বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতি

খোন্দকার আশরাফ হোসেন
Published : 12 July 2010, 12:29 PM
Updated : 12 July 2010, 12:29 PM

প্রায়শ দুটো কথা বলা হয়ে থাকে মানুষ সম্বন্ধে: একটি হলো মানুষ অচিকিৎস্যভাবে ধার্মিক, অন্যটি, মানুষ অনিবার্যভাবে রাজনীতিলিপ্ত–হোমো পলিটিকাস। প্রথমটির ব্যাখ্যা সহজ: মানুষের ধর্মচেতনা তার মানবিকতারই একটি উপাদান। তার উৎস ও পরিণাম সম্পর্কে কৌতূহলী বলেই ধর্ম নামক এক প্রপঞ্চের জনক হয়েছে মানুষ। তবে এই ধর্মবোধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার সঙ্গে শতভাগ সমস্থানিক নয়। কিন্তু থাক সে কথা। রাজনীতিলিপ্ততারও সাধারণ ব্যাখ্যা সম্ভবপর। মানুষ সমাজে বাস করে; সেই সমাজসংগঠনের অন্যতম উপাদান রাজনীতি।

সুতরাং নিতান্ত আরিস্ততল-কথিত 'গড' অথবা 'বিস্ট' না হতে চাইলে মানুষকে কিয়ৎপরিমাণে রাজনীতিস্পৃষ্ট হতেই হয়। তবে এই সাধারণীকৃত অর্থ এতই সাধারণ যে একে অবলীলায় অবজ্ঞা করা চলে। রাজনীতি কথাটা রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে জড়িত, যে রাষ্ট্রসংগঠনের ইতিহাস সার্দ্ধশতাব্দীর অধিককাল নয়। এর আগে রাজা ছিল, রাজ্য ছিল, সুতরাং ছিল রাজনীতিও। কিন্তু সে-তো কেবল রাজার নীতি, রাজা এবং তার প্রাসাদের অমাত্যবর্গের আচরণীয় নীতি, তথা কূটকৌশল। প্রজার তাতে ছিল না কোনো ভাগ, কোনো সম্পৃক্তি। রাজনীতি কথাটি পরবর্তীকালে হয়েছে মিসনমার(ভূল অভিধা) এক; এর পরিবর্তিত নাম হওয়া উচিৎ রাষ্ট্রনীতি, যার পরিসরে শাসকের সঙ্গে সমভাবে প্রজারও সম্পৃক্তি রয়েছে।

পেরিক্লিসের যুগের পলিটিকস আর আজকের রাজনীতি তাই এক নয়। রাজনীতির তাত্ত্বিক দিক যেমন রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে প্রায়োগিক দিক। বুদ্ধিবৃত্তির যোগটি এর তাত্ত্বিক দিকের সাথে। মানুষের শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলির একটি রাষ্ট্রসংগঠন–বহু শতাব্দীর ইউটোপীয় স্বপ্নকল্পনার নিরাকরণ ঘটেছে আধুনিক রাষ্ট্রে। অষ্টাদশ শতকের বহুখ্যাত এনলাইটেনমেন্ট তথা বুদ্ধির আলোকসম্পাতী যুগে রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রনীতির রূপকল্পটি উপস্থাপন করেছিলেন জাঁ জাক্ রুশোর মতো ভাবুকরা–সামাজিক চুক্তির পাদপীঠে স্থাপিত হয়েছিল রাষ্ট্রের দোলনা। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ফরাসিবিপ্লব-উত্থিত প্রণোদনা আধুনিক রাষ্ট্রের পেছনকার চালকাশক্তি। বুদ্ধিবৃত্তির অবদানে, সুতরাং, রাজনীতির তাত্ত্বিক অবকাঠামো নির্মিত। কিন্তু রাজনীতির প্রায়োগিক দিকটির সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির যোগ বেশি নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে, মনে হয়, রয়েছে বৈরিতা। রাজনীতি যখন বোঝায় দৈনন্দিন দেশপরিচালনার গলদঘর্ম ও কূটকৌশলকণ্টকিত কর্ম, তখন বুদ্ধিবৃত্তি ও র্াশনালিটির দিকটি প্রায়শ হয় উপেক্ষিত।

উপযোগিতাবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজমের প্রেক্ষিতে পরিচালিত হয় রাজনীতি; সেখানে নীতির শুদ্ধতা রক্ষিত হলো কিনা দেখা হয়না প্রায়শ। দিনানুদৈনিক এই কূটকৌশলের বিখ্যাত ভাষ্যকার ম্যাকিয়াভেলি। তাঁর পরামর্শসমূহ যুগে-যুগে শাসকরা মান্য করেছেন। প্রায়োগিক রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বুদ্ধিভিত্তিক আদর্শবাদ বলি হয়ে গেছে অবলীলাক্রমে। মার্কস দেখেছিলেন সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন– তাঁর আগের সব ভাবুকদের মতো তিনিও ছিলেন মূলত কবি। প্লাটো কিংবা টমাস মূরের মতো শুধু য়ুটোপিয়ার সূক্ষ্মতন্তুজাল বয়ন না করে তিনি অবশ্য প্রায়োগিক সম্ভাব্যতার পথও দেখিয়ে যান। লেনিন করেন সেই প্রয়োগকর্ম, স্থাপন করেন সোভিয়েত নামক রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র তার বৌদ্ধিক অভীপ্সার লক্ষ্যবস্তু বিস্মৃত হয়েছে অচিরে–দিনানুদৈনিক প্রায়োগিক সমস্যা মেটাতে কক্ষচ্যুত হয়েছে মূল আদর্শ থেকে; জন্ম হয়েছে নিপীড়নমূলক শাসনযন্ত্রের; অবশেষে তার বিসর্জনপর্বও সাধিত হয়েছে যথারীতি।

রাজনীতির সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত হতে পারে আবেগও। যুগে-যুগে স্বাধীনতার জন্য, অধিকারের জন্য রচিত হয়েছে আবেগের রাজনীতির প্রেক্ষাপট। একটি জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য উদ্বেল হয় তখন তার বৌদ্ধিক পরিসীমাকে ছাপিয়ে যায় আবেগের বেনোজল। সে তখন "ন্যায়-অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি"– এরকম কৈবল্যে আক্রান্ত হয়, এবং তখন আবেগকম্পিতবক্ষে শুধু জপতে থাকে স্বাধীনতার নাম– "নাম, শুধু পরাক্রান্ত নাম।"

সেই মহান মাহেন্দ্রক্ষণ এক জাতির জীবনে বহুবার আসে না। যখন আসে, তখন শতাব্দীর নিপীড়ন-শোষণে মোহ্যমানা জাতিও বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ায়, বিভেদ ভুলে ঐক্যের মহামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় পাষাণপ্রাচীরের মতো শত্র"র বিরুদ্ধে। আঘাতে করে প্রত্যাঘাত। স্বাধীনতার সেই সংগ্রাম সবসময় বৌদ্ধিক যুক্তিপরম্পরাকে গ্রাহ্য করে না। যাঁরা বুদ্ধিজীবী নামধারী, বুদ্ধির ধারক-বাহক পণ্ডিত ও পণ্ডিতম্মণ্যের দল, তাঁরা বরং ঐ দুঃসাহসী, পরাক্রমী ও আপাত-বিধ্বংসী শক্তিকে ভয় পায়। সতর্ক করার নাম করে পেছন থেকে টেনে ধরে, নানারকম যুক্তির জাল বিস্তার করে থামিয়ে দিতে চায় আবেগকম্পিত উৎকাঙক্ষাকে। পরাধীনদেশের সেই মুক্তিকামী রাজনীতি বুদ্ধির তর্জনীকে উপেক্ষা করে; এমনকি অবিমৃশ্যকারী উল্লাসে ভাঙতে উদ্যত হয় প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকে এবং রাষ্ট্রকাঠামোকে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেখেছি, তাঁরাই হয়েছেন জনগণমনঅধিনায়ক যাঁরা বুদ্ধি এবং আবেগের মিশেল ঘটাতে পেরেছেন তাঁদের রাজনীতিতে। সুভাষচন্দ্র কিংবা চিত্তরঞ্জন বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমাপেও অসাধারণ ছিলেন। তবু স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর আবেগকে তাঁরা ধরতে পেরেছিলেন। তাঁদের যে-স্বপ্ন ছিল ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের তা যে সফল হতে পারেনি, তার পেছনেও সম্ভবত আবেগের রাজনীতির বিপদসমূহ। তুলনায় অনেক বেশি নিরাবেগ বুদ্ধিজীবী জিন্না ও নেহেরু, পেরেছিলেন কসাইয়ের মতো নির্লিপ্ততায় ছুরি চালাতে, মানচিত্রের ওপর শুধু নয়, ভারতবাসীর মানসচিত্রের ওপরও।

আজ মনে হয় বাঙালি জাতির আবেগপ্রবণতা না থাকলে বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হতো না। বাঙালির আবেগকে অনেকে গালমন্দ করে, বিশেষত দেশ ও মাটির জন্য তার আকুলতাকে অনেকে বাড়াবাড়ি বলে শনাক্ত করতে চায়। বাঙালির আবেগ তার অতীতকে নিয়ে। কবে কোনকালে ত্রিংশবৎসরাধিককাল আগে সে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল হাতে, পাকিস্তানি শত্র"দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, সেই স্মৃতিতে সে এখনো কাতর, এই কথা বলে ধমক-তিরস্কার নিত্য শোনা যায় কোনো-কোনো রাজনীতিকের মুখে। বাঙালির আবেগকে যাঁরা ভয় পেত একসময়, তাদের উত্তরপুরুষরা এখনও ভয় পায়। তাই ভুলিয়ে দেয়ার নানা প্রকল্প, নানা প্রচেষ্টা। একাত্তর সালে রাজনীতি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল আবেগের বন্যায়– আসলে প্রথাগত রাজনীতির অবসান ঘটে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। রাজনীতির মৃত্যু হয়েছিল হানাদারের কামানের গোলায়, মর্টারের মর্টাল আঘাতে। তারপর বেঁচেছিল শুধু বিশুদ্ধ আবেগ– অন্ধকারের সূচিভেদ্যতার মধ্যে আলোকরশ্মি খোঁজার আবেগ, নিজের মনুষ্যত্বকে চরমতম অবমাননা ও অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার আবেগ।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আবেগ ছিল : সে তখন একটি মহত্তম আবেগের নাম। ঐ একাত্তর সালেও বুদ্ধিবৃত্তি অসমর্থ হিংসুকের মতো টেনে ধরেছে পা, সরাসরি বিরোধিতা করেছে, নস্যাৎ করতে চেয়েছে সেই মহৎ আবেগকে। একদল বামপন্থী বুদ্ধিজীবী জাতির সেই ঘোর বিপর্যয়ের সময়ও পাতা খুলে বসেছেন তাঁদের বিপ্লবী পুঁথির; মেলাতে চেয়েছেন নানাদেশীয় পরীক্ষিত ছকের সঙ্গে, মেলাতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মুক্তিকামী জনগণ তাদের মতো বুদ্ধিমান নয় বরং আবেগতাড়িত হুজুগের দল, এরকম আত্মতৃপ্তির মুচকি হাসি হেসে মুক্তিযুদ্ধকে উপহাস করেছেন দুই 'কুকুরের লড়াই' বলে। আসল কথা তাদের মস্তিষ্কটি যে প্রভুর কাছে বাঁধা সেই প্রভু তখন তাদের নিষেধ করেছে মুক্তিযুদ্ধে জড়াতে। "বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হতো না'" এরকম একটি কথা প্রয়াত আহমদ ছফা প্রায়ই বলতেন বলে শোনা যায়। কথাটিতে সত্য আছে। জনতার অভিকাক্সক্ষাকে বোঝার এই অক্ষমতা শুধু বুদ্ধিজীবীরাই প্রদর্শন করেন তা নয় সবসময়। কবিরাও (তাদেরকে যদি বুদ্ধিজীবীদের বিচিত্র কৌতুকী দঙ্গল থেকে আলাদা করি) কখনও-কখনও একইরকম ভ্রান্তি এবং দূরদৃষ্টিহীনতার শিকার হন (কবিদের প্রবাদপ্রতিম স্বপ্নপ্রয়াণের সুখ্যাতি সত্ত্বেও)।

রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি চিন্তা স্বচ্ছ নয়; ভারতবাসীর উন্মথিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও তিনি একধরনের পরমহংস নির্লিপ্তি বজায় রাখতে পেরেছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় নাইটহুড পরিত্যাগ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বোধ হয়। ইয়েটস আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্পর্কে পরিহাস করেছেন; 'ইস্টার ১৯১৬' নামক কবিতার শুরুতে তাঁর নিজের জবানিতে সে-বর্ণনা আছে। রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা আন্দোলনকে তীর্যকতায় বিদ্ধ করেছেন 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে। ইয়েটসের সেই ভ্রান্তি ইস্টার বিদ্রোহের রক্তবন্যায় ভেসে গিয়েছিল; তিনি স্বীকার করেছিলেন তাঁর উন্নাসিক বুদ্ধিজীবী অহংকারকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে আপাত-হাস্যকর ঐ বীরেরা, যাদের ফাঁসি দিয়েছে ইংরেজ সরকার এবং তাদের শহীদী-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে "a terrible beauty is born."

আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবেগ উধাও হয়েছে অনেক আগেই; সেই প্রেক্ষাপটও হয়তো নেই। শোচনাযোগ্য যে, উধাও হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিও। রাজনীতি এখন পেশি-নির্ভর, সন্ত্রাসবাহিত ও মাস্তানময়। রাষ্ট্রের কাঠামো কুরে কুরে খাচ্ছে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের ঘুণ। যে বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিকদের অভিপ্রায়কে মান্যতা দেয়ার জন্য নিজেদের লাজলজ্জা পর্যন্ত বিসর্জন দেন, ক্ষমতায় যাবার পর তাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় দুএকটা ছুটকো চাকরির হাড়। আবার কেউ-কেউ সেই উঞ্ছলাাভেও ব্যর্থ হয়ে নিজেদের থাবা চাটতে থাকেন এবং অপেক্ষায় থাকেন কী করে পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীরাও এখন অপরিহার্য নয়– প্রয়োজন ফুরালে তাদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় পেশিবাজ-ধড়িবাজেরা। বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবী এখন রাজনৈতিক ভাগাড়ে বসে-বসে মৃত্যুর দিন গুণছেন। তাদের এই অবস্থা অনেকের চক্ষু উন্মীলনের জন্য হতে পারে যথার্থ অঞ্জনশলাকা।