উগো চাবেস: গণনায়কের মহাপ্রয়াণ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Published : 6 March 2013, 05:56 PM
Updated : 6 March 2013, 05:56 PM

উগো চাবেস ছিলেন জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী নেতা। এই দুটো পরিচয় একসঙ্গে করে নিলে তবেই তাকে বোঝা যাবে। তিনি দেশের মানুষকে ভালবাসতেন। অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। বাগ্মী হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। যেকোনো নেতার জন্যই এগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় গুণ। কিন্তু তার জনপ্রিয়তার আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হল তিনি তার দেশে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পেরেছিলেন। বেনেসুয়েলা তেলের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই অর্থে সৌদি আরবের চেয়েও বেনেসুয়েলা গুরুত্বপূর্ণ এক দেশ । কিন্তু এ তেলসম্পদ দেশের মানুষের কাজে লাগত না। তেল উৎপাদন করতো বিদেশি কোম্পানি এবং তাদের সঙ্গে যোগসাজস ছিল দেশীয় শাসকদের। সাধারণ মানুষ এ সম্পদের কারণে মোটেই উপকৃত হয়নি। বরং নিপীড়িত ও দারিদ্রপিষ্ট হয়েছে।

চাবেস রাজনীতিতে এসেছিলেন এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। তিনি বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে বিতারিত করেছেন এবং জনগনের অর্থনৈতিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এজন্য দেশে বিদেশে তার শত্রুর কোনো অভাব ছিল না। দেশের ধনিকশ্রেণির মানুষেরা আগাগোড়া তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমেরিকা। আমেরিকা তাকে দুর্ধর্ষ বর্বর ইত্যাদি নানা নামে ভূষিত করেছে। কেননা তিনি ছিলেন আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে।

গোটা লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতেও যে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন এসেছে সেক্ষেত্রেও তার অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তিনি জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং সমাজের নিপীড়িত মানুষদের পক্ষে কাজ করেছেন। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষও তার দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছে। মার্কসবাদকে তিনি লাতিন আমেরিকান রুপ দিয়েছিলেন। তার জাতীয়তাবাদে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদের হাতে নিগৃহীত মানুষরা তাকে তাদের পক্ষের একজন নেতা বলে মনে করতেন।

দেশে বিদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শত্রুর বিপুল বিরোধিতা সত্বেও তিনি চৌদ্দ বছর বেনেসুয়েলার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। খোদ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নিয়ে তিনি তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে যেভাবে সমালোচনা করেছেন তা পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

পুঁজিবাদী শক্তি তাকে পরাভুত করতে পারেনি। কিন্তু ক্যান্সার তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল। মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত তিনি দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন এবং লাতিন আমেরিকায় মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যা্ওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

মাত্র আটান্ন বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে সকল দেশের মুক্তিকামী মানুষই একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল। বিশেষভাবে ক্ষতি হল লাতিন আমেরিকার মানুষদের যারা তাকে অত্যন্ত আপনজন বলে জানতেন। কিন্তু তার পুঁজিবাদী সপক্ষ, বিশেষ করে, আমেরিকা এ মৃত্যুতে স্বস্তিবোধ করবে। দেখা যাচ্ছে, তার মৃত্যুর পরও তার জীবদ্দশায় যে ধরনের অপপ্রচার করা হচ্ছিল সেগুলো শেষ হয়নি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মানুষের মুক্তির স্বপ্নে তিনি জীবিত থাকবেন এবং দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চাবেস চলে গেলেও তার প্রদর্শিত পথ বিলুপ্ত হয়ে যাবে না।

দেশি বিদেশি শত্রুপক্ষরা তার বিরুদ্ধে প্রচারের ব্যাপারে নতুন উৎসাহে বলীয়ান হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে তার সংগ্রাম ও বিপ্লবী চেতনা মোটেই মলিন হয়ে যাবে না। তিনি লাতিন আমেরিকায় তো বটেই, বর্তমান বিশ্বেরও জাতীয়তাবাদ এবং বিপ্লবী চেতনাকে কীভাবে একত্র করা যায় তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, কলামিস্ট ও লেখক।