গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও তার সমর্থকরা ইসলামের প্রতিনিধি নয়

শারমিন আহমদ
Published : 21 May 2013, 11:06 AM
Updated : 21 May 2013, 11:06 AM

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। আমাদের পাঠ্যসূচির বাংলা দ্রুতপঠনের নাম ছিল 'এ নহে কাহিনী'। বছরের শুরুতে নতুন বইয়ের কেমন এক মনকাড়া ঘ্রাণ নিতে নিতে, ক্লাসবিরতির ফাঁকে ফাঁকে আমি একটানে পুরো বইটি পড়ে শেষ করি। বইটির একটি গল্প বিশেষ করে আমার মন ছুঁয়ে যায়। গল্পটি ছিল ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের দখল থেকে (১১৮৭) জেরুজালেম পুনরায় মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা কুর্দি-বংশোদ্ভূত সেনাপতি ও সুলতান সালাহউদ্দীনকে (সালাহ আল দীন ইউসুফ ইবন আইয়ুব) কেন্দ্র করে।

গল্পটিতে ছিল তিনি কেমন করে চিকিৎসকের ছদ্মবেশে, যুদ্ধের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া তার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ডের ('রিচার্ড দি লায়ন হার্ট' নামে খ্যাত) তাঁবুতে গিয়ে তাকে সেবা করেছিলেন; লড়াইক্ষেত্রে রাজা রিচার্ডের তরবারি পড়ে গেলে তিনি লড়াই থামিয়ে নিজ তরবারি এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং কী করে তিনি মানবিক আচরণ দিয়ে ভিন্নধর্ম ও শত্রুপক্ষের মন জয় করেছিলেন।

ইতিহাস প্রমাণ করে না যে, প্রতিপক্ষ সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে রাজা রিচার্ডের সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে উল্লিখিত সে সালাহউদ্দীন অসুস্থ রাজার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক পাঠিয়েছিলেন, উপহারস্বরূপ নানাবিধ ফল ও যুদ্ধে রাজার ঘোড়া নিহত হলে তার পরিবর্তে দুটি তেজী ঘোড়াও দিয়েছিলেন। সালাহউদ্দীনের কাছ থেকে জেরুজালেম ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেও, রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন (১১৯৩) সালাহউদ্দীনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিয়ে।

জাত্যভিমানী ইউরোপের ইতিহাসে এ অশ্বেতাঙ্গ ভিন্নধর্মীয় সেনাপতি স্বর্ণাক্ষরে স্থান পেয়েছিলেন 'সালাদিন দি গ্রেট' নামে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট তার 'স্টোরি অব সিভিলাইজেশন' ইতিহাস সিরিজের 'এইজ অব ফেইথ' গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন যে এ ধর্মপরায়ণ মুসলিম সেনাপতির উদার ও মানবিক আচরণ ইউরোপকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে চার্চের ধর্মযাজকরা, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তাদের কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন যে ওই ধর্মে কী করে এত মহৎ মানুষ জন্মাতে পারে। তারা সালাহউদ্দীনের কাছ থেকে আশা করেছিলেন প্রতিশোধ, জুলুম ও নির্যাতন।

১০৯৯ সালে পোপের নির্দেশে ইউরোপীয় নাইট ও সেনাবাহিনী যখন জেরুজালেম আক্রমণ করে তখন মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যে সত্তর হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু যার মধ্যে ছিল আরবের ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম জনগণ, তাদের হাতে প্রাণ হারায়। ক্রুসেডারদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে তাদের হাতে নিহতদের রক্ত এতই প্রবাহিত হয়েছিল যে রক্তের নদী পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত উঠে এসেছিল।

রসুল হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর শান্তিপূর্ণভাবে মক্কাজয়ের আদর্শ অনুসরণকারী সালাহউদ্দীন ৮৮ বছর পর জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে ওই নগরীর সকল নাগরিককে নিরাপত্তা প্রদান করেন। জেরুজালেমের প্রায় একলাখ নাগরিক যার অধিকাংশ ছিল ইউরোপীয় খ্রিস্টান-বংশোদ্ভূত, তাদের জানমাল তিনি রক্ষা করেন। তারা জেরুজালেম ছেড়ে যেতে চাইলে তাদের ধনসম্পদসহ নগরী ত্যাগের ব্যবস্থা করে দেন। কারও পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে তিনি নিজ খরচে বিশেষত নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেন।

সে যুগে জেনেভা কনভেনশনের যুদ্ধ-নীতিমালা ছিল না, কিন্ত ইসলাম ধর্মের অনুসারী সালাহউদ্দীন অনুসরণ করেছিলেন এমন এক মানবিক নীতিমালা যা সকলের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিল।

তার মৃত্যুর দু শ বছর পরও ইউরোপে তাকে নিয়ে রচিত হত বিভিন্ন বীরগাঁথা। কবি দান্তের 'ডিভাইন কমেডি' মহাকাব্যে তিনি উল্লিখিত হন 'পূণ্যবান বিধর্মী' হিসেবে। পঞ্চান্ন বছর বয়সী এ সেনাপতি মৃত্যুর আগে তার পুত্রকে উপদেশ দিয়ে এক অসামান্য চিঠি লিখেন যা উইল ডুরান্ট তার বইয়ে উল্লেখ করেন। চিঠির নির্যাস হল যে জোরজুলুম খাটিয়ে মানুষকে কখনও-ই জয় করা যায় না। মানুষের মন জয় করতে হয় দয়া দিয়ে এবং সেটিই শ্রেষ্ঠতম বিজয়।

আজকের বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের রক্ষাকারী দাবিদার দল ও তার সমর্থকদের ধর্মীয় উন্মাদনা, সহিংসতা, সাধারণ মানুষের জানমাল ধ্বংস ও তাদের একদেশদর্শী ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও কথাবার্তার প্রেক্ষিতে জেরুজালেম-বিজয়ী সালাহউদ্দীনের উপমা টানলাম। ইসলাম ধর্মের অনুসারী দাবিদার ১৯৭১ সালের গণহত্যাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াত-এ-ইসলাম দলের মূখ্য নেতৃবৃন্দ যখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারাধীন এবং তাদের কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, ঠিক সে পর্বটিতেই আকস্মিক ও নাটকীয়ভাবে ইসলাম ধর্মরক্ষার্থে ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যে নতুন দলটির আবির্ভাব, ৬ এপ্রিল, ঢাকার রাজপথে।

নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ড (এ প্রসঙ্গে পরবর্তী লেখায় আলোচনার আশা রাখি) পাবলিক প্লেসে প্রদর্শিত মূর্তি ধ্বংসের দাবি, জনসমক্ষে নারী-পুরুষের মেলামেশা ও মোমবাতি প্রজ্জলন নিষিদ্ধ এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবি নিয়ে যারা সোচ্চার, তাদের দাবির মধ্যে কিন্তু একবারও বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে ছেয়ে যাওয়া দুর্নীতি, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ভূমিদস্যু, মজুতদার-কালোবাজারীদের দৌরাত্ম্য, ক্রমবর্ধমান শিশু ও নারীধর্ষণ (ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ড দাবি হত যথার্থ), জননিরাপত্তার অভাব, খাদ্যে ভেজাল, ইত্যাদি গুরুতর সমস্যাবলী উল্লিখিত হয়নি।

এমনকি ২৪ এপ্রিল, সাভারের রানা প্লাজায়, ১২০০ উর্ধ্ব শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকদের সমুচিত শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি যেমন উত্থাপিত হয়নি তাদের ৫ মের বিক্ষোভে, তেমনি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া অভাগা শ্রমিকদের উদ্ধারকাজেও তাদের লক্ষাধিক সমর্থককে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। তাহলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে যে উল্লিখিত জনহিতকর কর্মকাণ্ড তারা ইসলামরক্ষার অংশ বলে মনে করেন না।

তারা যে দাবিগুলো নিয়ে হত্যা ও নিরীহ জনগণের ব্যাপক মালামাল ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, সেগুলো তাদের নাম দিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা করেছে বলে তাদের নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন। কোরআনে উল্লিখিত, ''একজনকে যে হত্যা করল সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল এবং একজনকে যে রক্ষা করল সে যেন গোটা মানবজাতিকেই রক্ষা করল।'' (৫-৩২) তাহলে তারা, কোরআনের বাণীর খেলাপকারী জামায়াতের শাস্তি দাবি করছেন না কেন? উনারা যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী জামায়াত ও তার সমর্থনকারী বিএনপি দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করছেন না কেন?

তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে তারা ইসলামরক্ষার নাম দিয়ে ইসলামের অবমাননাকারী গণহত্যাকারীদেরই রক্ষা করছেন। এর কারণটি কী? সহনশীল বাংলাদেশের মাটিতে (এবং বিশ্বজুড়ে) এ ধরনের উগ্র, জঙ্গীবাদী, মানবতা ও প্রগতিবিরোধী দল যারা ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করে থাকে, তাদের উত্থান কী করে হল?

ইসলাম, বিশ্বরাজনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনেক বিজ্ঞজন মনে করেন যে ইসলামি সভ্যতার অস্তাগমনের ফলে পুরো মুসলিম সমাজে নতুন জ্ঞানার্জন, জ্ঞানচর্চার অভাব, সময়, কাল ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে কোরআন-হাদিস-শরিয়াহ ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার সচল সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে, চিন্তার ভয়াবহ স্থবিরতা এর কারণ। চিন্তার অন্ধকারাচ্ছন্ন আবদ্ধতা হতেই তো সৃষ্টি হয় ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও উগ্র মতাদর্শ যার একটি হল 'ওয়াহাবীবাদ'।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মাটিতে আক্রমণাত্মক জঙ্গীবাদী ইসলামের ধ্বংসাত্মক উত্থানের সঙ্গে সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া ও বিলিয়ন-উর্ধ্ব পেট্রোডলারের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী রফতানি করা ইসলামের সংকীর্ণ ও গোঁড়া ব্যাখ্যাকারী 'ওয়াহাবীবাদ' বহুলাংশে জড়িত; সে সঙ্গে আছে আরও কিছু ফ্যাক্টর। বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে হলে অতীত স্পর্শ করতে হয়। অতীত জানার অর্থ অতীতে বসবাস করা নয়, বরং অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের শান্তি-প্রগতির পথটি বেছে নেওয়ার প্রচেষ্টা। এ প্রেক্ষিতে প্রথমে শুরু করা যাক ইসলামি সভ্যতা দিয়ে।

আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু পর্যন্ত যে ইসলামি সাম্রাজ্য ছড়িয়েছিল, তা যে কোনো সাম্রাজ্যর মতোই ত্রুটিমুক্ত ছিল না। ক্ষমতার লড়াই, রক্তপাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ তাতে লেগেই ছিল। তবে গ্রিক-লাতিন সাম্রাজ্যের মতো এর ইতিবাচক দিকটি ছিল, জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত এক সভ্যতা। নতুন ইসলামি সভ্যতা।

ইউরোপের মধ্যযুগটিকে বলা হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বর্বরতার যুগ। ক্যাথলিক চার্চের নিষেধাজ্ঞায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার যখন রুদ্ধ তখন ইসলামি পণ্ডিতরা হয়েছিলেন ইউরোপে রেনেসাঁ-নবজাগরণের পথিকৃৎ। সে সময়কার মুসলিম আলেম-ওলামারা কোরআন ও হাদিসচর্চার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান, দর্শন, বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, কাব্য এমনকি সুরসঙ্গীতসহ জ্ঞানের সব শাখার চর্চা করতেন।

তারা জানতেন যে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। সে সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞানার্জন আল্লাহর আরাধনার অন্যতম অংশ এবং আল্লাহকে জানার চেষ্টার অন্যতম উপায়। জ্ঞানের সন্ধানে বিভিন্ন দেশভ্রমণ ছিল তাদের শিক্ষার অবিছেদ্য অংশ। তারা তাদের ব্যাপক জ্ঞান, চিন্তা ও প্রতিফলনের আলোকে ইসলামি আইন ব্যাখ্যা করতেন। উনারা সেকালে জ্ঞানকে ধর্মীয় ও জাগতিক সীমারেখায় বিভক্ত করেননি। ওই বিভাজনটা এসেছিল ইউরোপ থেকে। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তৎকালীন চার্চের নিষ্পেষণের কারণে।

আল বিরুনির কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন একাধারে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, হিব্রু, গ্রিক প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শী। গণিতশাস্ত্র, পদার্থ, জ্যোতি ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী। উনাকে ভূতত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্ববিজ্ঞানের জনক বলা হয়। ইংরেজিতে এ ধরনের বহুমুখী ও বিশাল জ্ঞানের অধিকারীকে বলা হয় 'পলিম্যাথ'। এগার শতকে তিনি ভারতগমন করেন এবং ভারতীয় বিজ্ঞানকে মুসলিম বিশ্ব ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে তিনি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর 'হিন্দ' গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি যদি ভাবতেন যে পৌত্তলিকদের কাছ থেকে শেখার কী রয়েছে বা হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা সংস্কৃত শেখা হারাম তাহলে জগত বঞ্চিত হত নতুন জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে।

আল বিরুনির পূর্ব-প্রজন্মের আরেক মুসলিম বিজ্ঞানী আল খোয়ারিযমি, যিনি ভারতীয় ও গ্রিক গণিতের সংমিশ্রণ করে তাতে নিজ ব্যাখ্যা যোগ দিয়ে গণিতশাস্ত্রকে নতুন স্তরে পৌঁছে দেন। তিনি ভারতীয় সংখ্যাপ্রণালীকে আরবি গণনাতে যুক্ত করেন এবং সে জ্ঞান পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। কম্পিউটার বিজ্ঞান যে শূন্য নম্বরটির ওপর নির্ভরশীল, তা প্রাচীন ভারতীয় গণিতজ্ঞদের আবিষ্কার। আল খোয়ারিযমি শূন্যর গাণিতিক ব্যবহার বিপুলভাবে বর্ধন করেন এবং শূন্যর ব্যবহারিক জ্ঞান বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পারস্য ও আরবের মুসলিম বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে। বীজগণিত বা অ্যালজেব্রার জনক আল খোয়ারিযমির বিখ্যাত গাণিতিক বই 'আল-জাবর-ওয়া আল মুকাবিলা' থেকে 'অ্যালজেব্রা' নামকরণটি হয়।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ ইবনে সিনা (ইউরোপে আভে সিনা নামে খ্যাত) একাধারে ছিলেন ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, কাব্য, আলকেমি, মনস্তত্ত্ব, গণিত, পদার্থ, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের 'পলিম্যাথ' পণ্ডিত। এগার শতকে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের ব্যাখ্যাকারী ইবনে সিনার পরবর্তীতে লাতিনে অনূদিত ব্যাখ্যা তের শতকের প্রখ্যাত ইতালীয় ক্যাথলিক ধর্মযাজক থমাস একুইনাসকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনি তার লেখনিতে ইউরোপীয় চার্চ ও এরিস্টটলের মধ্যে এক স্বস্তিকর যোগসূত্র গড়ে তোলেন ইবনে সিনার ব্যাখ্যার সঙ্গে নিজস্ব ব্যাখ্যা যোগ করে।

স্রষ্টা সম্পর্কে এরিস্টটলের একত্ববাদী এবং সংগঠিত ধর্মের বাইরে অবস্থানকারী একজন ব্যক্তিগত স্রষ্টার ধারণা সেকালের চার্চ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। এরিস্টটলকে জানার জন্য এ ক্ষেত্রে ইবনে সিনার লেখা বিপুল অবদান রাখে। বাস্তবিক, গ্রিক ভাষা থেকে এরিস্টটলের প্রায় সকল লেখা, দার্শনিক প্লাটোর 'রিপাবলিক' এবং অন্যান্য গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের লেখা (প্রটিনাস, প্রক্লাস, অলিম্পিওদরাস প্রমুখ) বিশ্বে সর্বপ্রথম আরবি ভাষায় অনূদিত হয় এবং তারপর আরবি থেকে লাতিন, হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসীসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রাচীন গ্রিক দর্শন জানার দুয়ার খুলে দেয়।

'বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার' নামে খ্যাত বাগদাদের 'বাইতাল হিকমাহ' বা জ্ঞানগৃহ থেকে গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী আল কিন্দি (নবম শতক) সর্বপ্রথম ওইসব অনুবাদের কাজে নেতৃত্ব দেন।

ইবনে সিনার প্রায় শত বছরের পূর্ব-প্রজন্মের আল ফারাবী, দর্শন, তর্কশাস্ত্র, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানে যার বিশেষ অবদান, তিনি সুরসঙ্গীত, গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্রেও ছিলেন সুপণ্ডিত। উচ্চমার্গের সুর ও সঙ্গীত মানুষের শরীর ও মনের জন্য থেরাপিস্বরূপ সে বিষয়ে তিনি তার বইয়ে ব্যাখ্যা করেন।

ফারাবির গ্রিক দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তাকে বলা হত 'দ্বিতীয় শিক্ষক'। এরিস্টটলকে গণ্য করা হত 'প্রথম শিক্ষক' রূপে। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের প্রথম পণ্ডিত যিনি ধর্মতত্ত্ব থেকে দর্শন পৃথক করেন। তিনি স্রষ্টাকে ব্যাখ্যা করেন 'অসীম জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন ভারসাম্যময় সত্ত্বা' রূপে। তাঁকে জানার প্রধানতম মাধ্যম হিসেবে তিনি মানুষের যুক্তি ও চিন্তাকে উন্নত করার মতবাদ ব্যক্ত করেন। তার মতে, মানুষের সবচেয়ে বড় সুখ হল যখন সে জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চা করে।

আল ফারাবির সমসাময়িক আল রাযী তার জন্মভূমি ইরান থেকে আদি সভ্যতার উৎপত্তিস্থল ইরাকের বাগদাদ হাসপাতালে চিকিৎসক রূপে যোগ দেন। সুরশিল্পী, আলকেমিস্ট ও দার্শনিক আল রাযী সর্বপ্রথম হাম ও গুটিবসন্তকে ভিন্ন দুটি রোগ হিসেবে এবং জ্বরকে শরীরের রোগ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন। শিশুরোগ চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিসেবে পরিচিত আল রাযী ছিলেন চোখশাস্ত্র বিজ্ঞানেরও একজন পাইওনিয়ার। তিনি প্রাচীন ভারত, চীন, পারস্য, সিরিয়া ও গ্রিসের চিকিৎসা এবং ঔষধের ওপর তেইশ ভলিউম বই লিখেন। ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদরা আল রাযীকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিকিৎসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

উল্লিখিত পণ্ডিতদের উত্তরপ্রজন্ম ইবনে রুশদের (ইউরোপে আভেরোস নামে খ্যাত) জন্ম বারো শতকে, তৎকালীন মুসলিম খিলাফতের রাজধানী দক্ষিণ স্পেনের কর্ডোবায়। পৃথিবীর বৃহত্তম লাইব্রেরি, জনসাধারণের জন্য তিনশ স্নানাগার (হাম্মাম), তিন হাজার মসজিদ ও চমকলাগানো স্থাপত্য-অধ্যুষিত অতিউন্নত কর্ডোবা নগরী ছিল জ্ঞান ও শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। ইউরোপের অন্যান্য স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা ভিড় জমাত কর্ডোবায়।

ইবনে রুশদের পিতা ও পিতামহ ছিলেন কর্ডোবার প্রধান কাজী বা ইসলামি আইনবিশারদ জজ। ইমাম মালিক ইবনে আনাসের (অষ্টম শতক) মাযহাবের ইসলামী শরিয়াহ আইনজ্ঞ ইবনে রুশদও ছিলেন স্পেনের সেভিল আদালতের জজ বা কাজী। তিনি বিয়ে, তালাক, জমির খাজনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জিহাদ, অমুসলিমদের সম্পর্কে সরকারের ভূমিকাসহ শরিয়াহ আইনের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন।

তিনি এ মত প্রকাশ করেন যে যদি বিশ্লেষণ ও দর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়ে ধর্ম বোঝার চেষ্টা করা না হয় তাহলে ধর্মের গভীর অর্থ হারিয়ে যাবে এবং স্রষ্টা সম্পর্কে ভুল ও বিচ্যুত ধারণার দিকে নিয়ে যাবে। তার মতে, ইসলাম হল সত্যের প্রতীক ও দর্শনের কাজ হল যুক্তি, বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের প্রয়োগ ঘটিয়ে সে সত্য খোঁজা। তিনি কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের উল্লেখ করেন (৩:১৯০-১৯১ এবং অন্যান্য) যেখানে স্রষ্টাকে জানার জন্য চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলনের (তাফাক্কুর) প্রয়োগ ঘটাতে মানুষকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন যে এক জমানার জ্ঞান থেকে অন্য জমানায় নতুন জ্ঞান গড়তে হয়। জ্ঞানের বাহক যদি মুসলিম না হয়ে ভিন্নধর্মেরও হয় সে জ্ঞান অর্জনে বাধা নেই যদি সে জ্ঞান সত্য হয়। তিনি ইবনে সিনার 'চিকিৎসা এনসাইক্লপেডিয়া' ও প্লাটোর 'রিপাবলিক' গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা করেন এবং এরিস্টটল দর্শনের সর্বশেষ ও সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাখ্যাকারী হিসেবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে খ্যাতি লাভ করেন।

ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, চিকিৎসা, গণিত, পদার্থ, মনস্তত্ত্ব, সুরসঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে তার সুগভীর জ্ঞান ও যুক্তিশাণিত চিন্তাধারা বারো থেকে ষোল শতকের ইউরোপে নবজাগরণের দুয়ার উন্মোচনে বিপুল অবদান রাখে। প্যারিস ও পাশ্চাত্য ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে রুশদের লেখা পাঠ্যসূচিরও অন্তর্ভুক্ত হয়। তার চিন্তার অনুসারীরা আখ্যায়িত হন 'আভেরোইস্ট' নামে।

কোরআনের বাণী অনুসারে তিনি সত্য জানার জন্য যে চিন্তা, যুক্তি, বিশ্লেষণ ও প্রতিফলনের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন এবং তৎকালীন পাশ্চাত্যে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কারণে যার পথ ছিল রুদ্ধ, সে পথের সন্ধান দেখানোর জন্য ইবনে রুশদকে 'পাশ্চাত্য ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠাতা জনক' বলা হয়। ষোল শতকের রেনেসাঁখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর রাফায়েল তার এক অমর প্রতিকৃতিতে নানা দেশের শিক্ষার্থী পরিবৃত ইবনে রুশদকে মূর্ত করে তোলেন।

ইবনে রুশদ, ইবনে সিনার পূর্বসূরী ইমাম হানবাল, ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা এবং তাদের মতো শান্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা পণ্ডিতদের অনেকেই শাসকদের রোষানলে পড়ে নির্বাসিত, কারাবন্দী ও নিগৃহীত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ ছিল শাসকদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও আদর্শিক মতপার্থক্য।

তা সত্বেও ইসলামের অভ্যুদয় থেকে প্রায় একহাজার বছর পর্যন্ত যুক্তি, বুদ্ধি ও প্রযুক্তিচর্চায় মুসলিম সমাজ অনেক অগ্রসর ছিল, তুলনামূলক মুক্ত পরিবেশ, ভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-দর্শন সম্পর্কে শাসকদের সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও উন্নত চিন্তার ধারক-বাহক পণ্ডিতদের অবদানের কারণে।

কিন্তু ১২৫৮ সালে, জ্ঞানবিজ্ঞানের অপর বিদ্যাপীঠ বাগদাদ নগরী যখন মঙ্গোলদের আক্রমণে ধ্বংস হয় তখন সে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আব্বাসীয় খলিফাদের প্রতিষ্ঠিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার 'বাইত আল হিকমাহ' (জ্ঞানগৃহ) যাতে সঞ্চিত ছিল ধর্ম, আইন, ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানের লক্ষ লক্ষ বই, গবেষণা-ম্যানুয়াল ও অনুবাদ। কথিত আছে যে হালাকু খানের সৈন্যরা এত বই টাইগ্রিস নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছিল যে নদীর পানি বইয়ের কালিতে কালো বর্ণ ধারণ করেছিল।

আব্বাসীয় শাসকদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ক্ষুদ্রস্বার্থরক্ষার্থে নতুন জ্ঞান সঞ্চয় নিয়ে অনীহা চলছিল বাগদাদ ধ্বংসের আগে থেকেই। তা চূড়ান্ত রূপ নিতে থাকে জ্ঞানগৃহ ধ্বংস, মঙ্গোল সৈন্যদের হাতে লক্ষাধিক নাগরিক ও জ্ঞানী-বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার পর। যা শেখা হয়েছে তাই যথেষ্ট আর জানার দরকার নেই, এ মতবাদের প্রভাব সুদূরে গিয়ে ঠেকে। নতুন জ্ঞান সঞ্চয়, ইজতিহাদের মাধ্যমে নতুন যুগ ও পরিস্থিতির আলোকে ধর্মীয় আইন বোঝার চেষ্টা ও ব্যাখ্যা করার বেগবান প্রক্রিয়া ও কৃষ্টি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে থাকে।

চিন্তার এ ক্ষয়িষ্ণু সময়েই ধর্ম পরিণত হয় এক চেতনাবিহীন খোলসসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে। বিজ্ঞান ও প্রগতির সঙ্গে ধর্মীয় চিন্তাধারার সমন্বয় না ঘটে মধ্যযুগের ইউরোপের মতোই তাদের মধ্যে ফারাক বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তের শতক থেকে ক্রমশ অন্ধকারযুগের গহ্বরে মুসলিম জাতি প্রবেশ শুরু করে এবং ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়, তখন জাগতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের বিভাজন্ হয় আরও প্রকট। উপমহাদেশে ধর্মীয় স্কুলের নাম হয় মাদ্রাসা। (যদিও আরবিতে এর অর্থ হল শুধু 'স্কুল' যাতে সব বিষয় পড়ানো হয়ে থাকে)। এর ফলটা হয় মারাত্মক। ধর্মীয় স্কুল থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক অংশ বঞ্চিত হয় জ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে শিক্ষা অর্জনের। ধর্ম সম্পর্কে তাদের চিন্তা ও বোধ তাই হয় অপরিণত ও সংকীর্ণ।

যেমন কোরআনের বহু আয়াত যা সাম্প্রতিক শতকের আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা বোঝানোর জন্য দরকার বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে জ্ঞান। কোরআনের এ আয়াত "তিনি তোমাদের মাতৃগর্ভে সৃষ্টি করেছেন, পর্যায়ক্রমে, একের পর আরেক, তিনটি অন্ধকার আবরণে। এই হলেন আল্লাহ। তোমাদের রব। তিনিই সার্বভৌমত্বর অধিকারী। তিনি ব্যতিত আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয়। তাহলে কি করে তাঁর থেকে তোমরা ফিরিয়ে নেবে?"(৩৯-৬)

আয়াতটিতে আল্লাহ তাঁর একত্ব ও সার্বভৌমত্ব উল্লেখের আগে মাতৃগর্ভের যে উপমা টেনেছেন তা যেন আধুনিককালের মানুষকে উদ্দেশ্য করে। আধুনিক ধাত্রীবিজ্ঞান প্রমাণ করছে (ডা. কিথ মুর, অ্যামব্রায়োলজি ইন দ্য কোরআন, ১৯৯০) যে ভ্রুণকে আচ্ছাদনকারী তিনটি আবরণের উপমা কতটা সঠিক। আল্লাহ তাঁর একত্ব ও অদ্বিতীয়বাদের বাণীটি উল্লেখ করছেন মানুষের সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওই জ্ঞানের সঙ্গে জড়িয়ে।

আয়াতটি ভালোভাবে বুঝতে হলে শুধু তো কোরআন মুখস্থ করলে চলবে না বা অন্ধবিশ্বাস থাকলে হবে না, এ বাণী জানতে হবে নতুন আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের আলোকে, অথবা নতুন যুগ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে শরিয়াহ ব্যাখ্যা করার মতো ব্যাপক জ্ঞান, যুক্তি ও বিবেচনাবোধ থাকতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ হযরত ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষের সময় কোরআনে উল্লিখিত 'চুরি করলে হাতকাটার নির্দেশ' রদ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শরিয়ার উচ্চতর লক্ষ্য ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দেন। অথবা কোরআনে রসূল (স.)-এর পরিবারকে ভাতা দেওয়ার যে নির্দেশ ছিল তা বন্ধ করে দেন, কারণ পরিস্থিতি তখন বদলে গিয়েছে, তারা অর্থনৈতিক কষ্টে নেই।

আন্দালুসিয়ার (দক্ষিণ স্পেন) শরিয়াহ আইনজ্ঞ ইমাম আল শাতিবির (চৌদ্দ শতক) বৃহত্তম অবদান ছিল শরিয়াহ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনের উচ্চতর লক্ষ্য ও ইচ্ছা (মাকসাদ) বোঝানোর ব্যাপারে। মাকসাদের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছিলেন সার্বিক জনকল্যাণ, জানমাল, বুদ্ধি-বিবেচনাবোধের সুরক্ষা, আর্থসামাজিক নির্যাতনমূলক নীতি-কার্যকলাপ রোধ এবং সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌন্দর্যবর্ধন।

উল্লেখ্য যে, শরিয়ার আক্ষরিক অর্থ হল পথ অথবা যে পথ জলাশয় বা জলভর্তি আধারের দিকে দিকনির্দেশ করে। শরিয়ার সামগ্রিক অর্থ হল উচ্চআদর্শপূর্ণ এমন এক জীবনধারা যা ইহকাল ও পরকালে শান্তিঅর্জনে সহায়তা করে। শাস্তিপ্রদান শরিয়ার একটি অংশমাত্র এবং সামগ্রিক জনকল্যাণ ব্যতীত অন্ধভাবে শাস্তিপ্রদান শরিয়া আইনের লক্ষ্য নয়।

বর্তমানের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মীয় জ্ঞান সীমাবদ্ধ করে রেখেছে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান ও বাহ্যিক অনুশাসনের মধ্যে। কোনো অনুশাসনই ফলবাহী হতে পারে না যদি না তার সঙ্গে যুক্ত হয় হৃদয়-পরিশুদ্ধির সংগ্রাম (তাসাওউফ)। রসুল (স.) নিজ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম বা জিহাদকে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। কারণ নিজকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টার মধ্যেই বিকশিত হতে পারে স্রষ্টার জ্ঞান ও শান্তি।

কিন্তু সাধারণত মুসলিম সমাজের ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে জ্ঞানী ও প্রেমময় স্রষ্টার প্রতিফলন বিরল অথচ যেখানে কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ বাণীটি ছিল 'ইকরা' পাঠ কর এবং তার সঙ্গে যুক্ত ছিল কলম দিয়ে শিক্ষাদানের কথা (৯৬:১-৪)। কোরআনের প্রতি অধ্যায় শুরু হয়েছে পরম অনুগ্রহশীল (আল রাহমান) ও পরম করুণাময় (আল রাহীম) আল্লাহতায়ালার নামে।

রাহমান ও রাহীম এ দুটি শব্দের উৎপত্তি 'রাহম' থেকে যার অর্থ মাতৃগর্ভ। মাতৃগর্ভ সন্তানকে যেমন প্রেম দিয়ে লালন ও সিঞ্চিত করে তেমনি স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে প্রেম, দয়া, করুণা ও জ্ঞান। কোরআনে আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে যে শব্দ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল 'ইলম' বা জ্ঞান।

শান্তি, সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি প্রেম ও জ্ঞানবিমুখ ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয়ের আবর্তে ক্রমশ যে গোঁড়া ও উগ্র মতবাদগুলো গড়ে ওঠে তার অন্যতম একটি হল বর্তমান যুগের 'ওয়াহাবীবাদ'।

আঠারোশ শতকের শুরুতে সৌদি আরবের নাজদ প্রদেশের উইয়াইনায় (সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে এলাকাটির নাম ছিল হিজাজ ও নাজদ) জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব মুসলিম সমাজকে পবিত্রকরণের জন্য সালাফ বা পূর্বপুরুষদের অনুসরণের জন্য যে সংস্কারবাদী মতবাদের প্রচলন করেন তা পরবর্তীতে 'ওয়াহাবীবাদ' নামে পরিচিতি লাভ করে। আবদুল ওয়াহাবের কট্টর মতবাদ ও ব্যাখানুসারে ওই মতবাদের অনুসারী ছাড়া বাকি সব মুসলিম 'সত্যিকার' মুসলিম নয় এবং তারাই একমাত্র সত্যধর্মের অনুসারী।

আবদুল ওয়াহাবের এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ মতবাদের প্রতিবাদ করেন সেকালের বহু ইসলামী পণ্ডিত। মক্কা ও মদিনার ওলামারা তার এ সঙ্কীর্ণ মত ও বাকি সব মুসলিম সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা বাতিল ঘোষণা করেন। যুক্তি ও প্রেক্ষিতের আলোকে কোরআন গ্রহণ না করে আবদুল ওয়াহাব আক্ষরিক অর্থে কোরআন উপস্থাপিত করেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশের বিপরীত কর্মকেও সঠিক মুসলিমের কর্তব্য হিসেবে উপস্থাপিত করেন। যেমন ব্যাভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ যা হল ইহুদি ধর্মীয় আইন তা প্রয়োগ করেন।

কোরআনে ব্যাভিচারীর শাস্তি (বিবাহিত বা অবিবাহিত) মৃত্যুদণ্ড নয়, তাকে চাবুক মারার বিধান রয়েছে। কিন্তু যেহেতু কোরআন অনুসারে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অন্যজনের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি ও অনুমতি না নিয়ে কারও ব্যক্তিগত কামরায় প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং ব্যভিচার প্রমাণের জন্য চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর প্রয়োজন, সেহেতু ব্যভিচার প্রমাণ অত্যন্ত কঠিন। এ ধরনের অনৈতিক ঘটনা যেন না ঘটতে পারে তার জন্য ওই নির্দেশকে 'প্রিভেনটিভ' আইন মনে করা যেতে পারে।

আবদুল ওয়াহাব এ ক্ষেত্রে শরিয়াহ আইনের প্রথম ভিত্তি কোরআন অনুসরণ না করে হাদিসের আশ্রয় নিয়েছিলেন। রসুল (স.)-এর ইন্তেকালের পর যে সকল হাদিস সঃগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করা শুরু হয় সেগুলো কোরআনের বাণী ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু বিপরীত নির্দেশ দিতে পারে না।

সে জন্য ওলামাদের অনেকেই মনে করেন যে ওই বিষয়ে কোরআনের বাণী অবতীর্ণ হওয়ার আগে যে ইহুদি ধর্মীয় আইন প্রচলিত ছিল তার ব্যবহার রসুল (স.) করেছিলেন। অনেক ওলামা এটাও উল্লেখ করেছেন যে রসুল করীম (স.)-এর সময় একজন ব্যভিচারীকেও ধরা হয়নি। তারা নিজেরা রসুল (স.)-এর কাছে এসে শাস্তি কামনা করেছিল এবং রসুল (স.) তাদের বারবার ফিরিয়ে দিয়ে ওই কঠোর শাস্তি রদের চেষ্টা করেছিলেন।

আবদুল ওয়াহাব তার এলাকার শাসক উসমান ইবনে মুয়াম্মারের সমর্থন নিয়ে এক নারীকে ব্যভিচারের জন্য পাথর মেরে হত্যার ব্যবস্থা এবং রসুলের (স.) সাহাবা যাঈদ ইবন আল খাত্তাবের কবর গুড়িয়ে সমান করার কারণে সৌদি অপর এক শাসক সুলাইমান ইবন মোহাম্মদ তাকে তার এলাকা থেকে বহিষ্কার করেন।

বহিষ্কৃত আবদুল ওয়াহাবকে আশ্রয় দেন দিরইয়া এলাকার এক ক্ষুদ্র গোত্রের শাসক মোহাম্মদ ইবন সউদ। দুজনের মধ্যে যে চুক্তি হয় তার ভিত্তিতে পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো দখল করে গড়ে ওঠে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র (১৭৪৪) এবং বিশ শতকে (১৯৩২) তা আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি রাজ্যে পরিণত হয়।

ইবনে সউদ ও তার উত্তর প্রজন্ম হন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী রাজ-রাজড়া এবং আবদুল ওয়াহাব হন সে নতুন রাষ্ট্রের 'অপ্রতিদ্বন্দ্বী' ধর্মীয় নেতা। আবতুল ওয়াহাবের কন্যার সঙ্গে ইবনে সউদের পুত্র আবদুল আজিজের বিয়ে হওয়ার ফলে তাদের চুক্তি স্থায়িত্ব লাভ করে। আবদুল ওয়াহাবের ধর্মীয় ব্যাখ্যা এ রাজতন্ত্রকে বৈধতা দেয় এবং সংকীর্ণ ওয়াহাবী মতবাদ হয় সৌদি রাজ্যস্বীকৃত একমাত্র ধর্মীয় মতবাদ।

এভাবেই নতুন চিন্তাভাবনা, ভিন্ন মতবাদ ও ব্যাখ্যার পথ সে দেশে রুদ্ধ হয়ে যায়। এ দুই মিত্র শক্তি পরস্পরের নিষ্পেষণ ও নির্যাতনকে সমর্থন করে চলে ইসলামরক্ষার নাম দিয়ে। এ রাজ্যে নারী, ভিন্নধর্মীয় ও সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ পরিণত হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে। ধর্মীয় অনুশাসন ও আচরণ প্রয়োগের জন্য নিয়োগ হয় ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী।

১৮০২ সালে সৌদি রাজতন্ত্র সমর্থিত ওয়াহাবীবাদী সৈন্যরা ইরাকে অবস্থিত ধর্মীয় স্থান কারবালার দেয়াল, ইমাম হোসেনের (রা.) কবরের ওপরের গম্বুজ ধ্বংস, সোনাদানা লুটপাট এবং কোরআনের মুল্যবান কপি ধ্বংস করে। হত্যা করে অসংখ্য নরনারীকে। মদিনায় (১৮০৬) রসুল (স.)-এর পারিবারিক কবরস্থান জান্নাতুল বাকির বহু নিদর্শন তারা ধ্বংস করে। যে কোনো মূর্তি, মানুষ, পশুপাখীর ভাস্কর্য ও চিত্র গড়া ও অঙ্কন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল যে প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন পিরামিড বা ফেরাউনদের কবর অথবা স্ফিংসের অর্ধ-সিংহ শরীর এবং মানুষের মাথার মূর্তি কিন্তু অপর মিসর রাষ্ট্রের মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করেননি। অবশ্য এ কারণেই তাদের চিন্তার অনুসারী ছাড়া সারা মুসলিম জাহানকেই ওয়াহাবীবাদীরা বেঠিক ও বিপথগামী আখ্যা দিয়েছিল।

১৮১৮ সালে তুরস্কের অটোমানরা তাদের পরাজিত করে। পরবর্তীতে অটোমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে আঁতাত করে ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ওয়াহাবীবাদী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজতন্ত্র আবার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মক্কা ও মদিনার দখল নেয়। তারা নিজেদের মক্কা-মদিনার রক্ষাকর্তা ঘোষণা করে এবং রসুল (স.), তাঁর পরিবার ও সাহাবাদের স্মৃতির অগুণতি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং ওহুদের যুদ্ধে শহিদদের কবরও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আশ্চর্য নয় যে এ উগ্র ওয়াহাবীবাদীরাই সাম্প্রতিক ১৩ দফা দাবির মধ্যে ভাস্কর্য ধ্বংসেরও উল্লেখ করেছিল।

বোধকরি ওয়াহাবীবাদীদের উগ্র মত ও কর্ম যেমন ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের আকৃষ্ট করেছিল, তাদের শত্রু অটোমান মুসলিমদের পরাজিত করার জন্য– তেমনি পরাশক্তি ধনতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রকেও আকৃষ্ট করে অপর পরাশক্তি তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবর্তে, যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টদের হঠানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের দুর্নীতিপরায়ণ রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রকে অর্থবল ও অস্ত্রবলে সজ্জিত করে। 'নাস্তিক কমিউনিস্টদের নির্মূল কর' এ শ্লোগানে উজ্জীবিত ধর্মান্ধ ওয়াহাবীবাদীরা আরও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।

পাকিস্তানে জামায়াত–এ-ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার প্রস্তাবক মওলানা আবুল আলা মওদুদীর ওয়াহাবীবাদী ধর্মীয় ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হন সৌদি আরবের ওয়াহাবী নেতারা। তাদের মধ্যে আদর্শিক ও অর্থনৈতিক সখ্যতা গড়ে ওঠে। সৌদি-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দোসর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত-এ-ইসলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অংশ নেয় খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নির্বিচার গণহত্যায়। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে, বিজয়ের কদিন আগেই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর তেলের মূল্য আরও বৃদ্ধি পায়। সে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় ওয়াহাবীবাদ 'রফতানি' করার পেট্রোডলার। বর্তমানে সৌদি আরব বছরে ৮৭ বিলিয়ন বা তারও বেশি পেট্রোডলার খরচ করে থাকে ইসলামের আবরণে এ ভয়ঙ্কর আগ্রাসী ও ধ্বংসাত্মক ওয়াহাবীবাদের প্রচারণায়। দরিদ্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর এতিম ও নিঃসহায় শিশুদের ভরনপোষণ ও ইসলামি শিক্ষাদানের নামে তারা ওই মতবাদের বীজ বপন করে এবং পরে এ এতিমদেরই নিজ স্বার্থে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে থাকে।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃবৃন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি নিষিদ্ধ জামায়াত-এ-ইসলামকে পুনর্জীবিত করার পর দলটি তৃণমূলে সংগঠিত হতে থাকে, পাকিস্তান ও সৌদির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে।

আশির দশকে প্রতিপক্ষ সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আফগানদের বিপুল অর্থ ও অস্ত্রবলে বলীয়ান করে। উগ্র ও গোঁড়া ইসলামি রাজনৈতিক দল হেযব-ই-ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা, বিতর্কিত, গণহত্যাকারী হিসেবে নিন্দিত গোলাবউদ্দীন হেকমতিয়ারের মতো আফগানদের যুক্তরাষ্ট্র সরকার বীর হিসেবে আখ্যায়িত করে। তাদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থ, সিআইএ এবং পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই-এর ট্রেনিং নিয়ে পরবর্তীতে অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যাকারী সৌদি বিন লাদেন ও আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েতদের পরাজিত করে।

যুদ্ধকালীন সময় পাকিস্তানের রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাসকারী আফগান শিশুদের স্কুলের কারিকুলাম সামরিকীকরণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইউএসএআইডির অর্থে। অঙ্কের বইয়ে সংখ্যা ১ বোঝানো হয় ১ রাইফেল বা এমনি অস্ত্রের ভাষা দিয়ে। যুদ্ধংদেহী এবং উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ সোভিয়েত হঠানোর জন্য ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তা বিশ্বের জন্য এক ভাইরাসে পরিণত হয়।

ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মতো বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রফতানিকারক ইন্ডাস্ট্রিগুলো ভালোভাবেই টিকে থাকে যুদ্ধ ও অস্থিরতা লালন করে।

আজকের বাংলাদেশে ধর্ম কেন্দ্র করে যে অস্থির উন্মাদনা চলছে তার কারণগুলো ভালোভাবে না বুঝলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়াও দুরহ হবে। অস্পষ্টতার ঘোলা পানিতে সুযোগসন্ধানীরা যে ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে থাকে তার পরিণাম হয় ভয়াবহ। ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ, লাভবান হয় ক্ষমতা ও সম্পদলোভী মুষ্টিমেয়। বর্তমানে হেফাজত-এ-ইসলামীর ১৩ দফা দাবি এবং ইসলামরক্ষা ইস্যু করে যে হিংস্রতা ও নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার বৃহৎ দায়ভার ইসলামের মৌলিক নীতিভঙ্গকারী, লাখো নির্দোষ মানুষের হত্যাকারীদের সমর্থক দল ও রাজনীতিবিদদের ওপরও বর্তায়।

পাকিস্তান আমলেও যেমন কৌশলটির ব্যবহার হত। সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যখনই আন্দোলন হত, সরকার তখনই উসকে দিত ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বিভাজন। বৃহত্তর হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধ ও অপশিক্ষিত সমাজে নির্যাতকদের ওই শান্তিবিরোধী কৌশলগুলো খুব কাজে লাগে।

মনস্তত্ত্ববিদ এরিক এরিকসন উনার গুরু ফ্রয়েডের কিছু বিতর্কিত মতবাদ খণ্ডন করেন তাঁর বিশ্বব্যাপী সাড়াজাগানো মতবাদ 'ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজি'র মাধ্যমে। উনার মতানুসারে, যৌনপ্রবৃত্তি নয়, বরং একটি মানুষের শিশুস্তর থেকে পরিণত বয়সের পূর্ণবিকাশ নির্ভর করে তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার ওপর। মানবজীবনের প্রথম আটটি বছর তার পরবর্তী বিকাশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বছর থেকে পরবর্তী আট বছর সে যে ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করে তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে তার পরিণত বয়সের চিন্তা ও বিকাশ।

এরিকসনের মতবাদটি মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে দেয়। শিশুদের কারিকুলামসহ সমাজ বিজ্ঞান ও মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মতবাদটি যুক্ত, পঠিত ও আলোচিত হয়।

সাম্প্রতিকের হেফাজতে ইসলাম এ ক' মাস আগেও ছিল অখ্যাত, তাদের কথানুসারে ইসলামরক্ষার জন্য ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে দলটির সম্মুখকাতারে বিক্ষোভকারী ও সমর্থকদের এক বড় অংশ হল দলটির পৃষ্ঠপোষকতায় বড় হওয়া এতিমরা। শিশু অবস্থায় হেফাজতের আশ্রয়ে তারা বড় হয়েছে বিশেষ এক পরিবেশ ও ধর্মীয় (ইসলামের গোঁড়া এবং বিকৃত ব্যাখ্যা) শিক্ষার মধ্যে।

বর্তমানের এ দূরবস্থা থেকে উত্তরণের সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন সম্পূর্ণ করতে হবে বাংলাদেশের জন্মসময়ের কালিমা মুছতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে ও আমাদের লক্ষ শহীদ ও নির্যাতিতা মা-বোনের পবিত্র স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাতে- তেমনি বিদ্ব্যৎ ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারী সকল দুর্নীতিবাজ, তারা যে দলেরই হোক না কেন তাদের ভোট ও সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে উৎখাতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে।

ওই সকল দুর্নীতিবাজদের অপকর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধী ও ইসলামের অপব্যবহারকারীদের শক্তি সঞ্চয়েরই পথ করে দিয়ে শান্তির পথ রুদ্ধ করছে। একই সঙ্গে জরুরি পদক্ষেপ হবে বেসরকারি কওমি ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামকে শান্তিশিক্ষা, সাধারণ ও ব্যবহারিক শিক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসপাঠের সঙ্গে যুক্ত করা; তৃণমূলে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা এবং এ চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া যে গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও তার সমর্থকরা কখনওই ইসলামের প্রতিনিধি হতে পারে না।

এ নতুন পথ সৃষ্টি করার দায়িত্ব শান্তি ও ন্যায়ের অন্বেষক সকলের।