দক্ষিণের উত্থান, নতুন বিশ্বের সূচনা

কে এ এম মোরশেদ
Published : 12 Oct 2016, 05:08 AM
Updated : 16 March 2013, 05:50 AM

এবছর প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির 'মানব উন্নয়ন রিপোর্টে'র মূল বিষয় 'দক্ষিণের উত্থান' এসময়ের আলোচিত একটি বিষয়। অর্থনীতির পরিভাষায় 'দক্ষিণ' শব্দটি দিয়ে উন্নত বিশ্বের বাইরে, দক্ষিণ ও উত্তর গোলার্ধের সব উন্নয়নশীল দেশকেই বোঝায়। এ উত্থানের ব্যাপকতা বুঝাতে বড় দুই শক্তি ভারত ও চীনকে একটা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। গত ২০ বছরে প্রায় ২০০ কোটি লোকের এ দুই দেশের জাতীয় উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার ফলে, মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৮০০ সালের শিল্প বিপ্লবের সময়কালের প্রবৃদ্ধিকেও হার মানায়। সত্যিই বহু ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে এ উত্থান এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে, রিপোর্টটির মূল গল্প সাম্প্রতিক সময়ে আশাতীত উন্নয়ন করা দক্ষিণের ৪০টি দেশ, এবং বিশেষ করে উন্নয়নের বিচারে যে ১৮ দেশ অসামান্য শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার তাদের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা ঘিরে। আর গল্পের বিস্তার হল এ উত্থানের অন্তর্নিহিত কারণ, শিক্ষণীয় বিষয়, এবং সম্ভাব্য পরিণাম। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য গল্পটি বিশেষ আগ্রহের ও আনন্দের কারণ হবে— বাংলাদেশ যে সেই ১৮ দেশেরই একটি।

রিপোর্টে এসব আশাতীত উন্নয়ন নৈপুণ্যের পেছনের তিনটি প্রভাবককে সাধারণভাবে আলাদা করা হয়েছে। প্রথমটি হল, ক্রিয়াশীল ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় খাত যা সফল এসব দেশকে 'কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের' পরিধি পার হয়ে 'উন্নয়ন রাষ্ট্রে' পরিণত করেছে। এসব রাষ্ট্র শুধু 'সামাজিক নিরাপত্তা' বেষ্টনী দিয়ে বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি সারিয়েই বসে থাকে না- বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের সক্ষমতা বাড়াতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জনসেবা খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করে। পাশাপাশি, এধরনের রাষ্ট্র প্রচলিত নীতি-পরামর্শের উর্ধ্বে উঠে, সুপ্ত সম্ভাবনাময় বা কাঠামোগত কারণে প্রতিযোগিতায় অক্ষম শিল্পখাতকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে সফলভাবে প্রতিযোগীও করে তোলে। অন্যভাবে, এসব রাষ্ট্র শুধু বাজার-নির্ভর না হয়ে সক্রিয়ভাবে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে অংশ নেয়।

গবেষণায় দেখা যায় যে, এসব 'উন্নয়ন রাষ্ট্র' পাইকারি বা নিবির্চার সংস্কারের পথ পরিহার করে বরং এক এক করে সমস্যা সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে। ১৯৫০-২০০৫ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু দেশের উপর একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, পাইকারি অর্থনৈতিক সংস্কার করলেই উন্নয়ন হয় না— যারা উন্নয়ন করেছে তারা বরং পাইকারি সংস্কার থেকে দূরে থেকেছে, এবং যারা পাইকারি সংস্কার করেছে তাদের অনেকেই উন্নয়ন করতে পারেনি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে এ অসামান্য উন্নয়ন অগ্রগতির প্রভাবক বলা হচ্ছে তা হল, আর্ন্তজাতিক বাজারের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ। এসব দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের প্রায় সবই উত্তরের দেশগুলোর চেয়ে মূলধনী ও অর্ন্তবর্তী পণ্য আমদানি এবং উন্নত দেশে পণ্য রপ্তানি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল— যদিও ক্রমে এরাই এখন মূলধনী ও অন্তর্বর্তী পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। উন্নয়নশীল দেশগুলো, ২০১১ সালের হিসেবে বিশ্বের মোট ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে যা ১৯৮০ সালে ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ। আর এ সময়ে বিশ্বের পণ্যবাণিজ্যে এসব দেশের অংশ ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে চীন, ভারত, ও ব্রাজিল বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ উৎপাদন করবে।

তবে এ বিশ্বায়নের পথ ছিল প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা— বাংলাদেশ যেমন তৈরি পোষাক শিল্প দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তেমনি ঘানা করেছে কোকো দিয়ে। মালয়েশিয়া যেমন বিশ্বায়নের জন্য প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করেছে, দক্ষিণ কোরিয়া তখন লাইসেন্সিং-এর মাধ্যমে প্রযুক্তি আমদানি করে প্রযুক্তিখাতে বিশ্ববাজারের কোম্পানিগুলোর সাব-কন্ট্রাক্টের কৌশল নিয়েছিল।

এসব অসাধারণ যাত্রায় একটি জিনিস স্পষ্ট- আর তা হল সব শুল্ক ও অশুল্ক বাধা ভুলে বিশ্ববাজারে নিজেকে বিলীন করে দিয়েই এসব দেশ সাফল্য আনেনি বরং দেখা যায় যে, এরা নিজেদের বাস্তবতায় ক্রমান্ময়ে স্থানীয় অর্থনীতিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে একীভূত করেছে। একই সঙ্গে নিজ নিজ জনসাধারণের দক্ষতাবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশে মন দিয়েছে।

তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্য এসব সফল দেশে দেখা যায় তা হল, উন্নয়নের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রের অবিচল সংকল্প। অন্যভাবে বললে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার জনগোষ্ঠীর মানব উন্নয়ন- তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের অবিরাম প্রচেষ্টাই এসব রাষ্ট্রকে সফল করেছে। উন্নয়ন সাফল্যের জন্য বাজারে প্রবেশাধিকারসহ সকল ক্ষেত্রেই সাম্য প্রয়োজন। যদিও প্রায়ই এসব রাষ্ট্রকে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে নীতি-উপদেশ শুনতে হয়, সফল কোনো রাষ্ট্রই এ উপদেশ শুনেছে বলে দেখা যায় না। সর্বজনীন জনসেবায় প্রবেশাধিকারের জন্য এ রাষ্ট্রগুলো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও সাময়িক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জনসেবা গ্রহণের সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করেছে, আর সে সঙ্গে সরকারি স্কুল ও ক্লিনিক বা হাসপাতালে বিনিয়োগ করে জনসেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে।

এখানে আরও একটি জরুরি বিষয় হল উদ্ভাবনী ক্ষমতা। এসব সফল উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করে সর্বজনীন সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য উদ্ভাবনী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। যেমন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ এ খাতে বাংলাদেশকে সমকক্ষ অনেক দেশের তুলনায় ভালো ফল এনে দিয়েছে। ঘানা তাদের প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক গণিত সংযুক্ত করে সবার জন্য শিক্ষাকে আরও কার্যকরী করে তুলেছে।

এ তিনটি প্রভাবক থেকে একটা উপসংহার টানা যায়, আর তা হল সফল দেশগুলো তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মোহাবিস্ট না হয়ে এবং বদ্ধ-দুয়ার নীতি থেকেও দূরে থেকে, নিজ নিজ সমাজ, সংস্কৃতি, সামর্থ্য ও আকাঙ্খার নিরিখে বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেছে। তাই সফলতার কোনো মহৌষধ নেই, নেই কোনো যাদুর কাঠিও।

প্রতিবেদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এ উত্থান থেকে বিশ্ব কীভাবে লাভবান হতে পারে সে সংক্রন্ত প্রস্তাবনা। প্রথমত, এসব সফল দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে গেলে বিশ্ব উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান, যেমন জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি প্রতিটি ফোরামে দক্ষিণের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে প্রায় সব বিশ্বসংস্থার গঠন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সেকেলে— নতুন অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এখানে প্রতিফলিত হয় না। বাংলাদেশসহ দক্ষিণের আরও অনেক দেশ বেশ কিছুদিন ধরেই এ দাবি করে আসছে। আর এ পরিবর্তন শুধু প্রয়োজন নয়, অবশ্যম্ভাবীও।

আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার বিকাশ দেখছি, যেমন ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড ওই অঞ্চলের দেশগুলোর স্বার্থ বজায় রেখে আইএমএফ-এর মতোই আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করছে। এ অবস্থায় বিশ্ব সংস্থাগুলো যদি দ্রুত নিজেদের বদলাতে না পারে, তবে তা বিশ্বপর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। সে সঙ্গে দক্ষিণের 'সুশীল সমাজের' প্রতিনিধিদের জন্যও বিশ্বমঞ্চে অধিকতর ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি জরুরি।

দ্বিতীয়ত, ১৯৮৭ সালে গঠিত 'দক্ষিণ কমিশন'— যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন সেসময়ের তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নাইয়ারে ও বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তৈরি করেছিলেন— এর আদলে এবং বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বর্তমান জি ৭৭ বা সমপর্যায়ের ফোরাম থেকেও এ ব্যাপারে ধারণা নেয়া যেতে পারে। এরকম একটি কমিশন দক্ষিণের চাহিদা ও প্রয়োজন যেমন বিশ্বসভায় তুলে ধরতে পারে তেমনি বিশ্ব সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারেও ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া এ কমিশন দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে দক্ষিণ-দক্ষিণ বাণিজ্য-উদারীকরণে ভূমিকা রাখতে পারে।

তৃতীয়ত, জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল, যার কর্মপরিধি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্ধারিত হয়, এ ব্যাপারে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণের সফল রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা অন্য রাষ্ট্রে পৌঁছে দিতে এবং পারস্পরিক বিনিময়ে সহযোগিতায় জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল ইতোমধ্যেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তবে দক্ষিণের এ ভূমিকা আরও জোরদার করার সুযোগ রয়েছে- দরকার এ তহবিলের কর্মপরিধি পুনর্বিবেচনারও।

আশা করি, বাংলাদেশসহ দক্ষিণের বেশ কিছু দেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা দক্ষিণের বাদবাকি দেশগুলোকে তাদের নিজেদের উন্নয়নের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, এসব তারকা পারফর্মারদের জন্য বিশ্বসভা নতুন আসন করে দেবে।

এসব আসনের একটি হবে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের জন্য, এ প্রত্যাশা আমাদের হতাশা ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যম যোগাবে সেই আকাঙ্খা থেকে রিপোর্টটিকে স্বাগত জানাই।

কে এ এম মোর্শেদ : জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ দপ্তরের সহকারি কান্ট্রি ডাইরেক্টর।