‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন’- একটি সতর্ক পর্যালোচনা

এম সানজীব হোসেন
Published : 11 June 2013, 05:20 PM
Updated : 11 June 2013, 05:20 PM

সিরাজুল আলম খান অসুস্থ্ হয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালের সিসিইউতে আছেন। পত্রিকার এ সংবাদ পড়ে বাবাকে বললাম তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে যেতে। আমার ২৮ বছরের জীবনে সিরাজুল আলম খানকে কখনও দেখিনি, শুধু নামই শুনে গেছি। বিভিন্ন সময়ে একটি কথা যেটা বারবারই উঠে এসেছে তাঁর সম্পর্কে তা হল তিনি পারতপক্ষে জনসমক্ষে আসেন না, কোনো সাক্ষাৎকার প্রদান করেন না। পর্দার পেছনে থেকে তিনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই প্রচারবিমুখ সিরাজুল আলম খানকে বাংলাদেশের রাজনীতির 'রহস্য পুরুষ' বলা হয়ে থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলাভের একজন অন্যতম কাণ্ডারি সিরাজুল আলম খান। '৫০, '৬০ ও '৭০ দশকের পূর্ব বাংলার কৃতী রাজনীতিবিদদের অনেকেই তাঁদের জীবনকাহিনী ও অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে যাননি অথবা যেতে পারেননি। শুরুতেই বলতে পারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আমাদের পরম সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বাংলার মানুষের হাতে পৌঁছেছে। তবে সেটাও 'অসমাপ্ত'।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, "এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি সময়ে তিনি লিখেছেন" (রহমান, ২০১২)।

এমনকি তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির একটি বড় অংশও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধবংস হয়ে যায়- সে কথাও আমরা আজ জানতে পেরেছি 'তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা' বইটিতে সিমিন হোসেন রিমির লেখা ভূমিকা থেকে।

বাসায় বাবার কাছ থেকে শুনেছি কর্নেল তাহেরও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন সময় তাঁর চিন্তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাহেরের সে খাতাগুলো আজও আমাদের ফেরত দেওয়া হয়নি। তারপরও কর্নেল তাহেরের রচনাবলি 'ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে' প্রকাশিত হয়েছে।

এমনসব বই আমার কাছে অমুল্য সম্পদ। কারণ বাংলাদেশের ফাটলধরা ইতিহাসের সঠিক বিনির্মাণের জন্য এসব বইতেই আমাদের বারবার ফেরত যেতে হবে।

সিসিইউতে সিরাজুল আলম খান হয়তো তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন- একথা ভেবে মনখারাপ হয়ে যায়। বাবাকে নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাই। তাঁর সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎটি ছিল চিত্তাকর্ষক। আমি অক্সফোর্ডে আইন পড়েছি শুনে তিনি কিছুটা বিরক্ত হন।

তিনি বলেন যে আমাদের দেশের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ব্রিটিশপ্রবর্তিত আইনে কোনো পরিবর্তন না আনা। তিনি ব্রিটিশ সাংবিধানিক ইতিহাস টেনে কিছু কথা বললেন। তাঁকে বলতে ইচ্ছা করছিল, "আমি ব্রিটিশ আইন পড়িনি, পড়েছি ক্রিমিনোলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস। মোটা দাগে আপনার সঙ্গে আমি একমত। স্বাধীনতার পর বহু ক্ষেত্রেই ব্রিটিশপ্রবর্তিত আইনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল।''

সেগুলো কিছুই বলতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে যেহেতু প্রথম সাক্ষাৎ, এবার শুধু শুনে যাই- ভবিষ্যতে আলোচনার সুযোগ নিশ্চয়ই আসবে। সিসিইউতে বেশ চড়াগলায় সিরাজুল আলম খান বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে আমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতে থাকি তাঁর কথা শুনে।

গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে তিনি বেশ নেতিবাচক কথাবার্তা বলছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে 'শাহবাগ' কীভাবে দেশকে দুভাগ করে দিয়েছে, সে কথাই বোঝাচ্ছিলেন তিনি। সিরাজুল আলম খান চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে মত দিলেও তিনি তাদের বাইরে বাংলাদেশের সকল মানুষকে নিয়ে দেশগড়ার কথা বলছিলেন। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে বেশ তর্কই চলছিল। বাবা বলছিলেন জামায়াত-ই-ইসলামী নিষিদ্ধ করার কথা। এক পর্যায়ে সিসিইউতে পর্দার ওপাশে পাশের বিছানায় থাকা ভদ্রলোক বেশ বিরক্তিই প্রকাশ করলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ বলতে গেলে তেমন কিছুই জানে না- এ নিয়ে তাঁর মনে ক্ষোভ আছে বলে মনে হল। আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বলেন, "সিরাজ ভাই, নতুন প্রজন্ম জেগে উঠেছে। দেখবেন ঠিকই তারা সত্য অনুসন্ধান করবে, অজানা ইতিহাস বের করে আনবে।"

জবাবে সিরাজুল আলম খান যা বললেন, তা না-ই-বা বলি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠকের কাছ থেকে আরও মার্জিত মন্তব্য আশা করেছিলাম। বাবা ও আমি সেদিন ব্যথিত মনেই বাসায় ফিরেছিলাম।

সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে শুরুতেই এ আলোচনার প্রেক্ষাপটটি সম্প্রতি ২/৬/২০১৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদ রচিত "তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন" নামের একটি লেখা নিয়ে। গবেষণাধর্মী উপন্যাস 'ক্রাচের কর্নেল'-এর লেখক শাহাদুজ্জামান রচিত "তাহের ও জিয়া: বিপরীত স্রোতের যাত্রী" ও "তাহের ও জিয়ার সম্পর্কের পরিণতি" দুটি সাম্প্রতিক লেখার প্রতিক্রিয়ায় মহিউদ্দিন আহমদ তার লেখায় কর্নেল তাহেরকে ঘিরে বেশ কিছু ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি শাহাদুজ্জামানের ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানালেও তার অনুসৃত ইতিহাস নির্মাণের প্রক্রিয়াকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া লেখা থেকে মহিউদ্দিন আহমদকে সিরাজুল আলম খানের একজন একনিষ্ঠ 'এপোলোজিস্ট' বলেও মনে হয়েছে।

শুরুতেই মহিউদ্দিন আহমদ শাহাদুজ্জামানের লেখা সম্পর্কে বলেছেন, "[…] কারও কারও সঙ্গে আলাপ করে এবং ওই ধরনের আলাপচারিতা কিংবা সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করে কিংবা সূত্র ঘেঁটে হয়তো লেখাটি তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। ফলে সুলিখিত হওয়া সত্ত্বেও এটা ইতিহাস হয়ে উঠতে পারেনি।"

লেখকের কথায় অবাক না হয়ে পারি না। মনে প্রশ্ন জাগে, 'লেখক ও গবেষক' হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া মহিউদ্দিন আহমদ তাহলে কীভাবে 'ইতিহাস' রচনা করতে চান? বিনীতভাবেই তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই বিশ্বখ্যাত 'An Advanced History of India' বইটিতে আর সি মজুমদার, এইচ সি রায়চৌধুরী এবং কালিকিঙ্কর দত্ত ভারতের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আধুনিককালের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন গভীর গবেষণার মধ্য দিয়ে, অসংখ্য সূত্র ঘেঁটে।

সে অর্থে শাহাদুজ্জামানের 'ক্রাচের কর্নেল' ইতিহাসের বই না হলেও তিনি তা ব্যাপক শ্রম ও গবেষণার মাধ্যমেই লিখেছিলেন। তার প্রমাণ মেলে বইটির ৩৪৫-৩৫১ পৃষ্ঠাগুলোতে দেওয়া তথ্যসূত্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধ, কর্নেল তাহের এবং ৭ নভেম্বরের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, দেশে এবং বিদেশে প্রকাশিত বহু গ্রন্থ-দলিল এবং আরও অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি তথ্যসংগ্রহ করেন, যেগুলো তিনি তার পরবর্তী বিভিন্ন লেখায় উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

মহিউদ্দিন আহমদ হয়তো খেয়াল করেননি যে শাহাদুজ্জামানের মতো তিনিও নিজের লেখায় নানা ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনা তুলে ধরেছেন পাঠকদের সামনে। শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে পার্থক্য হল তিনি কোনো তথ্যসূত্র দেননি। তার উল্লিখিত সব ঘটনা তিনি স্বচক্ষেই দেখেছেন এমনটা নিশ্চয়ই দাবি করবেন না তিনি। যাই হোক, সেসব ঘটনার সূত্র মহিউদ্দিন আহমদ নিশ্চয়ই একদিন প্রকাশ করবেন।

মহিউদ্দিন আহমদ তার লেখায় বেশকিছু ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন। প্রথমে সেগুলোর উপরেই আলোকপাত করি। আহমদের দাবি অনুযায়ী: ১) গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ সাহজাহান; ২) ঢাকা শহর গণবাহিনীর 'রাজনৈতিক কমিশনার' ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক; ৩) বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রধান ছিলেন মেজর জলিল; ৪) তাহেরের ফাঁসির বিপক্ষে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন; এবং ৫) তাহেরের বিচার হয়েছিল ৭ নভেম্বর-পরবর্তী কার্যকলাপের জন্য।

পাঁচটি দাবিই ভুল। প্রথমত, মোহাম্মদ সাজাহানকে গণবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর। এর আগে তিনি গণবাহিনী সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, ঢাকা শহর গণবাহিনীর 'রাজনৈতিক কমিশনার' নয় বরং 'রাজনৈতিক কমিসার' ছিলেন কমরেড রফিক (ঢাকা শহর গণবাহিনীর কমাণ্ডার মো. আনোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)।

অন্যদিকে, আ ফ ম মাহবুবুল হক ছিলেন জাসদের ছাত্রনেতা এবং জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ৯ নভেম্বর একটি জনসভা ডাকা হয় বায়তুল মোকাররমে। জাসদের সেদিনকার জমায়েতে পুলিশ গুলি ছুঁড়ে এবং আ ফ ম মাহবুবুল হক গুলিবিদ্ধ হন (লিফসুলজ, ১৯৭৯, ৫০)।

তৃতীয়ত, মেজর জলিল ছিলেন জাসদের সভাপতি। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রধান ছিলেন কর্নেল তাহের (রনো, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৭৯-১৮০)। চতুর্থত, ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর মাওলানা ভাসানী একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়ে (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ১২৭)।

পঞ্চমত, ৭ নভেম্বর-পরবর্তী কার্যকলাপের জন্য তাহের এবং অন্যদের বিচার হয়েছিল কথাটি সম্পূর্ণভাবে ভুল। ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্টে তাহেরের পরিবার একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছিলন তাহেরের 'তথাকথিত' বিচারের প্রক্রিয়া ও দণ্ডাদেশ চ্যালেঞ্জ করে। ড. শাহদীন মালিক কয়েকমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে রিট পিটিশনটি লিখেছিলেন। লেখা ও গবেষণার কাজে আমি স্যারকে সহযোগিতা করেছিলাম।

সে গবেষণা থেকেই জানতে পারি যে ১৯৭৬ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার এফআইআর নং ৮-এ কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১-এ'র অধীনে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়। ৭ নভেম্বরের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার কারণেই তাহেরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে দেওয়া তাহেরের ঐতিহাসিক জবানবন্দিতেও একই চিত্র পাওয়া যায়।

মহিউদ্দিন আহমদ তার লেখায় তাহেরকে খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান এবং মঞ্জুরের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করে লিখেছেন: 'রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাঠামোর মধ্যে থেকে দেশ ও মানুষের সেবা করার ইচ্ছা তাঁদের কারোরই ছিল না'। রাজনৈতিক কাঠামো ও নেতৃত্বের উপর তাহেরের ছিল পূর্ণ আস্থা। বহু ঘটনার মাঝেই তার সত্যতা মেলে।

কেন্দ্রীয় গণবাহিনীর সেকন্ড-ইন-কমান্ড হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে ৭ নভেম্বরে ঢাকা শহর গণবাহিনীকে শুধুমাত্র সতর্ক রাখার নির্দেশ পাওয়ার ব্যাপারে মো. আনোয়ার হোসেনের ভাবনা জানা যাক। তিনি বলেন, "কেন এ নির্দেশ তিনি দিলেন তা আজও বড় রহস্য। তাঁর এ সিদ্ধান্তের কারণে শহর গণবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের পর্যন্ত অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছুই জানানো গেল না। আজ এটা অনেককে অবাক করবে। তারা বলবেন, আমার অগ্রজ কর্নেল তাহের যেখানে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন আমি শহর গণবাহিনীকে সক্রিয় করার জন্য ইনু ভাইয়ের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা কেন করলাম। এ প্রসঙ্গে বলি, কঠোর সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই আমরা কাজ করতাম। দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি ছিল সবার ওপরে। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে অভ্যুত্থানের ওপর সেই ৩ নভেম্বর থেকে আলোচনা চলছে। আমি সে কমিটির সদস্য নই। তাই সে আলোচনার বিষয়ে কিছুই জানি না। যদিও শহর গণবাহিনীর অধিনায়ক আমি। যেখানে সেনাছাউনি থেকে সৈন্যরা উর্দি পরেই বাইরে এসে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিটিং করছে; সেখানে রাজনীতিবিদরা কেন এমন কঠোর গোপনীয়তার বাতাবরণে নিজেদের এবং অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তকে ঢেকে রাখলেন তা বিস্ময়কর বৈকি" (২০১২, পৃষ্ঠা ৯২)।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তাহেরের অবিচল আস্থার কারণেই তিনি অভ্যুত্থানের হেডকোয়ার্টার ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রেখেছিলেন, এলিফ্যান্ট রোডে (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭)। সিরাজুল আলম খান ও জাসদ নেতৃত্বের উপর তাহেরের তখন গভীর আস্থা। তাকে জানানো হয়েছিল সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে গণবাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র করবে। তাছাড়া ছাত্ররা থাকবে প্রচারের দায়িত্বে এবং শ্রমিকরা নিয়ন্ত্রণ করবে ঢাকার রাজপথ (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৪)।

মহিউদ্দিন আহমদ ভেবে বলবেন, তাহের যদি সত্যিই রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থেকে 'দেশ ও মানুষের' সেবা করতে চাইতেন, তাহলে কেন তিনি ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে গেলেন? রাষ্ট্রপতিকে লেখা পদত্যাগের চিঠিতে তিনি কেন বললেন, "যদি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে সেনাবাহিনীর যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং সেনাবাহিনীতে আমার কাজ করা সম্ভব নয়। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের বলব কী ধরনের বিপদ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।" (জিয়াউল হক মুক্তা সম্পাদিত, শহীদ কর্নেল তাহের রচনা সংগ্রহ- ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩৭)

পদত্যাগের পর তাহের যোগদান করেন জাসদে। জাসদ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই তিনি সেনাবাহিনীর বাইরে বিপ্লবী গণবাহিনী এবং ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সংগঠিত করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আস্থা না থাকলে কি তাহের এ বিপ্লবী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতেন? এ বিষয়ে কী জবাব দেবেন মহিউদ্দিন আহমদ?

মহিউদ্দিন আহমদের মতে উপরোল্লিখিত সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতেন তাহের। আহমদ মিথ্যা বলছেন অথবা না জেনে কথা বলছেন। কারণ সেক্টর কমাণ্ডারদের মধ্যে একমাত্র কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুর সত্যিকার সুহৃদ হিসেবে তাঁকে সাবধান করেছিলেন সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে সৃষ্ট ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। অথচ অন্যদের অনেকেই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অমিল থাকা সত্ত্বেও তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল। বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে:

১) ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে কোয়েটা অফিসার্স ক্লাবে সন্ধায় জনৈক পাঞ্জাবি অফিসার মন্তব্য করেন: "Mujib is a traitor"। উত্তেজিত তাহের তার কলার চেপে ধরেন এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই "সরকারি নীতি ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করা এবং ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক অফিসারকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে কোয়েটা ছেড়ে নিজ ইউনিটে না যাওয়ার নির্দেশ' প্রদান করা হয় এবং নজরবন্দী রাখা হয় তাহেরকে (মুক্তা সম্পাদিত, শহীদ কর্নেল তাহের রচনা সংগ্রহ – ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে, পৃষ্ঠা ৫)।

২) বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই এবং তাহেরই তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে তা অবহিত করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে কর্নেল তাহেরের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের একটি অন্যতম কারণ ছিল যে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া।

এ প্রসঙ্গে তাহেরের বক্তব্য পাওয়া যায় তাঁর পদত্যাগ করার চিঠিতে: "প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য আমি বিদেশে যাই। যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম তখন আমি জানতে পারি যে মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতির সুযোগে দেশের ক্ষমতাগ্রহণের চেষ্টা করছে (সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন)।

আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশে গমন স্থগিত রাখা উচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলই না, উপরন্তু সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪ নং ব্রিগেডের কমান্ড ত্যাগ করে ডিডিপি [ডাইরেক্টর ডিফেন্স পারচেস] হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। […]" (মুক্তা সম্পাদিত, শহীদ কর্নেল তাহের রচনা সংগ্রহ – ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৬)।

৩) বঙ্গবন্ধু তাহেরকে স্নেহ করতেন বলেই তিনি আন্তরিকভাবে চাইতেন তাহের যেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে একপা-হারানো তাহেরের সুবিধার্থে বঙ্গবন্ধু তাহেরের জন্য একটি অটোম্যাটিক মোটরগাড়ি প্রদান করতে চেয়েছিলেন। তাহের বিনীতভাবেই বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন সে গাড়ির জন্য মঞ্জুরকৃত অর্থ যেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে ব্যবহার করা হয় (সেনাবাহিনী থেকে তাহেরের পদত্যাগের চিঠি এবং মো. আনোয়ার হোসেন এর সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)।

৪) প্রয়াত শেখ কামালের বিয়েতে বঙ্গবন্ধু নিজে তাহেরকে ফোন করে দাওয়াত দেন। তাহেরের বাসায় তাঁর অনুজ মো. আনোয়ার হোসেন ফোনটি প্রথমে রিসিভ করেছিলেন। শেখ কামালের বিয়েতে তাহের উপস্থিত ছিলেন।

৫) বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর তাহেরকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখান করেন। এর পরপরই তাহেরকে হয়রানির উদ্দেশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনতে শুরু করে তৎকালীন মোশতাক সরকার। এক পর্যায়ে বিশ্বাসঘাতক মোশতাক তাহেরের সঙ্গে বৈঠককালে বারবার বঙ্গবন্ধুকে শুধু 'শেখ মুজিব' বলে সম্বোধন করছিলেন। তাহের তখন মোশতাককে বলেছিলেন, "মুজিব নয়, বলুন বঙ্গবন্ধু" (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৩)।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আজ যেই পারস্পরিক সম্মান ও সৌজন্যবোধ অনুপস্থিত, তা প্রবলভাবেই উপস্থিত ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাহেরের মধ্যে।

মহিউদ্দিন আহমদ তার লেখায় বলেছেন, তাহের নাকি জোর করে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংগঠনের দায়িত্ব জাসদ নেতৃবৃন্দের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, "জাসদ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ছিল ১০ নভেম্বর হরতাল হবে, ১০ লাখ ছাত্র-শ্রমিকের সমাবেশ ঘটিয়ে একটা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করা হবে।"

চাঞ্চল্যকর এ তথ্যটি নতুন। গত ৩৮ বছরে তাহেরের প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনলেও এমনটি কখনও করেনি। আহমদের এ দাবিটিই পর্যালোচনা করা যাক। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু হলে জাসদ নেতৃবৃন্দ ৪ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। সে পরিকল্পনার প্রেক্ষিতেই জাসদ ১০ নভেম্বরে নয় বরং ৯ নভেম্বরে হরতাল ডেকেছিল।

মো. আনোয়ার হোসেন ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, "নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা ছিল ওই হরতালের মধ্য দিয়ে তাঁরা ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্টকে রাজপথে সংগঠিত করতে পারবেন। ৫ নভেম্বর সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি লিফলেট বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয় এ লিফলেটের মাধ্যমে আসন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া যাচাই করা হবে। অভ্যুত্থানে নেমে পড়ার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রচণ্ড তাগিদকে কিছুটা প্রলম্বিত করার জন্যও লিফলেট বিতরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। […] ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের হাবিলদার বারী ওই লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন (২০১২, পৃষ্ঠা ৮৯)। বিপ্লবী আহ্বানের বার্তা বহন করা সে লিফলেটের প্রতিক্রিয়া জওয়ানদের মাঝে ছিল ব্যাপক এবং তাৎক্ষণিক। ৬ নভেম্বর রাতেই সৈনিকরা অভুত্থান করবে বলে জানিয়ে দেয় (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৯০)। তাহের চেয়েছিলেন অভুত্থানে অংশ নিয়ে তার মোড় নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল। তাহের ভেবেছিলেন ৭ নভেম্বরের জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলে পরবর্তীতে ভবিষ্যতে আরও পুনর্গঠিত শক্তিশালী বুর্জোয়া শক্তির মুখোমুখি হতে হবে (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৮)।

এ প্রেক্ষিতেই কর্নেল তাহের জাসদ নেতৃবৃন্দকে অনিবার্য অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানান। মহিউদ্দিন আহমদ দাবি করছেন তাহের নাকি লেনিনীয় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, 'সিক্সথ উইল বি টু আর্লি, এইটথ উইল বি টু লেট। টুনাইট অর নেভার।'

যদি তাহের তা বলেও থাকেন, আশা করি পাঠক এবং একই সঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদও উপলব্ধি করতে পারবেন কেন তিনি তা বলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করতে জাসদ নেতৃবৃন্দের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।

ফলে মো আনোয়ার হোসেনের ভাষায়: "যথেষ্ট বিতর্কের পর মূখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান একটি বিপ্লবী উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষেই মতামত দেন এবং সে ভিত্তিতে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়" (২০১২, পৃষ্ঠা ৮৮)।

লিফৎসুলজ ও রনোর বইতেও একই চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। শাহাদুজ্জামানের 'ক্রাচের কর্নেল' বইয়েও এমনভাবেই বলা আছে। তাহের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান জাসদ নেতৃবৃন্দের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, মহিউদ্দিন আহমদের এমন কথা স্বকল্পিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়।

তাহেরের নেতৃত্বে 'সামরিক মাত্রা'টি সফল হয়, কিন্তু 'বেসামরিক মাত্রা'টি ব্যর্থ হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান- শাহাদুজ্জামানের এমন মন্তব্যের সূত্র ধরে লেখক ধরেই নিয়েছেন যে এর মাধ্যমে তাহেরকে মহিমান্বিত করা হয়েছে আর সিরাজুল আলম খানকে দেওয়া হয়েছে খলনায়কের স্থান।

তার ধারণা ভুল। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে জাসদের অভ্যুত্থানি প্রচেষ্টার বেসামরিক অংশে যে ঘাটতি ছিল তা আরও অন্তত দুটি বইতে বলা হয়েছে। হায়দার আকবর খান রনো রচিত 'মার্ক্সবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম' বইতে তিনি বলেন, "[…] উচিত ছিল সিপাহীদের রাজপথে বের করে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার সংগঠিত গরীব মানুষকে রাজপথে সমবেত করা। তাহলে অত সহজে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব হাত ফসকে গিয়ে জিয়া-মোশতাক প্রমুখের হাতে চলে যেত না। কিন্তু জনগণকে সংগঠিত করার দিকটি বাদ দিয়ে সবকিছু স্বতঃস্ফুর্ততার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল" (১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৯৫)।

একই চিত্র আমরা পেয়েছি তাহেরের অনুজ মো. আনোয়ার হোসেন রচিত 'মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের' বইতে (২০১২, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪)। ঢাকা শহরে জাসদের রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, "তেজগাঁও ও পোস্তগোলা শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের ভালো সাংগঠনিক অবস্থা। প্রয়োজনে স্বল্প নোটিশে আদমজী থেকে হাজার হাজার শ্রমিককে ঢাকার রাস্তায় নামানোর ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের আত্মপ্রত্যয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থান। ঢাকায় গণবাহিনীর প্রায় ছয়শত প্রশিক্ষিত সদস্য। উন্মুক্ত রাজনীতির অনুপস্থিতিতে সে হিসেবে ঢাকায় জাসদের সম্মিলিত শক্তি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ছিল না। সেনাঅভ্যুত্থানে আপন দায়িত্ব বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে তাহেরের কোনো দ্বিধা ছিল না। তাহেরকে অভ্যুত্থানে এগিয়ে দিয়ে গণসংগঠনগুলোকে কেন পেছনে টেনে রাখা হল, সেটা আজও একটা বড় প্রশ্ন (২০১২, পৃষ্ঠা ৯৩)।

তৎকালীন ঢাকা শহর গণবাহিনীর কমান্ডার মো. আনোয়ার হোসেন কেন্দ্রীয় গণবাহিনীর সেকন্ড-ইন-কমান্ড হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে সদস্যদের সক্রিয় করার নির্দেশ চাইলে বলা হয় তাদের সতর্ক রাখতে, তবে আপাতত তাদের অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন নেই (২০১২, পৃষ্ঠা ৯২)।

অন্তত এ দুটি বই থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে ৭ নভেম্বর রাতে জাসদের ক্যান্টনমেন্টের বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছিল এবং তার ফলশ্রুতিতেই অভ্যুত্থানের 'বেসামরিক মাত্রা'টি ব্যর্থ হয়। তবে তাহেরের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের সামরিক দিকটি সফল হয়েছিল, এমন দাবি অনেকটাই সঠিক হলেও পুরোপুরিভাবে হয়তো নয়।

তাহেরের অনুগত সৈন্যরা জিয়াকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন ঠিকই তবে তারা জিয়ার চাতুর্যের কারণে তাকে পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এলিফ্যান্ট রোডে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হন। এ ব্যর্থতার দায় তাহেরের উপর নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও বর্তায়। অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে তাহের এ গুরুতর ভুল সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

জিয়াকে আনা সম্ভব হয়নি শুনে তাহের একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, "আমরা হেরে গেছি" (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৪)। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে জাসদের রাজনৈতিক শক্তির অধীনে রেখে জিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন তাহের। জিয়াকে বেসামরিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে নিয়ে আসতে না পারার ভুল শুধরাতে তাহের চেষ্টার ত্রুটি করেননি। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানী সৈন্যদের ১২ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থেকে জিয়া যাতে সরে আসতে না পারেন তাই ওই রাতেই তিনি জিয়াকে রাজি করিয়েছিলেন ৭ নভেম্বর সকাল দশটায় শহীদ মিনারে একটি জনসমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য।

পরদিন সকালে সে অঙ্গীকার থেকেও জিয়া সরে আসেন এ কথা বলে যে তিনি একজন সৈনিক। তার গণজমায়েতে বক্তৃতা দেওয়া সাজে না। ততক্ষণে পাকিস্তান-ফেরত অফিসার পরিবেষ্টিত জিয়া আরও অনেক বেশি সুসংগঠিত। এর ফলেই ক্ষমতার কেন্দ্র ক্যান্টনমেন্টেই রয়ে যায় এবং জাসদের বিপ্লবী প্রচেষ্টা তার গতি হারিয়ে ফেলে।

মহিউদ্দিন আহমদ নয়, আমরা সিরাজুল আলম খানের কাছ থেকে এ সব বিষয়ে জানতে চাই। শ্রদ্ধেয় সিরাজুল আলম খান, আপনার বক্তব্য নিঃসন্দেহে জাসদ ও ৭ নভেম্বরের ইতিহাসকে সম্মৃদ্ধ করবে। আপনার অনুধাবন করতে হবে যে, ৭ নভেম্বরে আপনার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমরা তাহের এবং আপনাকে মুখোমুখী দাঁড় করাচ্ছি না বরং '৭ নভেম্বরকে সঠিকভাবে জানতে চাচ্ছি। মহিউদ্দিন আহমদের মতে তাহেরহত্যার বিচারের দায় সিরাজুল আলম খানকে এখনও একাকী বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খানকে উদ্দেশ্য করে বলব- আপনাকে কেউই একাকী এ দায় বহন করতে বলেনি। আপনি স্ব-আরোপিত রহস্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসুন। আমরা জানতে চাই 'নিউক্লিয়াস' জন্মের কাহিনী। ফেসবুকে আমরা আপনার মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু বিরল ছবি দেখেছি। মুজিববাহিনীর গঠনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানান। আমরা জানতে চাই জাসদ গঠনের নেপথ্যের ইতিহাস।

এত দ্রুত বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতায় নেমে পড়া কতটুকু ন্যয্য বা সময়োপযোগী ছিল? 'বাংলার বাণী' পত্রিকার সহকারী সম্পাদক জাহানারা বেগমের বাসায় আপনার এবং শেখ মণির সিরিজ বৈঠক হয়েছিল। গোপন সে বৈঠকগুলোতে শেখ মণি আপনাকে নীতিগতভাবে রাজি করিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের (বাকশাল) মাঝে জাসদকে নিয়ে আসার (রাজ্জাক, ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৩)।

শেখ মনি আজ জীবিত নেই। আপনাদের সে আলোচনার কথা তুলে ধরা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। তাহেরের ফাঁসির পর, কেনই বা আপনি জেনারেল জিয়া'র কাছে মুচলেকা দিয়ে আপনার এবং অন্যান্য জাসদ নেতৃবৃন্দের মুক্তিকে ত্বরান্নিত করেছিলেন (হোসেন, ২০১২, পৃষ্ঠা ১২৯)? "আমরা পোশাক পরিবর্তন করতে পারি" এবং "বিপ্লবীরা শুধু নিচ থেকে নয়, ওপর থেকেও আন্দোলন করে" এমন সব ভ্রান্ত ও সুবিধাবাদী তত্ব দিয়ে আপনি রাজশাহী জেল হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সে সময়ে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ এবং জাসদের জিয়াবিরোধী ১০ দলীয় ঐক্যজোট গঠনপ্রক্রিয়া নষ্ট করেছিলেন। কিন্তু কেন? আমরা জানার অপেক্ষায় আছি।

লেখার প্রারম্ভেই বলেছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ও অবদানের জন্য ইতিহাসে তার জন্য নির্ধারিত উচ্চস্থানে আসীন হতে পারেননি বলে তার মাঝে কিছুটা ক্ষোভ লক্ষ্য করেছি। কেন তিনি সে আসনে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও আসীন হতে পারেননি সে বিষয়ে সিরাজুল আলম খানের আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ বা কর্নেল তাহেরের মতো আপনি সমগ্র জনতার মাঝে প্রকাশিত হতে পারেননি তাহের হত্যাকাণ্ডের পর আপনার নিজের রাজনৈতিক পথভ্রষ্টতার এবং সামরিক শাসকদের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তির কারণেই।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে 'অপারেশন সার্চলাইট' সংক্রান্ত দলিল থেকে আমরা জানতে পারি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ব্যক্তির অবস্থান জানার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। সে ১৬ ব্যক্তির তালিকায় আপনার অবস্থান ছিল ৫ নম্বরে- বঙ্গবন্ধু, নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ এবং কর্নেল ওসমানীর নামের পরেই (রাজা ২০১২, পৃষ্ঠা ১১৭)। শুধুমাত্র এ তথ্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধে আপনার গুরুত্ব বোঝা যায়। আমরা নতুন প্রজন্ম সত্যানুসন্ধান করব। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আপনার যথাযোগ্য স্থান কেউ মুছে দিতে পারবে না।

তাহেরের শেষ চিঠির কিছু কথা বলেই আজকে লেখা শেষ করি। তাহের বলেন: "আমি মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না কিন্তু বিশ্বাসঘাতক, চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান ও অন্যান্যদের বলবে সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে যদি তারা ব্যর্থ হন, ইতিহাস তাদেরকে ক্ষমা করবে না" (মুক্তা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৫৬)।

নিরবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ ও চেষ্টায় আমরা মহামান্য হাইকোর্ট থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ রায় পেয়েছি কিছুদিন আগে। বাংলাদেশের মানুষ আজ নিশ্চিত জানতে পেরেছে তাহেরকে ঠাণ্ডামাথায় খুন করেছিলেন জিয়া একটি প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে। শুধুমাত্র বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদের বইয়ের সূত্র থেকে নয়, বরং আরও বেশকিছু জায়গা থেকে তা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়েছে।

তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বঙ্গভবনের বাসিন্দা সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার বলেন: "কিন্তু ফাঁসির পূর্বে কর্নেল তাহেরকে নিয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের সম্মুখভাগে প্রেসিডেন্ট তথা সিএমএলএ-র অফিস হলেও পেছনের দিকে একতলায় জেনারেল জিয়া বসতেন। কর্নেল তাহেরের বিচারকার্য চলার সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার প্রায়ই দেখা করতেন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে। দীর্ঘ সময় ধরে দু'জনে আলোচনা হত। এমতাবস্থায় কর্নেল তাহেরের শাস্তি একরকম অবধারিত ছিল" (২০০৫, পৃষ্ঠা ১৭৩)।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে যারা কর্নেল তাহেরের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী তারা এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করবেন: জিয়া কেন এমনটা করতে গিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে পা-হারানো তাহের জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য কেন এবং কীভাবে এমন প্রচণ্ড হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন?

মহিউদ্দিন আহমদ, আপনি সিরাজুল আলম খানকে জানান ইতিহাসের দায় তাঁর একা বহন করার প্রয়োজন ছিল না। আপনার লেখা বহু ভুল তথ্য ও অসঙ্গতিতে ভরা যা উল্লেখ করেছি। অনুরোধ করব অনুপ্রেরণায় ঘাটতি থাকলে তাহেরের শেষ চিঠিটি আবারও পড়ুন। বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্গঠনে নতুন প্রজন্মের প্রচেষ্টাকে মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের কথা সম্মৃদ্ধ করবে।

তা তুলে ধরতে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।