প্রদেশ গঠন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দুটি কথা

আলী কবীর
Published : 19 June 2013, 05:34 PM
Updated : 19 June 2013, 05:34 PM

দেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে দেশব্যাপী জোরেসোরে যে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা এখনও চলছে। উচ্চ আদালত সংবিধানের কতিপয় সংশোধনী বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করার পর সরকারি ও বিরোধী দলসমূহ নড়েচড়ে বসে এবং প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে তুমুল বির্তক শুরু হয়।

সংবিধান সংশোধন করা সহজ কাজ নয়। এটি একাধারে জটিল, দুরূহ এবং স্পর্শকাতর একটি বিষয়। দেশ ও জাতির সর্বোচ্চ স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করা পৃথিবীর সব সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ। স্বাভাবিক কারণেই এ কাজের ভালোমন্দ সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই কেবল সংবিধান সংশোধনের কাজে অগ্রসর হওয়া উচিত।

তুচ্ছ কারণে বা ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দিলে তা গোটা জাতির অকল্যাণ ও অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতীতে এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে বলে অনেকের ধারণা এবং এতে দেশের তথা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে অধিকাংশ সচেতন মানুষ মনে করেন।

দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সংসদীয় সরকার সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু ও সম্পন্ন করেছে। সঙ্গত কারণেই এ প্রক্রিয়া সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় সবার মনে রাখা দরকার বলে মনে হয়। সংবিধান যখন-তখন এবং ইচ্ছামাফিক সংশোধন করা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার সহায়ক নয়। সুতরাং দেশ ও জাতির সার্বিক চাহিদামাফিক এ সময়ে অনুভূত ও প্রয়োজনীয় সকল জরুরি বিষয় প্রস্তাবিত সংশোধনীতে স্থান পেলে বহু বছর আর এ জটিল কাজে হাত দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ জাতির সামনে যেসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ আলোচনায় রয়েছে তা যতটা সম্ভব এ সংশোধনীর আওতায় নিয়ে আসতে পারলে অনেক প্রয়োজনীয় কিন্তু অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে আলোচনা ও গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে বলে মনে হয়। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। গত প্রায় ৪০ বছরে এ জনসংখ্যা অন্তত একশ' ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে কমপক্ষে ১৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে দেশটি জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে আমরা পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে এখনও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। এ পুরনো কাঠামো নিয়ে একটি বিশাল জাতির উন্নয়নচাহিদা আদৌ মেটানো সম্ভব কি না তা আমাদের গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। একথা তো অনস্বীকার্য যে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ অসম্ভব। তাছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতার বাস্তব বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কার্যকর স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তোলাও অবাস্তব ধারণা।

রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে উপমহাদেশের দেশসমূহ– বিশেষত ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের মিল বেশি। আমরা অতীতে উভয়ের অংশ ছিলাম। ভারতবর্ষের বর্তমান জনসংখ্যা ১২১ কোটি এবং সেখানে মোট ২৯টি রাজ্য বা স্টেট রয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি চার কোটি মানুষের জন্য একটি রাজ্য। পাকিস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা ২০ কোটি এবং সেখানে প্রদেশ বা প্রভিন্সের সংখ্যা ৫। অর্থাৎ পাকিস্তানেও গড়পড়তা মোটামুটি চার কোটি মানুষের জন্য একটি প্রদেশ রয়েছে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি দুটি দেশের যখন এ অবস্থা, তখন আমরা কেন ১৫-১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে পাকিস্তান আমলের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে আছি, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। এককেন্দ্রিক এ শাসনব্যবস্থা দেশের উন্নয়ন ও প্রশাসনিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম। বর্তমান ব্যবস্থায় ঢাকা অভিমুখী জনস্রোত শহরটিকে দ্রুত বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। একটিমাত্র হাইকোর্টে যে মামলা জট তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ দুটি উদাহরণ বর্তমান এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় দেশে অনধিক চারটি প্রদেশ গঠিত হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের ন্যায় এ প্রদেশগুলো হবে দেশের সংবিধান ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় স্বশাসিত। ঐতিহ্যবাহী দপ্তরসমূহের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে রেখে বাকি দপ্তরসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার প্রদেশগুলো উপর অর্পণ করা যেতে পারে। যেহেতু দেশের উপজেলা চেয়ারম্যানরা প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন, তারাই প্রাদেশিক আইনসভার (Provincial Assembly) সদস্য হতে পারেন। তাছাড়া জেলা শহরের নির্বাচিত পৌর মেয়ররাও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হতে পারেন। প্রদেশগুলোতে অনধিক ১৫ সদস্যের মন্ত্রিসভা থাকবে, যার প্রধান হবেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং তার মন্ত্রিপরিষদ গঠন করবেন। প্রত্যেক প্রদেশে একজন গভর্নর থাকবেন, যিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োজিত হবেন। নিম্নবর্ণিত এলাকা নিয়ে প্রদেশগুলো গঠিত হতে পারে:
১। সাবেক ঢাকা বিভাগ (বর্তমান ঢাকা বিভাগ ও বরিশাল বিভাগ)- প্রদেশ ১
২। সাবেক চট্টগ্রাম বিভাগ (বর্তমান চট্টগ্রাম বিভাগ ও সিলেট বিভাগ)- প্রদেশ ২
৩। সাবেক রাজশাহী বিভাগ (বর্তমান রংপুর বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগ)- প্রদেশ ৩
৪। বর্তমান খুলনা বিভাগ- প্রদেশ ৪

দেশে ৩টি বা ৪টি প্রদেশ গঠিত হলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নতুন গতি সঞ্চার হবে, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী হবে। দেশ মামলা জট হতে মুক্তি লাভ করবে এবং সর্বোপরি ঢাকা অভিমুখী অবিরাম জনস্রোত বন্ধ হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রে বিশাল মন্ত্রিসভা গঠনের প্রবণতা কমে যাবে। প্রশাসন তথা সরকার ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সারাদেশে ব্যাপ্তি লাভ করায় জনসম্পৃক্তি বৃদ্ধি পাবে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।

আমরা যখন একটা প্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, তখন বহুদিন ধরে সেটা আমাদের সম্পূর্ণ বিবেচনাবহির্ভূত থাকে। আবার বিষয়টা যখন আমাদের বিবেচনা লাভে সক্ষম হয়, তখন আমরা সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলি। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭২ সালে শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা এবং ১৯৮২ সালে আবার সেগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমে আমরা নির্বিচারে ছোট-বড়-মাঝারি সকল শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করে এক বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দিলাম। পরবর্তীতে আবার ১৯৮২-৮৩ সালে এরশাদ সাহেবের শাসনামলে এমন ঢালাওভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ ও পুঁজি প্রত্যাহার শুরু হল যে বিএডিসি, টিসিবি, বিআরটিসির ন্যায় অতিপ্রয়োজনীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করে ফেলা হল। কসকর এবং খাদ্যশস্য রেশনিং ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হল। এ রকম ঢালাও ব্যবস্থা গ্রহণ দেশের জন্য শুভ হয়নি।

দেশে প্রদেশ গঠন নিয়ে এমনটি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় তিনটি, বড়জোর চারটি প্রদেশ গঠিত হতে পারে। এর বেশি প্রদেশ গঠন, যেমনটা এরশাদ সাহেব বলে আসছেন, কোনোক্রমেই সমীচীন হবে না। বরঞ্চ তা প্রত্যাশিত সুফল না এনে বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। দেশে চারটি প্রদেশ গঠন করা হলে তার সীমানা সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। আর যদি ৩টি প্রদেশ গঠন করার সিদ্ধান্ত হয় তা নিম্নবর্ণিত এলাকা নিয়ে গঠিত হতে পারে :

১) পূর্বাঞ্চল প্রদেশ বা পূর্ব বাংলাদেশ
বৃহত্তর ফরিদপুর ব্যতীত ঢাকা বিভাগ
চট্টগাম বিভাগ
সিলেট বিভাগ

২) দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশ
খুলনা বিভাগ
বরিশাল বিভাগ
বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা

৩) উত্তরাঞ্চল প্রদেশ বা উত্তরবঙ্গ
রাজশাহী বিভাগ
রংপুর বিভাগ।

আবার এরশাদ সাহেব বলেছেন বলে প্রদেশ গঠনের ধারণাটা খারাপ– এটাও কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। সরকার বরঞ্চ বিষয়টির সকল দিক বিবেচনা করে দেখার জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করতে পারে।

দেশে প্রদেশ গঠনের পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন পুরনো ১৭ জেলাকে বিভাগ ঘোষণা করা এবং পুরাতন সব জেলাশহরের পৌরসভাগুলোকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা। উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতসমূহ পুনরায় চালু করা। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকা নিয়ে পৃথক ঢাকা মেট্রোপলিটান জেলা গঠন করা। বর্তমান ঢাকা মহানগরী, ঢাকা জেলার সাভার ও কেরানীগঞ্জ উপজেলাদ্বয়, গাজীপুর জেলার টঙ্গি থানা, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলা (আংশিক) এবং গাজীপুর সদর উপজেলার চৌরাস্তা ও চন্দ্রা পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকা নিয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা মেট্রোপলিটান জেলা গঠিত হতে পারে। বর্তমান ঢাকা জেলার দক্ষিণের দুটি উপজেলা দোহার ও নবাবগঞ্জকে মুন্সীগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার সঙ্গে ও উত্তরের ধামরাই উপজেলাকে মানিকগঞ্জ জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সচিবালয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রশাসন তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না, ভেতরে দালান-কোঠা যতই নির্মাণ করা হোক। পাঁচমিশালি, জগাখিচুড়ি মার্কা সচিবালয়ের একেকটি ইমারত আমাদের এ ভূখণ্ড একেক দেশের অংশ হিসেবে থাকার সময় নির্মিত হয়েছিল। যেমন ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং সবশেষে বাংলাদেশ। এর ফলে এদের চেহারা, অবয়ব, এমনকি রংও বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরনের। এটা একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী সচিবালয় হতে পারে না। দেশের স্বাধীনতার ৪২ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। অনেক বিলম্বে হলেও স্বাধীন দেশের, গণতান্ত্রিক সরকারের উপযুক্ত একটি সুপরিসর ও আধুনিক সচিবালয় আমাদের গড়ে তুলতেই হবে। সে সচিবালয়ের মধ্যমণি হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং যেখানে থাকবে দেশের প্রধান নির্বাহী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

আরেকটি বিষয় না বলে পারছি না। আমাদের ঘড়ির সময় কি চিরকালই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সময় বা East Pakistan Standard Time (EPST) অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকবে? না কি ভৌগলিক বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক সত্য বিবেচনায় রেখে এটি পুনর্নির্ধারিত হবে? বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভেবে দেখা উচিত।

আলী কবীর: সাবেক সংস্থাপন সচিব, কবি, প্রাবন্ধিক।