কে হবেন সকলের গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি?

চিন্ময় মুৎসুদ্দী
Published : 3 April 2013, 08:54 AM
Updated : 3 April 2013, 08:54 AM

জুনের মধ্যেই আমাদের একজন নতুন রাষ্ট্রপতি পেতে হবে। এটা সংবিধানের বাধ্যবাধকতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য দৃশ্যত কোনো চিন্তা নেই। জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পছন্দের যে কোনো ব্যক্তিকে দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারবে। কিন্তু একটু 'গোল' বাধিয়েছে বিএনপি ও অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারা বলছেন, সকল মহলের গ্রহণযোগ্য কাউকে রাষ্ট্রপতি করা না হলে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের এই দাবির প্রতি গুরুত্ব না দিলেও সরকারি দলের ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এখন তাদের ভাবতে হবে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।

সাধারণ নির্বাচনের আগেই আসছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। বিএনপি-র জন্য এটা নতুন এক ইস্যু। বিএনপিসহ কয়েকটি দলের দাবি অনুযায়ী নির্দলীয় দূরে থাক, সকলের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনীত করার ইচ্ছা আওয়ামী লীগের আছে বলে মনে হয় না।
কারণ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া কারোর জন্যই 'ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রপতি' সুখকর হয়নি। ১৯৯৬ সালে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ-কে রাষ্ট্রপতি করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০১ সালে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা হওয়ার পর বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ'র বিরুদ্ধে এক ঝাঁক অভিযোগ তোলেন। একটানা অভিযোগে স্বল্পবাক নম্রভাষী বিচারপতি শাহাবুদ্দীন বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত মিডিয়ায় বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। আর 'ব্যতিক্রমী' হতে গিয়ে ২০০২ সালে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাত মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পদত্যাগের আগে রাষ্ট্রপতির প্রটোকল থেকেই তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিএনপি ছাড়তে হয় এই প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিবকে। ১৯৭২ সালেও আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে রাষ্ট্রপতি করা হয় বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে। তিনিও স্বল্প সময় পর পদত্যাগ করেন, তবে তাঁকে সরকারিভাবে বিদেশে বিশেষ করে, ইউরোপে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকারের তিন বেসামরিক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সাদত মুহাম্মদ সায়েম এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীর দিনও খুব ভালো কাটেনি। তবে মহম্মদউল্লাহ, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন আহমদ ও মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান'র কোনো সংকট হয়নি প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। এরই ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপি'র আন্দোলনের রোডম্যাপ ওলোটপালট হয়ে গেছে। 'ব্রুট মেজরিটি'র বলে সরকারি দল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার পর বিএনপি'র প্রধান দাবি দাঁড়ায় তত্ত্বাবধায়ক (বা নির্দলীয়) সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন। এই দাবি আদায়ে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের ভিত তৈরি করছিল। তাদের হয়ত হিসাব ছিল নির্বাচনের কয়েক মাস আগে আন্দোলন তীব্র করবেন এবং সত্যিকার কঠিন কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু তার আগেই নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হল গণজাগরণ মঞ্চের আবেগময় দাবি নিয়ে শাহবাগ চত্বরে সমাবেশ শুরু হওয়ায়। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শুরু হওয়া তরুণ প্রজন্মের অভূতপূর্ব এই আন্দোলনে প্রায় চাপা পড়ে গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি।

তাৎক্ষণিক লাভবান হল আওয়ামী লীগ। ক্ষতিগ্রস্থ হল বিএনপি। সম্ভবত এই জন্যই আওয়ামী লীগ কালবিলম্ব না করে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সরকারি ও দলীয় পর্যায়ে একাত্মতা ঘোষণা করে, আর বিএনপি কিছুদিন পর নতুন প্রজন্মের এই তৎপরতাকে অভিহিত করে সরকারের সাজানো নাটক বলে।

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিতে পার্লামেন্টে আইন পাস করা গেলেও অনেক সময় পরিণতি সুখকর হয় না। সে কারণে সংবিধান একতরফাভাবে সংশোধন করা সংসদীয় গণতন্ত্রের কনভেনশন পরিপন্থী। বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা না হলে সাধারণত গণভোটের আয়োজন করা হয়। সমঝোতা হলেও অনেক ক্ষেত্রে গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়। অতীতে একতরফা সংবিধান সংশোধন দেশকে বারবার সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে, বাকশাল গঠন বলি বা সামরিক আইনের বৈধতা দেয়া বলি। সেই বোঝা আমাদের এখনও টানতে হচ্ছে। এবারও পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। এখন টানতে হচ্ছে এর জের। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী অন্তত আরো দুই মেয়াদের জন্য চালু রাখা হলে এই সময়ে বিএনপি'র আন্দোলনেরই প্রয়োজন পড়তো না। সেই ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণায় জামায়াতকে ততটা গুরুত্ব না দিয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হতো বিএনপি'র পক্ষে। কিন্তু বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নিতে গিয়ে সরকার বরং তাদের আরো কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।

সামনের সাধারণ নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আরেকটি প্রাক নির্বাচনী ইস্যু হয়ে গেল। দুই বড় দল এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের বরফ কিছুটা হলেও গলাতে পারেন। প্রাক নির্বাচনী প্রধান ইস্যু অর্থাৎ নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ জটিলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংলাপের ভিত্তি রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে সমঝোতার মাধ্যমে স্থাপন করা যায়। বিএনপি সর্বজন গ্রহনীয় রাষ্ট্রপতি চাইছে আগামী নির্বাচনে যাতে প্রয়োজনে তিনি অন্তত ভারসাম্য রক্ষা করেন। আওয়ামী লীগ এ নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। তারা আগামী নির্বাচনে বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেই মনোনীত করতে চাইবে, যাতে কোনো সংকট দেখা দিলে রাষ্ট্রপতিকে নিজেদের পক্ষে পান। উভয়ের চাওয়া তাদের জন্য স্বাভাবিক। তবে সব চাওয়া কি পূরণ হয়? এই দিকটা তাদের মনে রাখতে হবে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নের বাইরে কেউ প্রার্থী হবেন না এটা প্রায় নিশ্চিত। কারো দাঁড়ানোও হবে অর্থহীন। বিএনপিও নিজেদের কোনো প্রার্থী নিয়ে ভাবছে না, তারা তাদের দাবির কথা জানিয়েছে শাসক দলের কাছে। রাষ্ট্রপতি মনোনীত হবেন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। এটাই বাংলাদেশের রেওয়াজ। এ পর্যন্ত সেরকমই হয়েছে উভয় দলের ক্ষেত্রে। তবু অনানুষ্ঠানিক আলোচনা রয়েছে শাসক দলের মধ্যে। সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনজনের নাম মিডিয়ায় এসেছে। একাধিক মিডিয়া স্পিকার আব্দুল হামিদ ও জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেছে। সংসদ কার্যক্রম পরিচালনায় স্পিকার আব্দুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী বা দলকে অখুশী করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা যায় না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরই মধ্যে তিনি সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে চার বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন করেছেন কোনো প্রশ্ন না তুলে। কথাটা বল্লাম এই কারণে যে এদের একজনের বিরুদ্ধে সুপ্রীম জুডিশিয়্যাল কাউন্সিলে দুটি অভিযোগ বিচারাধীন রয়েছে, সেই বিচারপতি স্পিকার আবদুল হামিদকে আদালতে 'রাষ্ট্রদ্রোহী' হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। সংসদ সদস্যরা এই বিচারপতিকে অপসারণের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে স্পিকার তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে উল্লেখ করেন। এরপর স্পিকার একটি রুলিং দেন। তাতে এই বিচারপতির অসৌজন্যমূলক বক্তব্য ও অসদাচরণের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ভার প্রধান বিচারপতির সুবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এ থেকে স্পষ্ট যে স্পিকার আব্দুল হামিদ এখন সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না। এই ঘটনায় বিএনপি কিছুটা বিচলিত। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এরই মধ্যে এ ব্যাপারে জাতি বিস্মিত বলে বিবৃতি দিয়েছেন। তারপরও সোজাসাপটা কথা বলার মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। তার এই খ্যাতি আবার বিড়ম্বনার কারণ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সংসদের উপনেতা হিসেবে সাজেদা চৌধুরীর চোখে পড়ার মতো কোনো ভূমিকা নেই। এটা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট হতে পারে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদ একটি নতুন উপাদান যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি হলে তার দল সমর্থন দেবে। এজন্য অবশ্য সংসদে জাতীয় পার্টির সমর্থন না লাগলেও রাজনৈতিক সমর্থন শেখ হাসিনাকে শক্তিশালি করবে। এরশাদের এই কথা কি কেবল তারই কথা? এ নিয়েও আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

শেখ হাসিনা সত্যিই যদি রাষ্ট্রপতি হতে চান তবে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতে ফিরে যাবে অথবা সংসদীয় পদ্ধতি বহাল রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো হবে। বিএনপি এর কোনোটার সঙ্গে একমত হবে বলে মনে হয় না। তারপরও দ্বিতীয় অপশন বাস্তবায়িত হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জিতলে রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনা আর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ ও বঙ্গভবন বর্জন করবেন কিভাবে?

এটা এখনও অপরিপক্ক বিষয়। তাই আলোচনা প্রচলিত ব্যবস্থায় সকলের গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি নিয়েই অব্যাহত রয়েছে। তবে দুই দলের অতীত অভিজ্ঞতা আর বর্তমান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে, আসলেই সকলের গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্যে জুটবে বলে মনে হয় না। অবস্থা এখন এমন যে বিএনপি আওয়ামী লীগেরই কারো নাম গ্রহণযোগ্য বলে মত দিলে হয়ত সেই ব্যক্তির কপালটাই বরং পুড়বে! তবু আমরা আশাবাদি। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কথা ভেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবে।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী: লেখক, সাংবাদিক।