিয়া হিসেবে নারীদের 'আরও খারাপ' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই সম্মানহানি কিন্তু হচ্ছে নারীর।

আরেকটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। সংসদে দুদলই নারীকে ব্যবহার করছে অন্য নারীকে অসম্মান করার কাজে। এটিও পুরুষতন্ত্রের অতিপুরাতন কিন্তু বেশ কার্যকরী কৌশল। অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ লালনকারী নারী-পুরুষরাও ইচ্ছানুযায়ী অপদস্থ করছেন সে নারীদেরই এটা বলে যে, 'নারীই নারীর প্রধান শত্রু'। আর আমরা সে ফাঁদে পা দিয়ে পুরুষতন্ত্রকেই জোরদার করছি সংসদে, পাবলিক পরিসরে, ঘরে-বাইরে।

এ ফাঁদবিছানো রাস্তার খানা–খন্দ হিসেবে কাজ করছে পুরুষতান্ত্রিক বাত্যাবরণে নির্মিত এবং নারীকে অসম্মান করার জন্য বহুলভাবে চর্চিত নারীকেন্দ্রিক গালি কিংবা নারীবিদ্বেষী শব্দমালা।

যখন নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শেখানো বুলি দিয়ে অন্যান্য নারীকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেন তখন তাকে মনে রাখতে হবে এটি বুমেরাং হয়ে যায়। এতে আরও তেতিয়ে উঠে পুরুষতন্ত্র। কারণ এতে তাদেরই লাভ। নারীর বিরুদ্ধে নারীকে ব্যবহার করা যায়, তাদের গায়ে কোনো আঁচড় লাগে না।

আমরা এভাবেই শীত, গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্তে কোনো না কোনোভাবে পুরুষতান্ত্রিকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হই কেবলই অন্যকে অসন্মান করার উল্লাসে মেতে ওঠে; কখনও ভাবি না এতে নিজেকেই অসম্মানিত করা হয়, নিজের অপমানের কুয়া তৈরি করা হয়, মর্যাদা নিয়ে নারীর বেঁচে থাকার লড়াইকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।