প্রজম্মের ইতিহাস-বোধ

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
Published : 4 March 2013, 10:07 AM
Updated : 4 March 2013, 10:07 AM

দীর্ঘ চার-সপ্তাহ ধরে শাহবাগ চত্বরে কিশোর তরুণদের আহ্বানে এবং তাদেরই নেতৃত্বে যে মহাসমাবেশ ঘটছে, যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দেশের তরুণ সমাজ নিজেদের সমাবেশকে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় বলে ঘোষণা করে অভূতপূর্ব অহিংস অবস্থান-ধর্মঘটের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাতে ওদের সম্পর্কে, ওদের ইতিহাস-বোধ সম্পর্কে আমাদের অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠ প্রজম্মের ধারণা যথেষ্ট পাল্টে গেছে।

বিষয় হিসেবে ইতিহাসের বাজারমূল্য নেই; তাই এখনকার বস্তুসচেতন এবং বাস্তব লাভ-লোকসানের টনটনে জ্ঞানসম্পন্ন বহু তরুণই ইতিহাসকে কোনো কাজের বিষয় বলেই মনে করে না। মৃতদের নিয়ে নাড়াচাড়া করতে তারা নারাজ; অতীত থেকেও যে শেখার কিছু আছে এবং সে শিক্ষা বর্তমানের বাস্তবতায় শান দিয়ে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা যায় তা আমাদের ধারণা ছিল এখনও অধিকাংশ তরুণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

কিন্তু শাহবাগ চত্বরের বিপুল সমাবেশ আমাদের এমন ধারণায় চিড় ধরিয়েছে। গত ক'দিনের উৎসাহব্যঞ্জক আয়োজন এবং সেখান থেকে উত্থিত গগনবিদারী শ্লোগান, সারাদেশে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী- এক কথায় প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত সমাজে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে তাতে মুঠোফোন টিপে টিপে গেম-খেলা বা এসএমএস লেখা বা হাত-পা নেড়ে অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলার যে ছবি অহরহ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ক্যাম্পাসে চোখে পড়ে তা যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। ওই ছেলেমেয়েগুলোই কি প্রজম্ম চত্বরে গিয়ে একাত্তরের নরখাদকদের ফাঁসি চায়?

উত্তর-একাত্তর এ প্রজম্মের কেউই যুদ্ধ দেখেনি। সে সময় রাজাকার-আলবদর-আলশামস্ আর জামায়াতে ইসলামের ঘৃণ্য কাজকর্মও এরা দেখেনি কেউই। কিন্তু ইদানিং স্বমূর্তিতে জেগে ওঠা ওইসব কীটপতঙ্গের দৌরাত্ম্যে এরা হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে তাদের সে সময়কার কীর্তিকলাপ। হয়তো এজন্যই ট্রাইবুনালের রায় প্রত্যাখ্যান করে, আদালত অবমাননাকে থোড়াই পরোয়া করে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছে রাস্তায়। হাতে অনেকের তখনকার মানচিত্রঅলা পতাকা এবং মুখে সেদিনের শ্লোগান যার কোনো কোনোটির আজ উপযোগিতা তেমন না থাকলেও চল্লিশ বছর আগের সে আবহ, সে তেজ ফুটিয়ে তুলতেই এসব শ্লোগান তারা উচ্চারণ করছে।

প্রজম্ম চত্বরের সমাবেশে ব্যাপক আবেগ আর ভাবাবেগ সৃষ্টি করে তরুণ-তরুণীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে আছে। এদের এবং টেলিভিশনে আগত বক্তাদের নানা কথাবার্তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি ছাড়াও একটি সুদূরপ্রসারী কল্যাণকর দাবি আমার কাছে খুবই যৌক্তিক বলে মনে হয়। সেটি হল দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি।

বাস্তবিকই, ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার আমাদের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণই হয়েছে বেশি। ধর্মের নামে ভূখণ্ড ভাগ হয়েছে, লাখো-কোটি প্রাণ বিসর্জিত হয়েছে, কোটি মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা। ধর্ম সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস। ধর্ম কথা বলে মানুষের দুই কাল নিয়েই যদিও তা পরবর্তী জীবনের পুরস্কার আর লাভ-লোকসানের ইতিবৃত্ত দিয়েই রচিত এবং পরকালের লোভ-লালসা ও শাস্তির নিক্তিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পার্থিব জীবন।

অন্যদিকে, রাজনীতিতে পরকালের কোনো স্থান নেই। কেউ মারা গেলে মৃতব্যক্তির জন্য রাজনীতি-অর্থনীতি হয়ে পড়ে অবান্তর যদিও মৃতকে ঘিরে জীবিতরা রাজনীতি করে ইহকালের ফায়দা লুটতে তৎপর হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিভিন্ন ধর্মের লোকের বাস এ দেশে। একটি চমৎকার শ্লোগান ইদানিং বেশ প্রচলিত ধর্ম যার যার, উৎসব বা সংস্কৃতি বা রাষ্ট্র সবার।

সম্প্রতি বিশ্বের এক নম্বর মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার যোগ-জাকার্তার গাদজামাজা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ও দর্শনীয় মসজিদটি নাকি রোববারে খ্রিষ্টানদের সার্ভিসের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং ওদের মাল্টিপারপাস হলটি ওরা জুম্মার নামাজ, রামায়ণভিত্তিক নাটক, জাভার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের পরিবেশনায় ব্যবহার করে। সম্প্রতি উগ্র ইসলামী মৌলবাদী কার্যকলাপ দুয়েকটি দ্বীপে দেখা গেলেও, সামগ্রিকভাবে সেখানকার মুসলমানদের পরধর্মমত সহনশীলতা এবং নিরবে সভ্যভব্যভাবে নিজের ধর্ম পালন চোখে পড়ার মতো।

অথচ এদেশে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে সম্পূর্ণ অনাবশ্যকভাবে রাষ্ট্রীয় ধর্ম বানিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের আহত করা এবং সে ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা-খুন-রাহাজানি ইত্যাদি চলতে দেওয়া কোনো রাষ্ট্রেরই কাম্য নয়। হয়তো এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ-চলাকালীন সময়ে ধর্মের নামে ইসলামী দলগুলো যে ব্যাপক হত্যা ও লুটতরাজ চালায় তা দেরিতে হলেও এ প্রজম্ম বুঝতে পেরেছে এবং সে সময়কার অপরাধের কোনো বিচার না পেয়ে আজ তারা শত শিখায় জ্বলে উঠেছে। কিন্তু শিখা অনির্দিষ্টকাল জাগরুক রাখা যায় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই এ শিখা স্তিমিত হয়ে যাবে। এ জন্য সরকারের উচিত হবে এদের দাবি-দাওয়া দ্রুততার সঙ্গে মেনে নিয়ে তা কার্যকর করে আন্দোলনরত যুবসমাজকে ঘরে ও শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যেতে সাহায্য করা।

একটি জাতিকে যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কেবল আন্দোলনই করে যেতে হয় তাহলে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় যে স্থিতধী পরিবেশ এবং সৃজনশীল সময় তা সৃষ্টি হবে কী করে? আমাদের পূর্ববর্তী প্রজম্ম আন্দোলন করেছে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, আমরা করেছি পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে। এখন এ প্রজম্মকে যদি আবার আন্দোলন করতে হয় আমাদেরই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে তাহলে জাতি এগোবে কী করে? আমাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে কেন এ প্রজম্মকে লেখাপড়া ছেড়ে দিন রাত সংগ্রামে নিয়োজিত হতে হবে? দুধের শিশুর মুখে হত্যা-খুন-ধর্ষণর বিরুদ্ধে শ্লোগান কি মানায়?

এ জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলি, আপনারা তরুণদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের আগে, তাদের স্যালুট দেওয়ার আগে একটু নিজেদের দিকে তাকান এবং লজ্জিত হন। এ প্রজম্মকে এ ধরনের আন্দোলন থেকে মুক্তি দেওয়ার দায় আপনাদেরই। আপনারা বিপুল সমারোহে আছেন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। আপনাদের দূরদর্শিতার অভাবে, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আপনাদের অশুভ আঁতাত প্রচেষ্টার আভাস পেয়ে, আপনাদের সুবিধাবাদী রাজনীতি আর অপশাসনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আজ শিশুদেরও নামতে হয়েছে রাস্তায়। নিজেদের বিবেককে (যদি থাকে) প্রশ্ন করুন কেন তরুণদের রাস্তায় নামতে হবে, কেন ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিনের পর দিন তাদের কাটাতে হবে রাস্তায়।

এতে উৎফুল্লিত হওয়ার কিছু নেই, আছে লজ্জিত হওয়ার। এ শিশু-তরুণ-যুবকদের এখন প্রস্তুতির সময়। তাদের স্কুলে, ঘরে, সৃষ্টিশীল কাজে ফিরিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আপনাদেরই; এবং কাজটি যত দ্রুত করবেন জাতির জন্য ততই মঙ্গল।

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : নর্থসাউথ ইউনভার্সিটির অধ্যাপক।