পানিসম্পদ বিষয়ক উন্মুক্ত তথ্য ও উপাত্তের জটিলতা

জাহিদুল ইসলাম
Published : 6 March 2013, 02:42 AM
Updated : 6 March 2013, 02:42 AM

১)
বছরখানেক আগের কথা, গঙ্গা চুক্তির অন্তর্বর্তীকালীন সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধের কাজ করছিলাম। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৯৬ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সময়কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই প্রায় পনের বছরে ঠিক কতটা সফল ছিল গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়ন। আমাদের গবেষণার জন্য প্রয়োজন ছিল ১৯৯৭ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতের ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ (ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে), সেই সাথে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ।

বাংলাদেশের পানিসম্পদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা জানেন সেখানে উপাত্ত পাওয়াটা কতটা কঠিন ও দুরুহ একটা বিষয়। আর তা যদি হয় গঙ্গা চুক্তির মত আন্তসীমান্ত বিষয়ক কোনকিছুর উপাত্ত সেক্ষেত্রে তা আরো বেশি দুরুহ কারণ স্বভাবতই এই বিষয়গুলিতে সরকার পর্যায়ে কিছু গোপনীয়তা থাকে। যদিও নদীর প্রবাহের উপাত্তের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ঠিক কতটা যৌক্তিক তা বিতর্কের দাবী রাখে। যাই হোক, এই যখন উপাত্তের অবস্থা ঠিক সেই সময়ে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ সরকারের যৌথ নদী কমিশন, যা কিনা জে আর সি নামে পরিচিত, তার ওয়েবসাইটে গঙ্গা চুক্তির কার্যকর সময়ের জন্য (জানুয়ারী-মে) দশ দিনভিত্তিক উপাত্ত প্রেসনোট আকারে দেয়া আছে। বিষয়টি খুব ইতিবাচক মনে হলো আমার কাছে, তবে সমস্যা হলো উপাত্তের সময়ের ব্যাপ্তি দেখে। শুধুমাত্র ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত উপাত্ত দেয়া আছে। এর পরেও খুব বেশি আশাহত হইনি সেই সময়, ধারণা করেছিলাম যেহেতু এই চার-পাঁচ বছরের উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত স্বভাবতই বাকী বছরগুলোর উপাত্তও যোগাযোগ করলে পাওয়া যাবে। সেই অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইটটি JRC (http://www.jrcb.gov.bd/) ঘেটে যোগাযোগের ইমেইল এড্ড্রেসে (jrcombd@gmail.com)সব কিছু ব্যাখ্যা করে ইমেইল করলাম, সাথে জুড়ে দিয়েছিলাম একটি রিড রিসিপ্ট রিকোয়েষ্ট। রিড রিসিপ্ট এক ধরনের ইমেইল রিপ্লাই যাতে আপনার পাঠানো ইমেইলটি প্রাপক পড়ে থাকলে তা জানা যায়। দূঃখজনক হলেও সত্য, ইমেইলটি পড়া হয়ে থাকলেও এর কোন উত্তর পেলামনা। পরবর্তীতে আবার একটি ইমেইল করলাম এবং সেখানে উল্লেখও করলাম যে আমার আগের ইমেইলটি পড়া হয়ে থাকলেও কোন রিপ্লাই পাইনি। যথারীতি আজ পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া পাইনি। এখানে দুটি প্রশ্ন আসেঃ এক, ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত উপাত্ত সবার সামনে উন্মুক্ত করা হলেও কেন তার আগের উপাত্ত উন্মুক্ত করা হচ্ছে না এবং, দুই, যথযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ পাঠানোর পরেও কেন সেই উপাত্ত দেয়া হচ্ছে না বা নিদেনপক্ষে না দেবার ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে না? এর উত্তর আমার জানা নেই!

২)
উপরে যে অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম, সেটা হয়ত নতুন কিছু নয়। পাঠকের মধ্যে অনেকেরই হয়ত এরকম অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তবে এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করার একমাত্র কারণ একটি পুরোনো বিষয়কে আবারো সামনে নিয়ে আসা, আর তা হলো পানিসম্পদ বিষয়ক তথ্য বা উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত করা। আর শুধু পানিসম্পদ নয়, গবেষণার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিৎ করতে যথাযথ উপাত্তের উন্মুক্তকরণ জরুরী। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাইরে একেবারে বিপরীত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।

আমার পিএইচডি গবেষণার জন্য উপাত্তের প্রয়োজনে এখানকার অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপাত্ত ইন্টারনেটে উন্মুক্ত, যেসব উপাত্ত উন্মুক্ত নয় সেগুলোর জন্য ইমেইলে বা ফোনে অনুরোধ করলেই উপাত্ত পাওয়া যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকের অনুরোধসহ ইমেইল প্রয়োজন হয়। এর চেয়ে বড় কোন কাঠখড় পোহাতে হয়নি। এমনকি আমার গবেষণার প্রয়োজনে আমি এমন অনেক উপাত্ত বা মডেল ব্যবহার করেছি যা কিনা সবার কাছে উন্মক্ত করাও হয়না, কিন্তু গবেষণার গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে এখানকার সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সেটা আমাকে দিয়েছেন। শুধু একটি সম্মতিতে আসতে হয়েছে, তাদের অনুমতি ছাড়া এই উপাত্ত আমি অন্য কাউকে দিতে পারবনা। অনেক ক্ষেত্রেই যে সব তথ্য সবার কাছে উন্মুক্ত নয় সেটি উল্লেখ করতে আমার থিসিসে বা গবেষণা প্রবন্ধে তাদের নাম রেফারেন্স হিসেবে দিয়েছি, এবং অবশ্যই তাদের অনুমতি নিয়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গবেষণার কোন বিষয়ে, সেটা উপাত্তই হোক বা মডেল হোক না কোন সাধারণ তথ্যই হোক, ইমেইল করার পরপরই তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।

৩)
একই প্রেক্ষাপটে দুটো বিপরীত উদাহরণ দেখানো হলো। একই প্রেক্ষাপট বলছি কারন দুটো ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য একটাইঃ গবেষণা। একটি দেশের সরকারের পক্ষে একাই সবকিছু নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে সেটা হয়ত সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতো রয়েছেই, এছাড়াও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এই মানুষগুলো দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশের বিভিন্ন সমস্যে নিয়ে তাদের গবেষণা করার সুযোগ ও ইচ্ছে দুটোই রয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে যদি বাংলাদেশের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত উন্মুক্ত করা হয়। উপরুন্ত, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা শুধুমাত্র উপাত্তের এই জটিলতার কারণেই বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার মনে আছে আমার অধ্যাপককে একবার বলেছিলাম আমি তোমার সাথে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কিছু ফ্রিল্যান্স গবেষণা করতে চাই। উত্তরে ও জানিয়েছিল দেখ, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে গবেষণার মূল প্রতিবন্ধকতা একটাই-উপাত্ত। যদি উপাত্ত সংগ্রহ করতে পার সেক্ষেত্রে এইখানকার কিছু গবেষণা আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

আরেকটি বিষয়, উপাত্ত উন্মুক্তকরণের ক্ষেত্রে শুধু কিন্তু অনুরোধের বিষয়ই আসেনা, আসে অধিকারের প্রসংগও। বাংলাদেশ সরকার এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষদের কর থেকে অর্জিত অর্থ থেকেই। অথবা, বিদেশী দাতা সংস্থার অনুদান থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেও সেটার ভার কিন্তু সাধারণ জনগণকেই পোহাতে হয়। সেক্ষেত্রে এই উপাত্তের উপর মানুষের অধিকারও রয়েছে। প্রসংগত একটি অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। আমার পিএইচডির প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রকল্পটির উদ্যোক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসেনিক এন্ড এটমসফেরিক এডমিনিষ্ট্রেশন বা NOAA। আমরা সেই প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে উপাত্ত সংগ্রহ করতাম এবং সেসময় আমাদেরকে প্রতিজ্ঞা করতে হতো যে আমরা এই উপাত্ত দিয়ে গবেষণা করে সে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখব সেখানে উল্লেখ করবো যেঃ 'এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ওকলাহোমার সাধারণ মানুষদের কর থেকে অর্জিত অর্থ থেকে'।

পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, অনুরোধ বা অধিকার যেটাকেই আপনারা বিবেচনা করেন না কেন, প্রয়োজনীয় সব উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত করুন, অথবা, নিদেনপক্ষে এমন ব্যবস্থা রাখুন যেন ন্যূনতম প্রশাসনিক জটিলতা ছাড়াই গবেষকরা পানিসম্পদ বিষয়ক উপাত্ত ও তথ্য সহজেই পেতে পারে।

ডঃ জাহিদুল ইসলাম: পানি বিশেষজ্ঞ ও লেখক।