আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয়েছিল ১৯১০ সাল থেকে। সে হিসেবে এবারের দিনটি ১০৩ তম নারী দিবস। শতবর্ষ পুরনো এ দিন বছরের অন্যান্য দিনের মতোই একটি দিন। তবে এ দিন বিশেষ করে নারীর জন্য এ কারণে যে, এ দিনে আমরা সবাই নারী-ইস্যু, নারী-আন্দোলন, নারীর অবস্থান ও অর্জনগুলো নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করব এবং মনে রাখব- দিবস পালনের যৌক্তিকতা এখানেই।
এরকম সুনির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে আমরা আরও অনেক দিবস পালন করি। যেমন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা নিজের ভাষার অগ্রগতি ও মর্যাদাবৃদ্ধির দিকটি নিয়ে কথা বলি, সেভাবে এগুনোর দিকনির্দেশনা নিই। বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসও তেমনই কিছু দিবস। একইভাবে মহান মে দিবসে আমরা শ্রমিক অধিকারের কথা তুলে ধরি।
এসব দিবস পালন মানে বছরের ৩৬৪ দিনে আমাদের দাবিগুলো ভুলে থাকা নয়। সারা বছর আমরা আর এ নিয়ে চর্চা করব না বা বিষয়গুলো ভুলে যাব সেটাও নয়। বিশেষ দিবস পালন মানে একটি দিনে বিশেষভাবে ভাবা, কথা বলা, পদক্ষেপ নেয়া। গোটা বিশ্বের মানব সমাজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অঙ্গীকার করবে যে, তারা নারীর প্রতি সমাজে ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান সব ধরনের বৈষম্য ও দমনমূলক নিয়ম-নীতির অবসান ঘটাবে। সমাজ-রাষ্ট্রের মূলস্রোতে নারীকে গতিশীল করে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই নারী দিবসের মূল চেতনা।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এবারের নারী দিবসের তাৎপর্য আরও বেশি। এমন একটি সময়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে যখন দেশজুড়ে চলছে গণজাগরণ। একদিকে যুদ্ধাপরাধীরদর বিচার চলছে; অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, তারা দেখিযে দি্চ্ছে কেমন বাংলাদেশ তারা চায়, মনে করিয়ে দিচ্ছে কী ছিল আমাদের গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশ কী, কেমন ছিল তার ত্যাগ ও অর্জনের ইতিহাস সেসব নিয়ে মানুষকে সচেতন করছে নতুন প্রজন্ম। আমরা জানি, গত এক মাস ধরে নবীন প্রজন্মের সচেতন ও দেশ নিয়ে ভাবে এমন অংশটি দেশজুড়ে গণজাগরণ তৈরি করেছে।
আমরা এটাও জানি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। সম্মুখযুদ্ধে অনেক নারী অংশ নিয়েছিলেন। সে সব কথা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা নারীদের মধ্যে আমরা বীরপ্রতীক তারামন বিবির কথা শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু এমন আরও নারী রয়েছেন যাদের কথা আমাদের শোনা হয়নি। এর কারণ কোথাও কোথাও পুরুষ নারীর এ অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন, কোথাও দেননি। তাই অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন।
এর বাইরে রয়েছেন সে সব গাঁয়ের বধূ বা বা সাধারণ শহুরে নারী- প্রাণের ঝুকি নিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহা্য্য করেছেন। ভাত রেঁধে খাইয়েছেন, দু'দণ্ড বিশ্রামের জন্য নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন, পথ চিনিয়ে দিয়েছেন- তাদের অবদান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অপূর্ণ। সে সব কথাও আমরা এখনও ঠিকঠাক তুলে ধরিনি।
বীরাঙ্গনাদের অবদানের কথা খুব মোটা দাগে বলা হয়। কিন্তু যে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা সে জন্য কি আমরা তাদের যথাযোগ্য মূল্য দিয়েছি? বীরাঙ্গনা শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছিল- মুক্তিযদ্ধে তাদের অনন্যসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিদানের চিন্তা থেকেই- সেটাও আমরা পারিনি। বাঙালির প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ থেকে, বাঙালিকে দমনের হিংস্রতা থেকে পাকসেনারা এদেশের নারীদের ওপর যৌন-সহিংসতা চালিয়েছিল। বীরাঙ্গনারা সমাজে-রাষ্ট্রে সাদরে গৃহীত হননি। তারা আমাদের মা, আমাদের বোন। অথচ তাদের বেশিরভাগই দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্যে জীবন কাটিযে দিচ্ছেন।
এ সব কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীর নানা ধরনের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়ার কাজটি করতে হবে। ২০১৩ সালের নারী দিবসে, বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীদের এ অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
আমাদের সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারী নির্যাতন সমাজে সবসময়ই ছিল। কিন্তু এখন গণধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের চিত্র ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে। এ ধরনের বর্বরতা বাড়ছে বলে অসংখ্য নারীর জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এগুলো সামগ্রিকভাবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা। একদিকে নারী শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে চাচ্ছে- অন্যদিকে তার অগ্রযাত্রায় বাধা দিতে দুর্বৃত্তরা নিপীড়নকে হাতিয়ার করছে।
নারী নির্যাতনের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ কিন্তু আইনের প্রয়োগ না হওয়া। প্রচুর আইন আছে দেশে। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিপীড়িত নারী ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। বরং নানা সময়ে তাকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, 'তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছ যার জন্য তোমার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটল!' এভাবে নিপীড়নের শিকার নারীর জীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নির্যাতকদের শাস্তি না দেওয়ার ফলে বা তারা নানাভাবে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে বলে এটাও এক ধরনের প্রশ্রয় বলা যায়। এর ফলে একুশ শতকে আমাদের নারীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে।
আমি তাই মনে করি যে, এ বছরের নারী দিবসে এটাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত যে, নারীর প্রতি অতীত ও বর্তমানে যত সহিংসতা হয়েছে বা হচ্ছে তা রুখে দিতে হবে। এটা কেবল নারীর একার দায়িত্ব নয়, নারী সংগঠনগুলোই শুধু এ নিয়ে কথা বলবে তা হয় না। সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ে বসবাস করেন। পুরুষ তো পশু নয়, তাদের আমরা সেভাবে দেখতে চাই না, নিপীড়ক হিসেবে ভাবতে চাই না। তাতে পুরুষেরও অমর্যাদা হয়। নারী যদি পুরুষের দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তাহলে পুরুষের অবস্থানও নিচে নেমে যায়। তাই পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তনও খুব জরুরি। পুরুষ নিজে যখন বুঝতে শিখবে যে, এ ধরনের আচরণের দ্বারা সে নিজেই নিজের অবমূল্যায়ন করছে তখন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে।
তাই নারী ও পুরুষ উভয়কে সচেতন হতে হবে। মানুষকে যারা ভালবাসেন, মর্যাদা দেন তারা নারীকে নিপীড়ন করতে পারেন না। তারা নিজের সম্মান ও অধিকার বোঝেন, অন্যের ব্যাপারেও সচেতন থাকেন। জীবনের সবক্ষেত্রে তাহলে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, নারীও তার আপন পথে কোনো বাধার মুখোমুথি হবেন না।
খুশি কবির : মানবাধিকার কর্মী ও 'নিজেরা করি' সংগঠনের সমন্বয়কারী।