দুই নেত্রীকে এরশাদের পত্র প্রদান প্রসঙ্গে

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 11 April 2013, 10:35 AM
Updated : 11 April 2013, 10:35 AM

সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁর স্বভাবসুলভ কায়দায় চলমান রাজনীতিতে আবারও একটি কৌশলী ট্রাম্পকার্ড ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর ভাষায় তিনি 'একান্তভাবে বিবেকের তাড়নায় দেশের এ ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্নে' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে 'বিরাজমান সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের' করার জন্য দুটি পত্র পাঠিয়েছেন। পত্র আসলে একটি, তবে দুজনের পত্রে ভাষা কোথাও কোথাও ভিন্নরূপ। দুটি পত্রেরই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এক হলেও বক্তব্য সর্বাংশে এক নয়। এতে দুজনের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়নেরও প্রকাশ ঘটেছে। এই মূল্যায়ন অভিন্ন বা সমতাসূচকও নয়। অথচ এ-ধরনের সমঝোতা-প্রত্যাশী পত্রে সৌজন্যের স্বার্থে মূল্যায়ন সমরূপ হওয়া বাঞ্চনীয়। আমরা পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি পত্রের ভাষা ও বক্তব্যের তুলনামূলক আলোচনা করেই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে চাই।

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার জন্যে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগ আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই এই পর্যবেক্ষণ। তবে আমরা বিস্মৃত হইনি তাঁর নিত্যবদলপ্রবণ, হাস্য-উদ্রেককারী ও বহুরূপী ভূমিকায় অভিনয়ের কথা, যা তিনি বার বার রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সংহত করার জন্যেই করে চলেছেন। কেননা স্বৈরশাসক এরশাদকে শিল্পী কামরুল হাসান যে 'বিশ্ববেহায়া' খেতাবে ভূষিত করেছিলেন, সেই কলঙ্ক-ভূষণ এখনো তার গলার কাঁটা হয়ে আছে। এই কাঁটা থেকে মুক্তির জন্যে তাঁর যে রাজনৈতিক প্রায়শ্চিত্ত প্রয়োজন, তা এতদিনেও সম্পন্ন হয়নি। বরং এবারের গণজাগরণ মঞ্চের মূল ইতিবাচকতাকে সর্বাংশে অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁর বিশ্ববেহায়া রূপটি আরো বিকটদর্শন করে তুলেছেন। তবে এ-ও সত্য, তিনি সুযোগ পেলেই তওবা করার মওকা হাতছাড়া করেন না। তার সর্বশেষ প্রমাণ অতিসম্প্রতি 'হেফাজতে ইসলাম'-এর লংমার্চ-এ তাঁর দলের উপস্থিতি ও নিশর্ত সংহতি। একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো উদ্যোগে সমর্থন দেয়া এক কথা, আবার উদ্দেশ্যসাধনের পর-মুহূর্তে অন্য কথা বলা আসলে অনৈতিক ডিগবাজি। আমরা দেখছি, লংমার্চ শেষ হওয়ার পরপরই তিনি ও তার দল লেবাস পরিবর্তন করে হেফাজতে ইসলামের ঘোষিত দাবির প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই অভিনব ও আদর্শহীন ডিগবাজি অন্য কোনো শীর্ষ নেতা বা দলের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় না। এই সুবিধাবাদী ডিগবাজির কারণেই স্বৈরশাসক এরশাদ ও তাঁর যে কোনো উদ্যোগকে জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। তাই 'জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও' 'ভারাক্রান্ত মনে' তাঁর যে 'প্রার্থনা', তা-ও তার শেষ কথা কিনা, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় আছে। তবে এ-কথা বোধ হয় স্বীকার্য যে, এই পত্রের মাধ্যমে তিনি সরকার, বিরোধী দল ও অন্যান্য পক্ষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার একটি সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। তার ফলে বর্তমান সংকট-মুহূর্তে যদি দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল হয়, তার জন্যে আমরা তাঁকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো।

জনাব এরশাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তাঁর পত্রের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, 'আপনার দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা আমার কাছে প্রশ্নাতীত।' আমরা বিশ্বাস করতে চাই এটি একটি সত্যভাষণ। আবার মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে প্রেরিত পত্রে তিনি লিখেছেন, 'আপনার দেশপ্রেম আমার কাছে প্রশ্নাতীত।' অবশ্যই সমর্থনযোগ্য উক্তি। কিন্তু এখানে বিরোধী দলীয় নেত্রীর 'জনগণের প্রতি ভালোবাসা' বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ফলে দুই নেত্রীর প্রতি তার মূল্যায়ন যে ভিন্নরূপ, তা সহজেই অনুমেয়। এটিকে অসতর্ক বিচ্যুতি বলার কোনো কারণ নেই। কেননা দুটি পত্রের ভাষাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিন্ন হওয়ায় ভিন্নতাগুলো যে সচেতনভাবে করা হয়েছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উভয়পত্রে ঠিক পরবর্তী বাক্যটি হুবহু সমরূপ : 'সেই বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই নিবেদন করছি, আসুন বিগত দিনের সকল তিক্ততা ভুলে গিয়ে বিরাজমান সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করি।' যেহেতু দুজনের প্রতি মূল্যায়নে হেরফের আছে, সেহেতু দুজনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এক বলে মনে হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে লেখা পত্রের আরেকটি অংশেও এই ভিন্নতার সুচতুর প্রতিফলন ঘটেছে। জনাব এরশাদ লিখেছেন, 'আপনি বিরোধী নেতাকে ডাকুন, আমাকে ডাকুন, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের নেতাকে ডাকুন, দেশবরেণ্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে ডাকুন। আমার বিশ্বাস আপনার আহ্বানে সবাই সাড়া দেবেন। যদি কেউ না আসেন, তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন।' এই অংশের শেষবাক্যটি অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। যিনি আসবেন না তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন কিনা এই আগাম সংশয় প্রকাশ করা কোনো ইতিবাচকতা নয়। দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রধান বিরোধীদল শর্তবিহীন ও প্রকাশ্য এজেন্ডাবিহীন আলোচনায় আসবেন কিনা, এ-সম্পর্কে আমরা সুনিশ্চিত নই। বরং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এজেন্ডা ছাড়া বিএনপি আলোচনায় বসবে না বলেই বরাবার ঘোষণা দিয়ে আসছে। এই সিদ্ধান্ত থেকে তারা এখনো নতুন কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। এ-কারণেই তাদের এই লাগাতার হরতাল ও সহিংস কর্মসূচী।

কাজেই তাদের কাছ থেকে শর্তহীন আলোচনায় যোগ দেয়ার সদিচ্ছা ব্যক্ত করার পূর্ব-পর্যন্ত অনুরূপ পত্র পাঠানো একটি কৌশলগত চাল হলেও সমাধানযোগ্য পদক্ষেপ বলে মনে হয় না। বরং এ-রকম পত্র প্রেরণের পর বিরোধী দলীয় নেত্রী যদি সাড়া না দেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন। এক্ষেত্রে এ-রূপ অনিশ্চিত পত্র বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলতে পারে। আসলে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে বৈঠক মানেই চলমান রাজনীতিতে একটি শীর্ষতম বৈঠক, যা ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও জাতি চরমতম অনিশ্চয়তার সংকটে নিপতিত হবে। তাই এই মুহূর্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পত্রপ্রদান ও দুইনেত্রীর মধ্যে প্রস্তুতিহীন বৈঠক কোনো সুস্থ পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে হয় না।

বরং এই ধরনের শীর্ষ বৈঠকের আগে দুই প্রধান দল ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দল, গ্রুপ বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধির মধ্যে বৈঠক করে শীর্ষবৈঠকের আলোচ্য ও ঘোষণা ঠিক করাই যুক্তিযুক্ত। এই প্রস্তুতি-বৈঠক অনধিক এক সপ্তাহের মধ্যে সমাপ্ত করে তার সুপারিশ জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাবনা আকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে প্রদান করা যেতে পারে। তারপর অনধিক দুই সপ্তাহের মধ্যে শীর্ষবৈঠক করে সকলের মতৈক্যের ভিত্তিতে বর্তমান সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসা যেতে পারে। আর এই সমঝোতার মূল নিয়ামক হতে পারে পারস্পরিক আস্থা, সহিষ্ঞুতা, সদাচার, প্রতিশোধহীনতা, অহিংসা, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাকার ইতিবাচকতা। এই ধরনের মানবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে তার উত্তরও সহজ হয়ে আসবে। তাই 'যদি কেউ না আসেন, তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন' – এই কূটজালে জড়িয়ে কাউকে প্রত্যাখ্যান করা বা অনুরূপ প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সর্বাংশেই অযৌক্তিক ও অসমীচীন। এটি জাতির অনৈক্য আরো মারাত্মক করে তুলবে।

অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জনাব এরশাদ উভয় পত্রে কিছু সাধারণ সংকটের কথা বলেছেন, যার সঙ্গে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক হিংসা, জেদ, অশ্রদ্ধা, তিক্ততা, মানবিকতাবোধের বিলুপ্তি, মানুষের অবর্ণনীয় মৃত্যুদৃশ্য, সভ্যতার মুখে কালিলেপন, দুনিয়ার কাছ থেকে ঘৃণা কুড়ানো ইত্যাদি। তবে তিনি যে বর্তমান সংকটকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট বলে চিহ্নিত করেছেন, তার সঙ্গে আমরা একমত নই। আমরা মনে করি, আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেনতনাবাহিত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট ছিল উনিশশ পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, যার ফলে বাঙালি জাতি আজো সমাধানহীন সঙ্কটের আবর্ত থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।

তারপরের প্রধান সঙ্কটগুলোর মধ্যে রয়েছে এরশাদের ম্যারাথন স্বৈরশাসন ও এক-এগারোর গণতান্ত্রিক বিপর্যয়। আমরা শেষোক্ত দুই সঙ্কট থেকে দৃশ্যত নিষ্কৃতি পেলেও পঁচাত্তর-উত্তর সামরিক শাসন ও সাংবিধানিক পরিবর্তন আমাদের মানবসাম্যপ্রত্যাশী সমাজে যে সমাধানরহিত সংকটের সৃষ্টি করেছে, তার দুষ্টবলয় থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। বর্তমান ক্ষমতা-লিপ্সার রাজনৈতিক সংকট আসলে সেই সঙ্কটেরই সম্প্রসারণ মাত্র। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সব দল ও নেতানেত্রীকে সব ধরনের আত্মস্বার্থ, পরিবারস্বার্থ, গোত্র-স্বার্থ, দল-স্বার্থ ইত্যাদির বাইরে এসে জনগণের স্বার্থ-সাম্যের কথাই সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। কেননা এই জনগণের ভোট কুড়িয়ে বা বাক্সবন্দী করেই তাঁরা ক্ষমতার আসনে বসেন ও টিকে থাকার মরণ লড়াইয়ে লিপ্ত হন। এক কালের স্বৈরশাসক এরশাদও এর ব্যতিক্রম নন। বর্তমানে গদীহীন এরশাদ যে 'শান্তি, নিরাপত্তা, দেশের অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে' পরিত্রাণের উপায় খুঁজছেন, এটিও আমাদের রাজনীতিকদের জন্যে একটি ইতিবাচক শিক্ষা। আমাদের সব মান্যবর নেতা-নেত্রী জনস্বার্থে তাঁদের তাবৎ জেদ ও তিক্ততা পরিহার করে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ও পদ্ধতিগতভাবে এক টেবিলে বসে বিরাজমান সংকটের সুরাহা করবেন, এটিই আমাদের মতো আমজনতার একমাত্র প্রত্যাশা। আমরা আশাবাদী, কেননা হাজার বছর ধরে গণবাঙালি সকল সংকটে নিজেকে অজেয় প্রমাণ করেছে।
১১.০৪.২০১৩

মুহম্মদ নূরুল হুদা: কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ।