জাতীয় বাজেট : সম্ভব নয় অর্থায়ন

এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম
Published : 8 June 2013, 12:35 PM
Updated : 8 June 2013, 12:35 PM

২০১৩-১৪ সালের বাজেটের আকার ও বরাদ্দ-সংক্রান্ত তথ্য বাজেট পেশের আগেই কিছু কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তা থেকে কিছু কিছু পূর্বানুমান করা যাচ্ছিল। এবারের বাজেট হবে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার। বাজেটে রাজস্ব আয় নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি হবে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। ৬ জুন জাতীয় সংসদে এ বাজেট পেশের পর এ নিয়ে নানাভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে। একজন বিশ্লেষক হিসেবে আমার কয়েকটি প্রশ্ন রয়েছে।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেটের যে আকার ধরা হচ্ছে সে আকারের জন্য অর্থায়ন কীভাবে হবে সেটির নির্দেশ সরকার দিয়েছেন, কিন্তু যে সব সূত্র থেকে তা হবে বলে ধরা হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এর মধ্যে একটি হল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর-রাজস্ব, এর টার্গেট যেমন ধরা হয়েছে একলাখ ছত্রিশ হাজার ৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের টার্গেটের চেয়ে এটি প্রায় বিশ শতাংশের মতো বেশি। চলমান অর্থবছরে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হচ্ছে। যেহেতু সার্বিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থার তেমন উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না তাতে এ টার্গেট পূরণ সম্ভব নয়।

অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের যে পরিমাণ ধরা হয়েছে, প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেটিও অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ বছরের হিসেব যদি দেখি, মার্চ পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ১.১ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। অথচ এ বছরের টার্গেট ছিল ২.৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তার মানে অর্ধেকেরও কম অর্জিত হয়েছে। যেখানে এ বছরের টার্গেটের অর্ধেকও অর্জিত হয়নি সেখানে আগামী বছরে আরও বড় টার্গেট দেওয়া হচ্ছে- তার মানে এবার ন' মাসে যা পাওয়া গেছে তার তিনগুণেরও বেশি- সেটি অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।

আরেকটি উৎস হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ। এর একটি অংশ আসে ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ থেকে। এ ঋণের বড় অংশ আবার আসে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। এ বিক্রির টার্গেট ছিল গত অর্থবছরে ৭,৪০০ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত নেট বিক্রি ছিল ৭০০ কোটি টাকারও নিচে। মানে মাত্র এক-দশমাংশেরও কম অর্জিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এটা পাঁচ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এটাও অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।

কাজেই যদি এ সব সূত্র থেকে অর্থায়ন না হয় তাহলে সরকারকে দুটো পন্থার যে কোনো একটি অবলম্বন করতে হবে। একটি হল, খরচের মাত্রা কমাতে হবে। অন্যটি হল, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ বেশি নিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে এটা বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাতে আবার প্রবৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়। কারণ আমাদের দেশে বিনিয়োগের সিংহভাগ বেসরকারি খাত থেকে আসে।

আরেকটি সুযোগ যেটি থাকবে সেটি হল খরচ কমানো। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেটের বেলায় খুব বেশি খরচ কমানোর সুযোগ নেই্। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনভাতা তো সরকারকে দিতেই হবে। অতীতে সরকারগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে যে সব ঋণ করেছে তার সুদও আইনত পরিশোধ করতে সরকার বাধ্য। শুধুমাত্র ভর্তুকি খাতে সরকার খরচ কিছুটা কমাতে পারে। কিন্তু এটা নির্বাচনের বছর। তাই এ খাতে সরকার এখন খরচ কমাতে পারবে না।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ কমানো যেতে পারত। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সেখানটায় বরাদ্দ কমছে। চলতি অর্থবছরে এটা ২০০ কোটি টাকা বাড়ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে তাতে যদি এবারের বরাদ্দকে মূল্যস্ফীতি দিয়ে ভাগ করা হয়, তরে রিয়েল টার্মসে বরাদ্দ কমছে বলতে হবে। কাজেই এখানে অন্তত টাকার অংকে লাভবান হওয়া যাবে না।

তাহলে চাপটা পড়বে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর। এডিপি কাটছাঁট করা মানে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আমাদের দেশে এখনও উন্নয়ন খাতে সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর ফলে ভবিষতে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর যে ভিত্তি তাকে শক্তিশালী করা যাবে না।

একটা বিষয় থাকে, এডিপিতে অনেক প্রকল্প কম প্রাধিকারপ্রাপ্ত অথবা অপ্রয়োজনীয়। সেগুলো বাদ দিয়ে যদি কাটছাঁট করা হয় তাহলে খুব একট অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। কিন্তু আমাদের দেশে ওইভাবে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। এর বদলে এডহক ভিত্তিতে এখান থেকে একটু ওখান থেকে আরেকটু এভাবে কাটা হয়।

যার ফলে সার্বিকভাবে এটা খুব একটা ইতিবাচক কিছু হবে না। এডিপি বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারছে না। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৫ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিক এডিপিতে ধরা হয় ৫২ হাজার কোটি টাকার মতো। তবে আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত খরচ হবে ৪৫-৪৬ হাজার কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারিত ছিল। বিভিন্ন দাতা সংস্থা বলেছে. এটা ৬ শতাংশের কম হবে। সরকারের যে ডেসিগনেটেড কর্তৃপক্ষ, ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস, তারা বলেছে ৬.০৩। তার মানে ৬ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে. প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশের কম হবে না।

কিন্তু আমি যদি কয়েকটি সূচক দেখি তাহলে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। যেমন, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে যেটি বিনিয়োগের সিংহভাগ; মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে; বেসরকারি খাতের ব্যাংকঋণের প্রবাহও কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে এ সূচকগুলো এটাই নির্দেশ করে যে, বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকাংমে বিঘ্নিত হচ্ছে। ৬.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সেটা কিন্তু টার্গেট ৭.২ এর চেয়ে অনেক কম।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি আবার সেই ৭.২ শতাংশ ধরা হয়েছে। একে আমার কাছে সম্পূর্ণ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। দেশে এখন বিনিয়োগের যে পরিবেশ চলছে তাতে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময়; হরতাল, সহিংসতা ইত্যাদি চলছে। আগে এসব হত শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক; এখন এটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। দেখা গেছে প্রতিদিনই চারটি বা পাঁচটি জেলায় হরতাল চলছে এবং সেখানে অনিবার্য সংঘাত হচ্ছে।

ডিসেম্বর –জানুয়ারির দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ বাজেট তো এ বছরের জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত চলবে। এ পরিস্থিতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকলে পুরো অর্থবছরই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ওদিকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা উন্নত হচ্ছে না। এসব দিক বিবেচনায় ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ অবশ্যই অবাস্তব একটি পদক্ষেপ।

রাজহনৈতিক বিবেচনায় এসব করা হলেও আমি বুঝতে করি না যে রাজনৈতিক সরকারগুলো এর সুফল কতটা পায়। সবসময় একটি উচ্চাভিলাষী চিন্তা থেকে বাজেট করা হয়। তারপর সেটি বাস্তবায়ন হয় না। অনেকে বলেন যে, উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করাই ভালো, তাতে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে একটি গতিশীলতা আসবে। কিন্তু গতিশীলতা না থাকার পেছনে আরও অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। তাই এভাবে গতিশীলতা বাড়ানোর চিন্তা আসলে একটি অবাস্তব চিন্তা।

রিজার্ভ বাড়ছে, তবে এর একটি অংশ ইতিবাচক কারণে, আরেকটি অংশ নেতিবাচক কারণে। ইতিবাচক কারণটি হল আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ এখনও ভালো। রপ্তানি-প্রবৃদ্ধিকে অনেকে সন্তোষজনক বলেন্। তবে আমি বলব যে, বছরের শেষে গিয়ে এটি ইতিবাচক থাকবে না, আবার খুব একটা নেতিবাচকও হবে না।

নেতিবাচক যে দিকটা সেটি হল, রিজার্ভ বাড়ার পেছনে বড় কারন আমদানির মাত্রা কমে যাওয়া। সার্বিকভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও প্রকল্প আমদানি কমে গেছে। আমাদের দেশে আমদানির সিংহভাগ এগুলো। আর এসব কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কোনো চিহ্ন বহন করে না। তার মানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে বা উৎপাদন ক্ষমতা যে পরিমাণ আছে তার ব্যবহার হচ্ছে না বলে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে না।

কৃষিতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ পর্যায়ে এটি একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত কিনা এ ব্যাপারে আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এমনিতেই কৃষকরা অভিযোগ করছেন যে. কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধান উৎপাদনে তাদের যে খরচ পড়ছে বাজারে সে তুলনায় কম দাম পাচ্ছেন। এখন ধান উৎপাদনে এখন অনেকই উৎসাহিত হচ্ছেন না। এ জন্যই কৃষিখাতে ভর্তুকি কমানো হলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা, বাজেটের যে আকার তার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার হিসেব করা হয়েছে। এর মাত্রা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। সরকার ঋণ করলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে দুদিক থেকে। একদিকে চাহিদা বেড়ে যায়্ অন্যদিকে বেসরকারি খাতের উৎপাদন ও ঋণের প্রবাহ কমে যায়। কাজেই সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আশেপাশের কিছু দেশের চেয়ে ভালো, তবে তার মানে এ নয় যে আমরা প্রবৃদ্ধিতে পৃথিবীতে পঞ্চম স্থানে রয়েছি। এটা ভুল কথা। আমি একটি পরিসংখ্যানে দেখেছি, এশিয়া-প্যাসিফিকের ৩৯ দেশের মধ্যে প্রায় চৌদ্দোটি দেশ প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তবুও ৫.৭ বা ৫.৮ কি ৯ যথেষ্ট ভালো একটি প্রবৃদ্ধি।

কিন্তু এখানে দুটো বিষয় মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, এর ফলে আমরা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে টার্গেট করেছি সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। তাতে করে আবার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত করার যে টার্গেট থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশে যথার্থ বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতাম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে ও প্রশাসনের দক্ষতা বাড়িয়ে দিয়ে প্রবৃদ্ধি এখন যা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হত।

ড. এ বি মির্জা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম : সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।