সেই দ্যুতি, সেই স্মিতহাসি

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 21 March 2013, 12:42 PM
Updated : 21 March 2013, 12:42 PM

বাংলাদেশের ১৯তম মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা মো. জিল্লুর রহমান। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তার বহুমাত্রিক জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে ২০ মার্চ ২০১৩ তারিখে, ৪টা ৪৭ মিনিটে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এই মরলোক ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অমরার দিকে। তার আগে এই মর্ত্যলোকেই তিনি কাটিয়েছিলেন ৮৪ বছরের এক ঘটনাবহুল জীবন। পরলোকে যেখানেই থাকুন তিনি পরম শান্তিতে থাকুন, এটিই আমাদের সমবেত প্রার্থনা।

একাল ও অনাগত কালের মর্ত্যবাঙালির বুকে তিনি অমর থাকবেন নিঃসন্দেহে; কেননা তিনি সর্বকালের এক মহান বাঙালি, আর গণমানুষের সার্বিক মুক্তিতে নিবেদিত এক আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ। বাঙালিত্ব, আদর্শবাদিতা, সংগ্রামশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক সহিষ্ণুতা তার চরিত্রের শনাক্তযোগ্য বেশিষ্ট্য। তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাঁকে বাঁকে আমরা এই গুণাবলীর পরিচয় পেয়েছি বারবার। প্রচারণার চেয়ে কর্মনিমগ্নতাই ছিল তার যাপিত জীবনের মূল মন্ত্র। এক্ষেত্রে আমাদের কালে তার দৃষ্টান্ত প্রায় দ্বিতীয়রহিত। বলা যেতে পারে, মানবিক সদাচারবাহিত এই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যই এই অশীতিপর মানুষটিকে আমাদের সময়ের এক অনুসরণযোগ্য রাজনীতিবিদের মর্যাদা দিয়েছে। স্মরণকালের নিষ্ঠুরতম সময়ের অধিবাসী হয়ে আমরা অনেকেই যখন অপন আপন অঙ্গনে সীমালঙ্ঘনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন তিনি ছিলেন স্থিতধী, শান্তশ্রী ও ন্যায়দ-ধারী। যেন এক নৈয়ায়িক বাতিঘর। আসলে এটিই একজন দেশনায়কের কাছে সর্বস্তরের জনগণের পরম প্রার্থিত বিষয়। আমাদের সৌভাগ্য, এই নম্র-ভদ্র সৌম্যদর্শন প্রাজ্ঞজনের মধ্যে আমরা আমাদের কালের সেই বিবেকবান অভিভাবককেই খুঁজে পেয়েছিলাম।

না, হঠাৎ করেই এমনটি ঘটেনি তার মধ্যে। এটি তার সারাজীবনের কর্মসাধনারই ফলশ্রুতি মাত্র। আমরা অর্থ, পদ ও ক্ষমতার লোভে কতো রাজনীতিক উচ্চাভিলাষীকেই তো দেখেছি মতবদল, দলবদল বা নেতাবদলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে। অথচ ছাত্ররাজনীতির সেই কৈশোর থেকে শুরু করে বার্ধক্যে রাষ্ট্রপতির পদে বৃত হওয়া পর্যন্ত এই অঙ্গীকৃত রাজনৈতিক কর্মী কখনো তার মত ও পথ থেকে একবারের জন্যেও বিচ্যুত হননি। ১৯৪৬ সালে ছাত্ররাজনীতি করার সময় তিনি সিলেটে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসেন। তারপর ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্য রাজনীতিতে যুক্ত হন। সেদিন ছিল ঢাকার সুবিখ্যাত রোজ গার্ডেনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যাত্রাশুরুর দিন। সেদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সেই যে শুরু, তার আর শেষ বলে কিছু নেই। একজন নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবক থেকে নৈয়ায়িক রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক রাজনীতিযোদ্ধা। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি নিজের বা পরিবারের বা দলের চরমতম দুর্দিনেও। দীর্ঘ চৌছট্টি বছরের এই ধারাবাহিকতায় তিনি প্রায়-নিরবে গড়ে তুলেছেন নিজের এক অনপনেয় ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব এক নিরব রাজনৈতিক কর্মীর, এক ঐতিহ্যঋদ্ধ ভাষাযোদ্ধার, এক সংগ্রামশীল আদর্শ নেতার, এক সংশপ্তক মুক্তিযোদ্ধার, এক আপোষহীন গণতন্ত্রীর, এক পাঠনিবিষ্ট বাঙালি মননের, কিংবা দলমতনির্বিশেষে এক নিরপেক্ষ দেশনায়কের। যার ডাকে প্রায় সমানভাবে সাড়া দিতে দেখেছি সরকার ও বিরোধী দলের নেতা বা নীতিনির্ধারকদের। তবে আজ সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার সর্বগ্রাহ্য মানবিক সৌন্দর্য, যা সমকালীন সমাজে সহজলভ্য নয়।

আমি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী নই। তার সঙ্গে আমার খুব বেশি স্মৃতি নেই। বরাবর দূর থেকেই তাকে দেখেছি, আর এই নিরাপদ দূরত্ব থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। তবে জীবনে মাত্র একবারই তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে খুব নিকট থেকে। দিনটি ছিল ২০১১ সালের ২৫শে মে। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল-দরিরামপুরে সেদিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১২তম জন্মবার্ষিকী উদ্বোধন করেছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার সঙ্গে একই মঞ্চে বসার। আমি ছিলাম নজরুল স্মারক-বক্তা। আমার জন্যে নির্ধারিত ছিল মিনিট দশ-পনেরো। এই সীমিত সময়ে আমি নজরুলের বাঙালি মন্ত্র, জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা নজরুল ও ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অবয়বে নজরুলের বিদ্রোহীসত্তার মূর্ত রূপায়নের বিষয়টি তুলে ধরি। 'জয় বাংলা' শ্লোগানটি যে নজরুলের রচনা থেকে গৃহীত, এ বিষয়টিও উল্লেখ করি। আমি লক্ষ্য করি যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেদিন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে এই কথাগুলো শুনছিলেন। তারপর আমি আসন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং হাসলেন। আমার বক্তব্য ছিল অনুষ্ঠানের শুরুতে; অনুষ্ঠানের স্বাগত ভাষণের পর পরই। তারপর আরো বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দীর্ঘক্ষণ ভাষণ দেয়ার পর প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ভাষণ শুরু করলেন। তার লিখিত ভাষণে তিনি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমার বক্তব্যেরও রেফারেন্স দিলেন। আমি বিস্মিত হলাম তার সহজাত গ্রহণক্ষমতা দেখে। সভাশেষে মঞ্চ থেকে নামার আগে তিনি আমাকে ডেকে বললেন, 'কবি, আপনি খুব ভালো বলেছেন, ঠিক বলেছেন। আমি অপনাদের সকলের লেখা পড়ি। একুশের বইমেলা থেকে আমি প্রতিবছর আপনাদের বই সংগ্রহ করি।' আরো জানালেন, হুমায়ূন তার প্রিয় লেখক। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি শিশুর সারল্য নিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন।

একজন বর্ষীয়ান রাষ্ট্রপতির এই অনাড়ম্বর দিকটি আমাকে তার প্রতি আরো শ্রদ্ধাবান করে তুললো। না, তারপর আর সুযোগ হয়নি তার সান্নিধ্যে আসার। তবে আজ তার মহাপ্রয়াণের দিনে বারবার মনে পড়ছে সেই মুখ, সেই দ্যুতি, সেই স্মিতহাসি।
সংগ্রাম-দুস্তর পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি সারাটি জীবন। রাজনীতির এবড়ো-থেবড়ো পথে কেবল জেল-জুলুম বা নিপীড়ন-বন্দিত্বই নয়, রাজপথে সন্ত্রাসীর বোমাবাজিতে তিনি হারিয়েছেন প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীকেও। তারপরও একমুহূর্তের জন্যে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি তিনি। বার বার দল ও দেশের দুর্দিনে হাল ধরেছেন শক্তহাতে। উদ্ধার করেছেন দল, নেতা-নেত্রী, গণতন্ত্র, দেশ ও গণমানুষকে। কাউকে অযৌক্তিক আক্রমণ নয়, বিপদে ধৈর্যচ্যুতি নয়, কোনো অবাঞ্চিত প্রলোভনে প্রলুব্ধ নয়: বরং তিনি এগিয়ে গেছেন ঝড়েজলে ঝঞ্ঝাজয়ী মাস্তূলের মতো নির্বিকার। মানবিক শিষ্টাচার যে সর্বজয়ী, তারও এক প্রামাণ্য প্রতিকৃতি আমাদের এই মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে তার এই সদাচারী ভূমিকার প্রয়োজনই, বোধ হয়, সবচেয়ে বেশি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহিত অপরাজেয় বাঙালি ও তার জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্যে এই সঙ্কটময় মুহূর্তে উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে আসুক তার সেই মানবিক দ্যুতি, তার সেই সর্বজয়ী হাসি।

২১.০৩.২০১৩

মুহম্মদ নূরুল হুদা : কবি, প্রাবন্ধি, অনুবাদক ও সাংবাদিক ।