ম্যানুয়েল ডি বারোসের কবিতা

মাজুলহাসান
Published : 21 Oct 2016, 05:41 AM
Updated : 21 Oct 2016, 05:41 AM

ব্রাজিলের কবি ম্যানুয়েল ডি বারোস। পুরো নাম ম্যানুয়েল ওয়েসেসলাও লেইতে ডি বারোস। বিশ্বসাহিত্যে সেই অর্থে বহুল পরিচিত ও পঠিত না হলেও ব্রাজিলিয়ানদের কাছে তিনি এক অলঙ্ঘনীয় কবিচরিত্র। জন্ম ১৯১৬'র ১৯ ডিসেম্বর কিউবায়। মৃত্যু ১৩ নভেম্বর ২০১৪, ব্রাজিলের কাম্পো গ্রান্ডে। প্রায় ৯৭ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি লিখেছেন অজস্র কবিতা। লাভ করেছেন বহু পুরস্কার। ব্রাজিলের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার প্রেমিও জাবুতি বা টরটোয়েস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন দুই বার। সামগ্রিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন 'National prize of Literature of the Ministry of the Culture from Brazil' পুরস্কার। ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্ততুল্য কবি কার্লোস দ্রুমন্ড ডি অ্যান্ড্রেড বারোস'কে বলেছিলেন কবিশ্রেষ্ঠ। পর্তুগিজ ভাষার এতো বড় একজন কবি, কিন্তু দুঃখজনক হলো তার সৃষ্টি দেশের গণ্ডি পেরুতে পারেনি। বারোসের কবিতার প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র ইংরেজী সংস্করণ Birds for a Demolition। কার্নেগি মিরান ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বের হয় ২০১০ সালে। অনুবাদ করেন ইদ্রা নোভি, যিনি নিজেও একজন উদীয়মান মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক ও ফিকশন লেখক। মূলত তার অনুবাদের পর বারোসকে চেনে বিশ্ব। Birds for a Demolition–এর রিভিউয়ে এক লেখক আক্ষেপ করে বলেছিলেন- এটা দুঃখজনক যে এমন একজন শক্তিশালী কবির কবিতা এতোদিন ইংরেজিতে অনুবাদই হয়নি। পর্তুগিজের বাইরে বারোসের কবিতা প্রথম অনুবাদ হয় জার্মান ভাষায়, ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৩-এ ফরাসি ও ২০০৫-এ স্প্যানিশ ভাষায় বের হয় বারোসের কবিতা সংকলন। বাংলায় মেনুয়্যাল ডি বারোসের কবিতার অনুবাদ এই প্রথম। ইড্রা নোভি'র ইংরেজি সংস্করণ থেকে বারোসের কবিতাগুলো ভাষান্তর করেছেন কবি মাজুল হাসান

প্রথম দিন

গতকাল বৃষ্টি ঝরেছিল ভবিষ্যতে
জল শুষে নিয়েছিল আমার বিহ্বলতা
ঘুমপোশাক
বাসনকোশন
একটা ছিপির মতো ভেসে গিয়েছিলাম বানের তোড়ে
ডাকটিকেটের মতো হালকা আমার ডোঙ্গানৌকা
জলের নেই কোনো সীমা-পরিসীমা
দেখা যাচ্ছে শুধু আকাশ আঙিনার আভাস
(শকুনি কি আমাকে দেখছে শ্যেন দৃষ্টিতে?)
পাতার সাথে সার বেধে আছি দাঁড়িয়ে
পামগাছের গোড়া থেকে কারান্ডা ফল খেয়ে যাচ্ছে মাছ

সাক্ষাত

পেদ্রো নরাটো'র শরীরে তেইশ বছরের নিঃসঙ্গতা
পা ফাঁক করে ঘুমিয়ে পড়েছে মৃত্যু…
জেলখানার শিকের মাঝখানে আপনাআপনি গজিয়েছে আগাছা
সাথে উরুযুগলের ক্ষয়িষ্ণু ঘুম
নোরাটো বলল- পানপাত্রের ভেতর ও একটা নারীকে পেয়েছে, তারপর গিলেও ফেলেছে
এটা প্রেমহীন অবস্থায় ঈশ্বরের সাথে নিজেকে আবিষ্কারের মতো
ও বলেছিল- পৃথিবীটা ঘোড়ার মতো নিখুঁত নয়
ঘড়ির মধ্যে ও দেখতে পায় জলের কলস্বর
মাছিদের জন্য বাজায় স্যালুট
আর আমি নর্দমা ধরে বাড়ি ফিরে আসি

পাথর

আমি পাথর বলে
আনন্দ আছে মাঠে এলিয়ে পড়ার
কষ্ট বলতে শুধু সরীসৃপ আর প্রজাপতিদের
জনৈক ডিমেরা আশ্যয় নেয় কোটরে আমার
ফাঁটলে গজিয়ে ওঠে জলাধার
চঞ্চুর ধার বাড়াতে আমাকেই ব্যবহার করে পাখিরা
কখনো সারাটা দিন দখল করে রাখে একলা কাক
আমোদ লাগে
পাথর হওয়ার ভিন্ন সুবিধাও আছে
এক- আমি জ্বালাতন করি পতঙ্গের নিস্তব্ধতা
দুই- নিঃসঙ্গতায় ঢালি চন্দ্রালোকের শব্দ
তিন- সকালে আমার শিশিরস্নান
চার- এবং সবার আগে আমাকেই অভিবাদন জানায় সূর্য।

তৃতীয় দিন

পাখিদের জন্যই নীরবতা ঢেলে দেয় চাঁদ
– এই স্ক্যান্ডেল আমার জানা
আমাকে ঢুকিয়ে নিয়েছে অভ্যন্তরে- ভেবেছিল লাল পারফিউম
(আমি কি ধারণ করি গোধূলির লাল?)
এইসব শূন্যচিন্তা আমাকে আটকে ফ্যালে আরও
অথচ কতগুলো টুকরো আমি এরইমধ্যে নির্বাসিত
***
(শুভবুদ্ধিই কি তবে বাড়িয়ে দেয় বিমূর্ততা?)
রাতে পান করি লাঞ্চবক্সের পানি
আত্ম-রক্ষণাবেক্ষনে ব্যবহার করি মদ
আর যা কিছু উগরে দেই তাতে থাকে না কোনো ঐশ্বর্য
মার্জিত- আমায় ক্ষমা করবেন

অসুখ

কাউন্ট্রি থেকে কখনো দূরে থাকিনি
যাহোক দূরত্বে কষ্ট হয় আমার
ছেলেবেলায় দেখেছি মায়ের এই রোগ ছিল
উনার কাছ থেকেই আমি এটা পেয়েছি
পরে বাবা একটা জায়গায় কাজ করতে গেলেন
রোগটা ছড়িয়ে পড়লো ওখানকার লোকজনের মধ্যে
জায়গাটা ছিল পায়ের বুড়ো আঙুলে নখের মতো দুনিয়ার শেষপ্রান্তে
আশপাশে ঘরবাড়ি ছাড়া বেড়ে উঠলাম আমরা
যেখনে পাখি, বৃক্ষরাজি, একটা নদী আর নদীর মাছ
ওখানে ঘাসের ঝোপঝাড়ে লাগামছাড়া ঘোড়া
প্রজাপতিতে ছেয়ে থাকতো ওদের পিঠ
বাকিটা শুধু দূরত্ব
দূরত্ব সেই শূণ্যবস্তু যা আমরা বয়ে বেড়িয়েছি চোখে
বাবা ওটাকে বলতেন নির্বাসন

উদ্ভাবনের পাঠ

গাছের স্থিতিতে ঢুকতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন
গিরগিটির মতো ক্ষীণবুদ্ধির উভচর হওয়া
আগস্ট মাসের এই বিকেল ৩টায়
দুবছরের মধ্যে বুনো ঘাস আর নিষ্ক্রিয়তা
বাড়তে শুরু করবে তোমার মুখে। সমস্যা বলতে আমাদের
শুনতে হবে ছোট্ট একটা লিরিক্যাল ডিকম্পোজিশন
যতক্ষণ পর্যন্ত না বুনো ঘাসগুলো আমাদের কথায় পর্যবসিত হয়
এখনকার জন্য, আমি তৈরি করেছি গাছের গন্ধের নকশা

যুদ্ধ

তড়িঘড়ি ঘোড়ায় করে দূতের হাতে সম্রাটের কাছে চিঠি পাঠালেন মেয়র।
তাতে লেখা: নগরীতে প্যারাগুয়েন সৈন্যরা হামলা করছেন, সত্বর সাহায্য প্রয়োজন।
সম্রাট দূতের কাছ থেকে চিঠিটা পেলেন দু'মাস পর।
যখন সহায়তাকারীরা এসে পৌঁছালো, তখন প্যারাগুয়েনরা ওখান থেকে চলে গ্যাছে।
সম্রাটের লোকজন তাই ফিরে এলো পনের যুবতী ও যাত্রাপথের জন্য যতসামান্য রসদ নিয়ে।
আমার মনে হয় ওরা এর পুরোটাই সাবাড় করেছিল।
করুম্বা এমন এক শহর, যার বাসিন্দারা খুব ভালোভাবে মিশে গ্যাছে প্যারাগুয়েনদের সাথে।