জেলহত্যার রায়: ব্যক্তিগত অনুভূতি ও একটি পর্যালোচনা

শারমিন আহমদ
Published : 3 May 2013, 07:25 PM
Updated : 3 May 2013, 07:25 PM

সুদীর্ঘ বছর, কাল ও মুহূর্তের প্রত্যাশিত জেলহত্যার রায় বের হল ৩০ এপ্রিল। রায়টি নিয়ে মনে একটা মিশ্র অনুভূতি চলছে। এটিকে সম্পূর্ণ রায় না বলে বলা যেতে পারে আংশিক রায়। এ রায়ে পূর্ববর্তী ২০০৪ সালের তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তর রায়, যা ২০০৮ সালে বদলে ফেলে মাত্র একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়, তা বাতিল করে ২০০৪ সালের রায় বলবত করেছে।

২০০৪ সালে প্রদত্ত রায়ে তিন পলাতক অথবা মৃত রিসালদার মোসলেম উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসামীপক্ষের আপিলের মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত উল্লিখিত দুই দফাদার মুক্তিলাভ করে। আজ, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩, রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের মাধ্যমে ২০০৪ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড্ পুনঃবহাল করে।

সে হিসেবে আজকের এ রায়ের মধ্য দিয়ে জেলহত্যাকাণ্ডের বিচারে অগ্রগতি হয়েছে। আশা করা যেতে পারে যে, এ অগ্রগতি সম্পূর্ণ বিচার ও রায়ের পথ উন্মুক্ত করবে।

এ কথাটি বলার কারণ হল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃবৃন্দ, চার জাতীয় নেতা, প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলীর হত্যাকারীরা কি শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর অধস্তন ওই তিন সৈন্য ছিল? তারা তো নির্দেশ পালনকারী মাত্র! মূল ষড়যন্ত্রকারী, যাদের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড হল তারা কোথায়?

বিএনপি সরকারের শাসনামলে রহস্যজনকভাবে দুই বার রায়ের দিন পেছানোর পর, ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালতের রায়ে জেলহত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত বিএনপির নেতৃবৃন্দ ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সেনা অফিসার মেজর(অব.) খায়রুজ্জামান ও মেজর( অব.) আজিজ পাশা বেকসুর মুক্তি লাভ করে।

সে রায়ে খালাসপ্রাপ্ত এবং জেলহত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম হিসেবে অভিহিত তাহের উদ্দীন ঠাকুর সম্পর্কে আদালত বলে যে, তার জবানবন্দিতে ষড়যন্ত্রের বিষয়টির আভাস আছে কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তা প্রমাণ করতে পারেনি (প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর, ২০০৪)।

জানামতে, বেকসুর খালাসপ্রাপ্তদের বিষয়ে আরও তদন্তের এবং প্রমাণাদি সংগ্রহের নির্দেশও আদালত দেয়নি। একই সঙ্গে ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয়নি, এ রায় দেওয়া হলেও বারজন সেনাকর্মকর্তাকে, যাদের প্রায় সকলেই তখন দেশান্তরী ও পলাতক তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দিয়ে স্ববিরোধিতা করা হয়েছে বলে কেউ কেউ সেদিন অভিযোগ করেছিলেন।

তদুপরি ২৮ অগাস্ট, ২০০৮, হাইকোর্ট, জেলহত্যায় অভিযুক্ত সেনা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল(অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লে. কর্নেল (অব.)বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.)এ কে এম মহিউদ্দীনকেও মুক্তি দেয়। তারা বিএনপি সরকারের আমলে জেলহত্যা মামলায় ছাড়া পেলেও, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে অভিযুক্ত হন। তাদের বিরুদ্ধে ফাঁসীকাষ্ঠে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দণ্ড কার্যকরী হয় ২৭ জানুয়ারী ২০১০; আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় টার্মে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পক খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিএনপি শাসনামলের শেষদিকে, ৫ মার্চ, ১৯৯৬, কোনোপ্রকার দণ্ড মাথায় না নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন যে ১৫ অগাস্টের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না। মোশতাককে অপসারণ করে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান শাসনতন্ত্রের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সে অর্ডিন্যান্সকে স্থায়ী করে নেন, ১৯৭২-য়ে গৃহীত দালাল আইন বাতিলসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যাকারী শক্তির পুনরুত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৫ অগাস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকারীদের কূটনৈতিক চাকরিসহ নানাভাবে পুরষ্কৃত করেন।

স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ও তার পদানুসারী এরশাদ সরকারের আমলে ১৫ অগাস্ট ও জেলহত্যাকাণ্ডের বিচার আশা করা ছিল অবাস্তব। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জেলহত্যার তদন্তকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেআইনীভাবে আটকে রাখে। সুদীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়লাভ করার পর উল্লিখিত বিচারের দুয়ার খুলে যায়। পরবর্তী ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পুনঃজয়লাভ করলে বিচারের প্রক্রিয়া শিথিল ও বিলম্বিত হতে থাকে।

এসব বেদনাদায়ক জটিলতার মধ্য দিয়ে আজকের জেলহত্যার বিচারে যে রায় বের হয়েছে তাকে আমি সমাপ্তি বলব না; বলব সমাপ্তির পথে যাত্রা। বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত যে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও বেঁচে রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বিচারে অগ্রগতির আরেকটি ধাপ। সে সঙ্গে জেলঅভ্যন্তরে ঢুকে বাকি যারা হত্যাকাণ্ড করেছিল তাদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

কথাটি উল্লেখ করার কারণ হল যে, জেলহত্যাকারী হিসেবে মাত্র তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা মৃত্যুদণ্ড লাভ করেছে। কিন্তু বাকি চার-পাঁচ জন বাদ পড়ল কেন? তদানীন্তন আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান, ডিআইজি প্রিজনস আব্দুল আউয়াল, জেলর আমিনুর রহমান ও সুবেদার ওয়াহেদ মৃধা জেলহত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। আমিনুর রহমান ও ওয়াহেদ মৃধার চোখের সামনেই নিউ জেল বিল্ডিঙের ১ নং সেলের ভেতর অন্যান্য রাজবন্দীদের থেকে আলাদা করে জড়ো করা চার জাতীয় নেতার ওপর ঘাতকরা ষাট রাউন্ড ব্রাশফায়ার চালায়। আইজি ও ডিআইজি তখন ঘটনাস্থলের মাত্র ৪০ গজ দূরে দাঁড়ানো।

নব্বই দশকের প্রথমার্ধে গৃহীত ও প্রকাশিত (১৯৯৩-১৯৯৯৪)ছোট বোন সিমিন হোসেন রিমির অবসরপ্রাপ্ত জেল কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার ও দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বরে ফাইলের স্তূপ থেকে উদ্ধার করা আইজি ও ডিআইজির ১৯৭৫-য়ে জেলহত্যার পর লিখিত প্রতিবেদনে জানা যায় যে, রাতের গভীরে ক্যাপ্টেন মোসলেমের নেতৃতে চারজন ঘাতক ঢাকা সেন্ট্রাল জেলঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে চার নেতাকে হত্যা করে। গুলি করার পর দ্রুত ঘাতকের প্রথম দল ভোর ৪:৩৫ মিনিটে জেলখানা ত্য্যগ করে। ৫:২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে, তিন-চার জনের আরও একটি সশস্ত্র দল জেলের ভেতর প্রবেশ করে। তারা হত্যা নিশ্চিত করার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মনসুর আলীর দেহে বেয়োনেট চার্জ করে।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার যে, এ আলীর নাম মৃত্যুদণ্ড থেকে বাদ পড়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ বা আবুল হাশেম মৃধার একজন রিপোর্টে উল্লিখিত নায়েক এ আলী কিনা সে বিষয়টি অনুল্লিখিত। অন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী সুবেদার মোসলেমের নাম-ঠিকানাও অনিশ্চিত। ১৯৭৫ সালে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে আইজি এবং আইজিকে লেখা ডিআইজির প্রতিবেদনে মোসলেমের নামের সঙ্গে ক্যাপ্টেন পদবী উল্লেখ করা হয়(দৈনিক ভোরের কাগজ, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬)। জেলর এবং ডিআইজির কথায় অনিচ্ছাসত্বেও ঘাতকেরা জেলগেটের খাতায় নাম সই করে। ওই নামগুলো কি সঠিক ছিল? বা পদবী? মোসলেমের নাম নিয়ে আদালত সন্দেহ প্রকাশও করেছিল। মোসলেমকে পরবর্তীতে মসলেহউদ্দীন হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে।

জেলহত্যার দীর্ঘ ৩৮ বছর পরও তারা বা তার সঙ্গের হত্যাকারীদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তারা কি আদৌ বেঁচে আছেন না ভিন্ন নামে বসবাস করছেন এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর মৃত্যুদণ্ড বলবত হওয়ার কোনো উপায় নেই। আর যারা মুল চক্রান্তকারী তারা নির্বিঘ্নে ও দাপটের সঙ্গেই সমাজে চলেফিরে বেড়ালেন।রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে দ্বিধাবিভক্ত আমাদের সুশীল ও বিদ্বৎসমাজও জেলহত্যার বিষয়টিকে তথ্য ও নিরপেক্ষ গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরার তেমন প্রয়াস নেননি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেবে।

মনে পড়ে ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখন বাংলাদেশে যাই এবং জেলহত্যা বিষয়ে তথ্যসংগ্রহর উদ্যোগ নিই, তখন উপলব্ধি করি যে বিষয়টি নিয়ে কত কম নাড়াচাড়া এবং বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণের অন্যতম কারণ ছিল জেলহত্যার তথ্য জোগাড় করা। সে সময় ব্যাপারটি সহজ ছিল না। স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী কর্নেল ফারুক ও রশিদ তখন জেনারেল এরশাদের ছত্রছায়ায়। দেশে তারা ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। গণহত্যাকারী আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা জেনারেল জিয়াউর রহমানের দালাল আইন বাতিলের বদৌলতে রাজনৈতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ কেউ দুই জেনারেলের সময় মন্ত্রীর পদেও আসীন হয়েছেন। জেলহত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলর আমিনুর রহমান, ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়াল প্রমুখ তখনও সরকারি চাকরিতে কর্মরত। তাদের পক্ষে তখন সে বিষয়ে কথা বলা বিপজ্জনক।

এমন অবস্থাসত্ত্বেও আমি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম তারা ছিলেন, জেলহত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি আবদুস সোবহান, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক বীর উত্তম, যাকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য ক্ষমতায় আসীন মেজর জেনারেল খালেদ মশারফ নিযুক্ত করেছিলেন জেলহত্যার রাতে উপস্থিত জেল কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও রায়েরবাজার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আ স ম মহসীন। শেষোক্ত দুজন নিহত চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এ এইচ কামরুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারে বন্দী ছিলেন। এ ছাড়াও জেলহত্যার তদন্ত সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন ও অ্যাডভোকেট বারী আমাকে তথ্য দেন।

তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে যে প্রবন্ধটি রচনা করি, তা ছিল আমার জানামতে জেলহত্যার উপর রচিত প্রথম গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি '৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ও বিবেকের আত্মাহুতি' শিরোনামে ১৯৮৮ ও পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমিনুল হকের ক্যাসেটে রেকর্ডকৃত প্রথম সরকারি সাক্ষাৎকারটি যা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে গোপনে তিনি রেখেছিলেন, তার সংবাদ কেমন করে যেন আর্মির গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত লে. কর্নেল মাহবুব পেয়ে যান এবং কৌশল করে উনার কাছ থেকে নিয়ে যান। জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশিত জিয়া হত্যার ব্যর্থ অভ্যুত্থনে নিহত হন মাহবুব। ক্যাসেটটির সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।

আমিনুল হক উনার রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে জানান যে, ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে বঙ্গভবন থেকে ফোনে তদানীন্তন মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ অস্ত্রধারী ঘাতকদের (যারা জেলগেটে পৌঁছে দম্ভভরে জানিয়েছিল যে তারা হত্যা করতে এসেছে) চার নেতার কাছে নিয়ে যাওয়ার এবং মোশতাক রশিদের নির্দেশ পালন করার হুকুম দেয়।

খন্দকার মোশতাক! আজীবনের সহকর্মীদের নির্মমভাবে হত্যার মূল পরিকল্পকদের একজন। ১৫ অগাস্ট, ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, সে দিনই ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের অন্যতম খন্দকার মোশতাক তার দুই আস্থাভাজন সহচর মাহবুব আলম চাষি ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর পরিবৃত হয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবনে প্রবেশ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী ও জেলহত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলেন একই ব্যক্তিবর্গ। সেনাবাহিনীর একাংশ এবং বেসামরিক চক্রান্তকারীদের আঁতাতে এসব নারকীয় হত্ত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের বীজ প্রোথিত হয়েছিল ১৯৭১-য়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরিণত হয়েছিল যুদ্ধপরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচণ্ড কিছু ভুল ও ব্যর্থতার জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মার্কিন নিক্সন-কিসিঞ্জার সরকারের সঙ্গে ১৯৭১ সালে মোশতাক-চাষি-ঠাকুর চক্রের গোপন আদানপ্রদান হয়। তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ় হস্তক্ষেপ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন মনোভাবের কারণে সেদিন তাদের পাকিস্তান-মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে যায়। মোশতাককে হারাতে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি।(এ বিষয়ে মঈদুল ইসলাম রচিত 'মূলধারা ৭১' ও লরেন্স লিফশুলয রচিত 'বাংলাদেশ: দ্যা আনফিনিশড রেভুলুশন' গ্রন্থে বিশদ তথ্যভিত্তিক বর্ণনা রয়েছে)।

সে একই চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর উনার কাছাকাছি হয়, (তাদের অনেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিভিন্ন ক্ষমতাশালী পদভুক্ত হয়)। ১৯৭১ সালের ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের সদ্বব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর কতগুলো মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কখনওই তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চাননি। যুদ্ধের সময় কার কী ভূমিকা ছিল তা জানার বদলে ষড়যন্ত্রকারীদের তিনি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।

তাদের প্ররোচনায় ও একক সিদ্ধান্তে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের সাধারণ ক্ষমা করে দেন। এমনকি ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেক মজুমদার, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে তাঁর গৃহ থেকে অপহরণ করার সময় যার মুখের কালো কাপড় সরে যায় এবং শহীদপত্নী পান্না কায়সার, পরবর্তীতে ধরা পড়ার পর তাকে শনাক্ত করেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত (যেমন আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক মওলানা মান্নান যিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক ডা. আলীমের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করেছেন শহীদ পরিবার)। তিনি ও তার মতো অনেক আলবদর সদস্য মুক্তিলাভ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যায়। তারা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। অপেক্ষায় থাকে নতুন সুযোগের।

দূরদর্শী, সঠিক পরামর্শদাতা ও সকল দুঃসময়ের সঙ্গী তাজউদ্দীন আহমদের শত নিষেধ সত্বেও সব দল ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলুপ্ত করে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাকশাল। দলীয়, প্রশাসনিক ও স্বজনদের দুর্নীতি ও অরাজকতাও শক্ত হাতে দমন করতে ব্যর্থ হন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যসঙ্কট ও মার্কিন সরকারের খাদ্যকূটনীতির ফলে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত শিশুরাষ্ট্রে যখন হাহাকার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে তখন ওই সব ব্যর্থতার কারণে জনমনে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে।

সদ্যস্বাধীন নতুন রাষ্ট্রের সাবলীল ও বলিষ্ঠ বিকাশের জন্য যে ভিশন, চেতনা, প্রজ্ঞা ও আইনের শাসনের প্রয়োগ অপরিহার্য ছিল তার ব্যাপক অভাবের ফলে, আন্তর্জাতিক ও তাদের দেশীয় এজেন্টদের চক্রান্তের পথ উন্মুক্ত হয়। ঘটে যায় ১৫ অগাস্ট ও ৩ নভেম্বরের অমানবিক ও নির্মম হত্যাকাণ্ড।

আমি এক বেদনাবিধুর রক্তসিক্ত স্মৃতির বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আজকের জেলহত্যার রায়কে কেন্দ্র করে উপরোক্ত ঘটনাবলী ব্যক্ত করলাম। কারণ ১৫ অগাস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিত বোঝা ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার জন্য অতীত জানা আবশ্যক।

সবিশেষে এ আশাবাদ থাকবে যে আজকের এই রায় অদূর ভবিষ্যতে জীবিত ষড়যন্ত্রকারী, যারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, নথিপত্র বিনষ্টের মাধ্যমে ও আইনের ফোকর সৃষ্টি করে নিজেদের রক্ষা করেছেন তাদের এবং অনুল্লিখিত বাকি ঘাতকদের শনাক্ত করে তাদের বিচার করবে।

আজকের এ আংশিক রায়ে এবং জেলহত্যার বিচারে সমাপ্তি ও সম্পূর্ণতা আনার জন্য তা আবশ্যক। এ পদক্ষেপ প্রতিহিংসার নয় বরং তা হবে দীর্ঘবিলম্বিত সুবিচারের পথ খুলে দেওয়া। জেলহত্যাকারীদের বিচারের মধ্যে জাতি হয়তো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে যে, ন্যায়বিচারের দ্বার এ দেশে চিররুদ্ধ নয়। আজকের রায় হয়তো-বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতোই আরও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। ওই অধ্যায়টি উন্মুক্ত করবে দল-মতের উর্ধ্বে ন্যায়বিচারের আলোকিত পথ-সাধারণ-অসাধারণ সকলের জন্য।

আশাবাদ আরও থাকবে যে এই নয়াপ্রযুক্তির যুগে নতুন প্রজন্ম তাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্মের ও তার পরবর্তী সময়ের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস খুঁজে বের করবে। যাতে তারা খুঁজে নিতে পারে সঠিক পথটি এবং রোধ করতে পারে এধরনের নির্মম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

আমাদের নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করার এ গুরুদায়িত্ব দল ও মতের উর্ধ্বে আমাদের বিদ্বৎ ও সুশীল সমাজের সত্যান্বেষী সকলেরই।

লেখা সমাপ্তি ২ মে, ২০১৩