দরকার শ্রম আইনের মানবিক সংশোধনী

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 16 June 2013, 07:12 PM
Updated : 16 June 2013, 07:12 PM

'পুঁজির নেই কোনো দয়ালু রূপ, পুঁজি সর্বত্রই এক ভয়ার্ত রূপের অধিকারী'- পোশাকশিল্পসংশ্লিষ্ট এক টিভি টকশোতে বলছিলেন দেশের প্রথমসারির একজন শিল্পমালিক। বেশ আত্মসমালোচনার সুরেই তিনি বলছিলেন কথাগুলো। কিন্তু শিল্পের প্রায় পুরো অংশই এর বিপরীত অবস্থানে। মালিকপক্ষ সবসময় চেয়েছেন পুঁজির সংবর্ধন কিন্তু তা করতে গিয়ে শিল্পের প্রাণ শ্রমিকস্বার্থকেই বলি দিয়েছেন বারবার।

সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদী তত্ত্বের উদ্ভাবক জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স দেড়শ বছর আগে রচিত তাঁর ঐতিহাসিক ক্যাপিটাল গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থা নিজের এবং অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থেই শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং সব কারখানায় তার বাস্তবায়নে প্রণোদনা জোগায়। কার্ল মার্ক্স কিংবা আইএলও এদের এসব আলোচনাকে হয় পুস্তকী না হয় আধুনিক শিল্পবান্ধব নয় আখ্যা দিয়ে শ্রমিকস্বার্থের যে কোনো পদক্ষেপকেই মালিকপক্ষ অবজ্ঞা করে আসছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, আইএলওর বিধান অনুযায়ী সব দেশে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে একটি জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শমূলক কমিটি থাকার কথা। সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে শ্রমপরিস্থিতি আলোচনা এবং সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়মিত সভা হয় না। আর কমিটিও প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবেই থাকে। ফলে এ কমিটির কাজের সুফল শ্রমিকেরা পান না।

ত্রিপক্ষীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার জন্য ২০১১ সালের ২৬-২৭ অক্টোবর শ্রীলঙ্কায় সাত জাতির সম্মেলনে বাংলাদেশও যোগদান করে। সেখানে ভুটান ছাড়া এ অঞ্চলের ছয়টি দেশ ও চীনের প্রতিনিধিরা ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আইএলওর প্রতিনিধি। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে সবকিছু আলোচনা করা হয়। দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে ত্রিপক্ষীয় কমিটির কাজে যেমন সাফল্য আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতা।

আমাদের দেশে শ্রমঅসন্তোষ দূর করতে একদিকে যেমন অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি দরকার, তেমনি দরকার ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক কমিটির সক্রিয় ভূমিকা। শ্রীলঙ্কার সম্মেলনে আইএলওর ঢাকা অফিসের জন্য এ মর্মে সুপারিশ করা হয় যে, তারা যেন আইএলও কনভেনশন '৮৭ ও '৯৮ অনুসারে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ কমিটির অংশীদারদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করে এবং একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন 'শ্রম কমিশন' গঠনে সহায়তা দেয়।

জাতীয় শ্রমনীতি পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার কথা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করে বিপুল মান্ডেট নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ২২ এপ্রিল মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর সংশোধনী প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। ১৩ মে মন্ত্রিসভায় সংশোধনীটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। চলমান সংসদ অধিবেশনে আইনটি 'বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩' নামে পাশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশোধিত আইনটি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং অংশগ্রহণকারী কমিটি সংক্রান্ত ধারার কিছু শব্দ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। একাধিক শ্রমিকনেতা বলছেন, এ আইন পোশাকশিল্পের পরিবেশ উন্নত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে না। তারা সরকারকে আরও মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শ্রমিকস্বার্থবিরোধী ধারা বাদ দিয়ে আইনটি যেন সংসদে পাশ করা হয়।

সংশোধিত শ্রম আইন বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকেরা আর্থিক সুবিধা ও লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। মালিককে নানা অজুহাতে যে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যূত করার পথ সুগম করে দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনটি ২০০৬ সালের শ্রম আইনের চেয়েও খারাপ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

শ্রম আইন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, (ধারা ২৩-৩) প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খল বা দাঙ্গা-হাঙ্গামামূলক আচরণ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অন্যের কাজে বাধা দেওয়া অথবা শৃঙ্খলাহানিকর কাজ করলে মালিক 'অসদাচরণের' অভিযোগে শ্রমিককে বরখাস্ত করতে পারবেন। আইনটির বিধান হচ্ছে, অসদাচরণের কারণে শ্রমিক বরখাস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন না।

বিষয়টি পরিষ্কার। মালিকপক্ষের পছন্দ না হলে শ্রমিকের যে কোনো কাজ 'অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাহানিকর' উল্লেখ করে এ ধারায় শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার অধিকার প্রয়োগ করবেন তারা। সে ক্ষেত্রে শ্রমিক কোনো 'সার্ভিস বেনিফিট' পাবেন না। এ রকম একাধিক ধারা শ্রমিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।

শ্রম আইনের (২৭-৩) ধারার সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে শ্রমিককে ১০ দিনের সময় দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ও চাকরিতে যোগ দিতে নোটিশ দিতে পারবেন মালিক। শ্রমিক নির্ধারিত সময়ে ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে বা চাকরিতে যোগ না দিলে তার চাকরির অবসান ঘটবে এবং তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। শ্রমিকনেতাদের অভিমত, একজন শ্রমিক বছরের পর বছর সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করার পরও মালিক তাকে চাকরিচ্যুত করলে তিনি কোনো 'সার্ভিস বেনিফিট' পাবেন না এটা অন্যায়। এ সংশোধনী শ্রমিকঅসন্তোষ বাড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করেন।

ধারা( ৪-১১)-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে, জরুরি কাজে অথবা অপরিহার্য কারণে স্থায়ী ধরনের কাজে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে। শ্রমিকনেতারা বলছেন, এ বিধান বাদ দেওয়া প্রয়োজন। এ ধারা মালিকপক্ষকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে কারখানা চালানোর অনুমোদন দেবে। এতে সঙ্গত কারণেই মালিকরা জরুরি, অপরিহার্য ইত্যাদি কারণে বেশি সংখ্যায় অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেবেন।

পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করার একটি আইনি ব্যবস্থার কথা শোনা যায়, যদিও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। তার ওপর বর্তমান আইনে বলা হচ্ছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে এ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না; পরিবর্তে ক্রেতাদের সাহায্য নিয়ে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, লভ্যাংশ শ্রমিককে দেওয়ার বিধানটি পালনের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্পের মালিকেরা কখনও আন্তরিক ছিলেন না। মালিকেরা কোটি কোটি পাওনা টাকা থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছেন শুরু থেকেই।

আইএলও কনভেনশনের আলোকে শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি ছিল শ্রমিক সংগঠনগুলোর বহুদিনের। কিন্তু সে দাবি বোধহয় পূরণ হল না এবারও। মালিকেরা কখনও চাননি পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠুক যদিও শ্রম আইনে কখনও-ই ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ছিল না। এ ক্ষেত্রে সরকারও নানাভাবে মালিকপক্ষকে সহায়তা করে আসছে।

আইএলও কনভেনশনের ৮৭ ধারা শ্রমিকদের সংগঠন করা ও নেতা নির্বাচন করার অধিকার দেয়। বাংলাদেশ এ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। তথাপি পোশাকশিল্পের বেশিরভাগ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নেই। নিয়ম হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে নিবন্ধন করার জন্য শ্রম পরিচালকের দপ্তরে আবেদন করতে হয় শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের নামের তালিকাসহ। ২০০৬ সালের আইনে বলা ছিল, আবেদনপত্র পাওয়ার পরপরই শ্রম পরিচালক তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিককে অবহিত করবেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মালিকপক্ষ তালিকা হাতে পাওয়ার পরপরই শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেয়; ওদের চাকরিচ্যুত বা হয়রানি করেন। চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়ে শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার আর চেষ্টাই করেন না।

বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বিভিন্ন আলোচনায় দাবি করেন, প্রায় ১০ শতাংশ কারখানায় এখন ট্রেড ইউনিয়ন আছে। যদিও শ্রমিকনেতারা দাবি করেন এ হার মাত্র ১ শতাংশ।

শ্রমিকদের স্বার্থে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, সমঝোতা ও সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ জন শ্রমিক থাকলেই মালিক ও শ্রমিকের প্রতিনিধিদের নিয়ে 'অংশগ্রহণকারী কমিটি' থাকতে হবে। বিজিএমইএর নেতা আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৭০ শতাংশ পোশাক কারখানায় অংশগ্রহণকারী কমিটি রয়েছে। এসব কমিটি শ্রমিকের স্বার্থ দেখে। অনেক মালিকই 'অংশগ্রহণকারী কমিটি' আছে বলে বেশ আত্মপ্রসাদে ভোগেন। কেউ কেউ একে ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প বলেও প্রচার করেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মালিকেরা বিভিন্ন কারখানায় নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে তল্পিবাহক কমিটি গঠন করেন। এসব কমিটি মালিকের স্বার্থই দেখে, শ্রমিকের নয়।

যে কোনো মানদণ্ডের বিচারে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ শিল্পদুর্ঘটনা পশ্চিমা পোশাক আমদানীকারক থেকে শুরু করে জাতিসংঘ এবং ইইউকেও বিচলিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। ক্ষুব্ধতা-সংক্ষুব্ধতায় শেষ হলেও হত, কিন্তু সাভার ট্র্যাজেডির পর কিছু আন্তর্জাতিক পোশাক ব্র্যান্ডের বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক চুকানোর ঘোষণা পুরো শিল্পকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

মালিকদের যথাযথ মনোযোগের অভাব ও বিদ্যমান নীতিকাঠামো মেনে না চলার কারণে প্রতিরোধমূলক তো নয়ই প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের অভাবে শিল্পটির ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে ইইউ জিএসপি-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

সাভার বিপর্যয়ের পর আলোচ্য শ্রম আইন নিশ্চিতভাবেই নিবিড় পর্যবেক্ষণের বিষয় হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে। তবে মন রাখতে হবে শ্রম আইনের সংশোধনী মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার পশ্চিমারা যেমন চায়, তার চেয়ে বেশি চান পোশাকশিল্পসংশ্লিষ্টরা।

এম এম খালেকুজ্জামান : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।